কম মজুরির ঢাকায় শ্রমিকদের খরচ উন্নত দেশের তুলনায় বেশি

হাসান শান্তনু

ঢাকায় বাসরত দিনমজুর, শ্রমিকদের প্রতিদিনের আয় উন্নত শহরগুলোর শ্রমিকের তুলনায় অনেক কম। কারণ, ঢাকায় মজুরির পরিমাণ কম। কম মজুরি দিয়েও তাদেরকে নিত্যপণ্যের চাহিদা মেটাতে খরচ করতে হয় অনেক বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের কোনো শহরে পণ্যের যে দাম, এরচেয়ে বেশি দামে কোনো কোনো পণ্য ঢাকার শ্রমিকদেরকে কিনতে হয়। যুক্তরাষ্ট্র, মালয়েশিয়ার কোনো শ্রমিকের চেয়ে কম বেতন পেয়েও বেশি দামে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কিনে খেতে হয় দেশের দিনমজুরদের।

এমনকি বিশ্ববাজারের চেয়ে দেড় থেকে দ্বিগুণ বেশি দামে পণ্য কিনতে হচ্ছে ঢাকার শ্রমিকদেরকে। দ্রব্যমূল্যের উর্ধগতি, করোনাভাইরাসের ধাক্কায় কাজ কমে যাওয়া ও বেকারত্ব মিলিয়ে তাদের জীবনে চরম নাভিশ্বাস। তাদের সংসার যেন আর চলে না। ‘সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের’ (সিপিডি) তুলনামূলক বিশ্লেষণসহ বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জরিপ সংস্থা ‘মার্সার’র ২০২১ সালের ২২ জুন প্রকাশিত প্রতিবেদন মতে, বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল শহরের তালিকায় সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই ও আবুধাবিকে পেছনে ফেলেছে ঢাকা। ব্যয়বহুল শহরের তালিকায় ঢাকার নিচে রয়েছে বিশ্বের বেশ কয়েকটি বড় ও উন্নত শহর। এগুলোর মধ্যে ব্যাংকক, রোম, ওয়াশিংটন, মুম্বাই, ম্যানিলা, টরন্টো, নয়াদিল্লি, মিউনিখ, ব্রাসেলস, বার্লিন ও মস্কো অন্যতম। ‘কস্ট অব লিভিং সিটি র্যাঙ্কিং-২০২১’ শিরোনামে সংস্থাটি ওই জরিপ প্রকাশ করে।

চলতি সপ্তাহে প্রকাশিত জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) প্রতিবেদন মতে, নিম্ন আয়ের ও গরিব মানুষেরা দৈনন্দিন যে টাকা খরচ করেন, এর বড় অংশই যায় খাদ্যের পেছনে। সেজন্যে খাদ্যের মূল্যস্ফীতি বাড়লে তারা সবচেয়ে বেশি বিপাকে পড়েন। গত দুই বছর ধরে চলমান করোনা মহামারির কারণে খাদ্যসহ সবকিছুর দামই বেড়েছে। এর মধ্যে শুরু হয়েছে রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধ। ফলে তরতর করে সবকিছুর দাম বাড়ছে। কম আয়ের মানুষের জীবনযাপন কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।

দেশীয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান সানেমের হিসাব বলছে, শহরের প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলো গড়ে তাদের মোট খরচের ৬১ দশমিক ৩১ শতাংশ খাদ্যের পেছনে ব্যয় করে। গ্রামীণ প্রান্তিক গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে তা ৬৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ। সরকারি প্রতিষ্ঠান পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এ ক্ষেত্রে যে হিসাব দেয়, তার তুলনায় এ হার অনেক বেশি। বিবিএসের হিসাবে শহর ও গ্রামের পরিবারগুলো তাদের মোট খরচের যথাক্রমে ৪৫ দশমিক ১৭ শতাংশ ও ৫৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ খাদ্যের পেছনে খরচ করে।

গতকাল রোববার প্রকাশিত সিপিডির প্রতিবেদনে বলা হয়, ঢাকায় এখন প্রতি ডজন ডিমের দাম ১১০ টাকা। একই সময়ে যুক্তরাষ্ট্রের ওহাইও অঙ্গরাজ্যের ডেটন শহরে প্রতি ডজন ডিমের দাম ১০৩ টাকা। পণ্য বেশি দামে কিনলেও ঢাকার শ্রমিকের বেতন অনেক কম। যেমন, ঢাকার একজন শ্রমিকের মাসিক গড় বেতন যেখানে মাত্র ১৪৯ ডলার বা ১৩ হাজার টাকা, সেখানে ডেটন শহরে তা ৩ হাজার ৯৫৫ ডলার বা ৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা (১ ডলার‍ = ৮৬ টাকা হিসাবে)। ঢাকার কোনো শ্রমিকের চেয়ে ২৬ গুণ বেশি বেতন পেয়েও তাঁর চেয়ে ৭ টাকা কম দামে ডিম কিনে খাচ্ছেন ডেটন শহরের শ্রমিকরা।

