গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিরা মুক্তিযোদ্ধার সনদ পেতে যে কারণে জালিয়াতির আশ্রয় নেন

হাসান শান্তনু

বীর মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নাম লেখাতে সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দুজন মন্ত্রী, সরকারদলীয় দুজন সংসদ সদস্য গত বছর আবেদন করেন। জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের (জামুকা) কাছে। সচিবসহ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা, মন্ত্রিসভার সদস্য, সংসদ সদস্যরা এ সনদ পেতে আগ্রহী। কেউ কেউ জালিয়াতির পথে পা বাড়াচ্ছেন। গত কয়েক বছর ধরে এমন চিত্র দেখা যাচ্ছে।

বিতর্কের পরও এ প্রবণতা কমছে না। গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের এভাবে আবেদনের চিত্র দেশে আগে তেমন দেখা যায়নি। বিদ্যমান এমন বাস্তবতার মধ্যে আর দুইদিন পর এক লাখ ৭৭ হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধার নামের তালিকা প্রকাশ করবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। শঙ্কার সঙ্গে অনেকে তালিকার জন্য অপেক্ষা করছেন। মন্ত্রণালয়ের কর্মকাণ্ডে অতীত অভিজ্ঞতা তাদের শঙ্কা, উদ্বেগের কারণ।

universel cardiac hospital

বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রশাসনের শীর্ষপদে দায়িত্বরতরা বীর মুক্তিযোদ্ধার সনদ পেতে জালিয়াতির আশ্রয় নেওয়ার অন্যতম কারণ কারো শাস্তি না হওয়া। ২০১০ সালে সরকারি চাকরিতে এক বছরের বাড়তি সুবিধা পাওয়ার বিধান যুক্ত হওয়ার পর বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেতে উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তারা আবেদন করতে থাকেন। মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়া গেলে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় সম্মান পাওয়া যায়। এর সঙ্গে গত কয়েক বছরে মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থিক সুবিধাও সরকার বাড়িয়েছে। বীর মুক্তিযোদ্ধার সনদ জাল প্রমাণিত হওয়ার পরও সরকারের শীর্ষপর্যায়ের কারো বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

২০১৪ সালে ছয় সচিবের মুক্তিযোদ্ধা সনদপত্র ভুয়া প্রমাণিত হলেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। তাদেরকে স্বেচ্ছায় অবসরে যাওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ শিক্ষকের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ উঠে। তাদের বিরুদ্ধেও কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সরকারি চাকরিতে যোগদানের সময় নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা ঘোষণা দেননি, অথচ পরে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে জাল কাগজপত্র জমা দেন, এমন অভিযোগও পাওয়া গিয়েছিল প্রশাসনের শীর্ষস্থানীয় ১৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। তাদেরকে শেষ পর্যন্ত আইনের আওতায় আনা হয়নি।

গত বছরের সেপ্টেম্বরে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক সংসদে জানান, ২০০২ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত অন্তর্ভুক্ত হওয়া দশ হাজার ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার সনদ বাতিল করে সরকার। যাদের মধ্যে বেশিরভাগকেই অন্তর্ভুক্ত করে বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বের চারদলীয় জোট সরকার। সনদ বাতিল করলেও তাদেরকে শাস্তির আওতায় আনেনি বর্তমান সরকার।

বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও যারা ভুয়া সনদ তৈরি করে সরকারি সুযোগ-সুবিধা নেন, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার বিকল্প নেই। এজন্য সনদ বাতিলের পাশাপাশি ভোগ করা সুযোগ-সুবিধার কয়েক গুণ পরিমাণ অর্থ ফেরত নেওয়া, বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদধারীদের তালিকা প্রকাশ করা উচিত। যেন ভবিষ্যতে কেউ বীর মুক্তিযোদ্ধার মতো স্পর্শকাতর ইস্যুতে প্রতারণার আশ্রয় নেওয়ার দুঃসাহস না দেখান।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক বিশেষজ্ঞ ও মন্ত্রণালয়ের কয়েক কর্মকর্তার মতে, শুধু যারা ভুয়া সনদ নেন তাদের নয়, এসব সনদের জন্য যারা সুপারিশ করেন, সবার বিরুদ্ধেই ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। ফৌজদারি আইনের ৪১৬ ধারা অনুযায়ী, মুক্তিযোদ্ধা না হয়ে মুক্তিযোদ্ধার পরিচয় দিলে তা অপরাধ। মিথ্যা তথ্য দেওয়ার জন্য তিন বছর জেল ও মুক্তিযোদ্ধার ভুয়া সনদ দেখিয়ে ভাতাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিলে সাত বছর পর্যন্ত জেল হওয়ার কথা।

মুক্তিযোদ্ধা না হওয়া সত্ত্বেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সনদ নেওয়ায় কর্মকর্তাদের সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ১৯৮৫ অনুযায়ী, অসদাচরণের অভিযোগে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের।

একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির মনে করেন, ‘সনদ বাতিল কোনো শাস্তি নয়। মিথ্যা তথ্য দিয়ে সনদ নেওয়া অপরাধ। ক্ষমতাবান যে কেউ এখন কারসাজি করে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকায় নাম লেখাতে পারছেন, এমন একটা অবস্থা তৈরি হয়েছে। যারা মুক্তিযোদ্ধা না হয়েও প্রভাব খাটিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে নাম অন্তর্ভুক্তির চেষ্টা করেন বা তালিকায় নাম ওঠান, তাদের চিহ্নিত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় আনতে হবে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের একজনও যাতে সরকারের তালিকা থেকে বাদ না যায়, সে উদ্যোগ থাকতে হবে জামুকা ও মন্ত্রণালয়ের।’

অন্যদিকে ২০১৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর ‘একাত্তরের রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও স্বাধীনতাবিরোধী তালিকা প্রকাশ—প্রথম পর্ব’ শিরোনামে দশ হাজার ৭৮৯ জনের নামের একটি তালিকা প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। প্রকাশের পর দেখা যায়, জীবন বাজি রেখে যারা যুদ্ধে গিয়েছিলেন, তাদের অনেকের নাম এ তালিকায় রয়েছে।

আবার কুখ্যাত অনেক রাজাকারের নাম ছিল না তালিকায়। বিষয়টি নিয়ে সারাদেশে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। মুক্তিযুদ্ধের ৪৮ বছর পর প্রকাশিত রাজাকারের তালিকাটি নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক ওঠায় শেষ পর্যন্ত সেটি স্থগিত করে সরকার। মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট থেকে ওই তালিকা সরিয়ে ফেলা হয়।

মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক তখন গণমাধ্যমকে বলেন, ‘রাজাকারের তালিকা যাচাই করে সংশোধনের জন্য আগামী ২৬ মার্চ পর্যন্ত স্থগিত করা হয়েছে।’ ২০২০ সালের ২৬ মার্চ পর্যন্ত বিতর্কিত তালিকাটি স্থগিত করলেও নতুন তালিকা প্রকাশ করেনি মন্ত্রণালয়। তা কবে প্রকাশ হবে, সেটি মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে নিশ্চিত করা হয়নি।

আগামী ২৬ মার্চ অন্তত এক লাখ ৭৭ হাজার বীর মুক্তিযোদ্ধার নামের সমন্বিত তালিকা প্রকাশ করতে যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। যাদের ব্যাপারে জেলা-উপজেলায় তদন্ত কার্যক্রম চলছে, তারা এ তালিকা থেকে আপাতত বাদ থাকবেন।

মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে টানা তৃতীয় মেয়াদ পার করছে সরকার। ভুয়া সনদধারীদের চিহ্নিত করা, প্রতারকদের সাজার আওতায় আনা ও সঠিক মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা তৈরি ও তা কার্যকর করার এখনই সময় বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

শেয়ার করুন