মালয়েশিয়ার সাইবার জায়া শহরে ডিমের দাম আরো কম। সেখানে এখন প্রতি ডজন ডিমের দাম ৮৬ টাকা। ওই শহরের শ্রমিকের মাসিক আয় ৬৬৯ ডলার বা সাড়ে ৫৭ হাজার টাকা, যা ঢাকার কোনে শ্রমিকের চেয়ে চার গুণেরও বেশি। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, স্পেনসহ কয়েকটি দেশের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামের সঙ্গে এ দেশের একই পণ্যের দামের একটি তুলনামূলক বিশ্লেষণ করে সিপিডি। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গেও তুলনা করা হয়। তাতে দেখা গেছে, ক্ষেত্রভেদে দেড় থেকে দুই গুণ বেশি দামে পণ্য কিনতে হচ্ছে বাংলাদেশি শ্রমিককে।

দুই দেশের সঙ্গে পণ্যের দামের তুলনা করতে সময় ধরা হয়েছে ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের ১৪ মার্চ পর্যন্ত। আর বেতন তুলনা করতে সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপের (২০১৭ সাল) তথ্য সংগ্রহ করেছে সিপিডি। সে জরিপে একজন শ্রমিকের বেতনের সঙ্গে অন্য দেশে একই সময়ে করা শ্রমশক্তি জরিপের তথ্যের সমন্বয় করা হয়।

সিপিডির প্রতিবেদনে দেখা যায়, ঢাকায় ১৩ হাজার টাকা বেতন পাওয়া একজন শ্রমিককে এখন প্রতি কেজি পেঁয়াজ কিনতে হচ্ছে ৫৫ টাকা দিয়ে। সার্বিয়ার বেলগ্রেডে ২৯ হাজার টাকা বেতনধারী একজন শ্রমিক প্রতি কেজি পেঁয়াজ কিনছেন ৪১ টাকায়। আজারবাইজানের রাজধানী বাকুর সাড়ে ২৬ হাজার টাকা পাওয়া একজন শ্রমিক একই পরিমাণ পেঁয়াজ কিনছেন ৩৭ টাকায়।

সিপিডি বলছে, বর্তমানে স্পেনের মালাগায় প্রতি লিটার তরল দুধ বিক্রি হচ্ছে ৬৩ টাকা, যা চেক প্রজাতন্ত্রের অস্ত্রাভাতে ৬২ টাকা। অথচ বাংলাদেশে প্রতি লিটার তরল দুধের দাম ৮০ টাকা। স্পেনের মালাগায় একজন শ্রমিকের মাসিক বেতন ১ লাখ ৯১ হাজার টাকা। গত এক বছরে দেশে গরুর মাংস ৫৮০ থেকে ৭০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়। একই সময়ে তা বিশ্ববাজারে বিক্রি হয়েছে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায়।

দেশে যে চিনি ৬৫ থেকে ৭০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে, তা বিশ্ববাজারে পণ্যটির দাম ৩০ থেকে ৪০ টাকায়। একই সময়ে দেশে প্রতি লিটার ভোজ্যতেল ১৪০ থেকে ১৭০ টাকায় বিক্রি হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে তা বিক্রি হয় ১২০ থেকে ১৪০ টাকায়। একইভাবে দেশে প্রতি কেজি মিনিকেট চাল বিক্রি হয়েছে ৬০ থেকে ৬৫ টাকায়। আর থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে সমমানের চাল বিক্রি হয়েছে ৪০ থেকে ৪৫ টাকায়।

সরকারি দপ্তরে দৈনিক ভিত্তিতে কাজ করা শ্রমিকদের মজুরির নতুন হার নির্ধারণ করে দেয় অর্থ মন্ত্রণালয় ২০২০ সালে। সে অনুযায়ী ঢাকা ও চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় এখন থেকে নিয়মিত দক্ষ শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ৬০০ টাকা, যা আগে ছিল ৫০০ টাকা। অনিয়মিত অদক্ষ শ্রমিকদের মজুরি ৫৭৫ টাকা, যা আগে ছিল ৪৭৫ টাকা।

শেয়ার করুন