সমকামিতার বিষয়ে প্রশাসন, সমাজ দৃষ্টিভঙ্গি বদলাচ্ছে?

হাসান শান্তনু

নোয়াখালীর এক কিশোরীর সংসার করতে টাঙ্গাইলের আরেক কিশোরীর বাড়িতে ছুটে যাওয়ার ঘটনায় স্থানীয় প্রশাসন ‘ইতিবাচক হস্তক্ষেপ’ করে। প্রচলিত আইন অনুযায়ী কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। প্রশাসন, জনপ্রতিনিধিরা মিলে ‘অপ্রাপ্ত বয়সের দুই কিশোরীকে’ তাদের অভিভাবকের হাতে তুলে দেন। সমকামিতাকে ‘স্বীকৃতি’ দিতে সরকারের প্রতি আর্ন্তজাতিক চাপ আছে।

সমকামিতা প্রসঙ্গে গত কয়েক বছর আগেও ‘একতরফা নেতিবাচক সামাজিক প্রতিক্রিয়া’ দেখা যেত। ওই দুই কিশোরীর ‘প্রেম, ঘরছাড়ার’ প্রশ্নে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে। তাদের ‘সমপ্রেমের নিন্দা, সমর্থন’- দুটিই মিলছে। যদিও ‘সমর্থনের’ স্বর বেশ ‘ক্ষীণ’।

universel cardiac hospital

সামাজিক বিধিনিষেধ, ধর্মীয় মূল্যবোধ, নিজস্ব সংস্কৃতি, আইনি বাধার সঙ্গে ‘সমকামিতার অধিকার’ দাবির ক্ষেত্রে এ দেশে পারিবারিক চাপের মুখেও পড়তে হয় সমকামীদেরকে। তাদের দাবি প্রকাশ্যে তেমন জোরালো নয়। সামাজিক অনুশাসনের প্রভাবে বিষয়টি দেশীয় বাস্তবতায় খুব বেশি ‘স্পর্শকাতর’। প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল, মানবাধিকার রক্ষার সংগঠনগুলো বিষয়টি প্রকাশ্যে এড়িয়ে যায়।

পশ্চিমা সমাজের মতো তো নয়ই, পাশের দেশ ভারত, চীন, জাপানে যেভাবে সমকামিতাকে ‘অধিকার’ হিসেবে দেখা হয়, এ দেশে ঠিক এর উল্টো। এরপরও আর্ন্তজাতিক চাপ আছে ‘স্বীকৃতির’ প্রশ্নে। যা বারবার উপেক্ষা করে আসছে সরকার।

পশ্চিমা দেশ, আর্ন্তজাতিক সংস্থার অনুরোধ গ্রাহ্য না করে জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলে সমকামিদের মৃত্যুদণ্ড বিলোপের প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেয় সরকার। তবে সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে আগের তুলনায় সমকামিদের প্রশ্নে ‘উদারতা’ এসেছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ‘সমকামিদের অধিকার রক্ষায় দেশে পদক্ষেপ নেওয়ার মতো কোনো অবস্থা বিদ্যমান নেই। ধর্মীয় ও সামাজিকগোষ্ঠীর চাপের মুখে তাই আর্ন্তজাতিক ফোরামে দেশে মৃত্যুদণ্ডের বিধান না থাকলেও এর পক্ষেই অবস্থান নিতে হয় সরকারকে। ব্যক্তি পর্যায়ে কেউ কেউ সমকামিতার অধিকারের কথা বললেও দেশে তা বাস্তবে এখনো সম্ভব নয়।’

তথ্যমতে, জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিল সমকামিদের মৃত্যুদণ্ড বিলোপের প্রস্তাব তুলে ২০১৭ সালে। এর বিপক্ষে ভোট দেয় বাংলাদেশ৷ প্রস্তাবটি পাস হয়। সৌদি আরব, ইরান, সুদান, ইয়েমেন, নাইজেরিয়া, সোমালিয়ায় সমকামিতা ‘মৃত্যুদণ্ডতুল্য অপরাধ’৷ এ দেশে ‘অপরাধ’ হলেও তা ‘মৃত্যুদণ্ডযোগ্য’ নয়। দণ্ডবিধির ৩৭৭ ধারা অনুযায়ী, সমকামিতার সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা অন্য কোনো মেয়াদের কারাদণ্ড, যা দশ বছরও হতে পারে৷ আইনে সমকামিতা ‘প্রাকৃতিক নিয়মবিরুদ্ধ যৌনতা’।

জ্যোতির্ময় বড়ুয়া মনে করেন, ‘সমকামিদের মৃত্যুদণ্ড বিলোপের বিপক্ষে বাংলাদেশের ভোট দেওয়ার মানে এই নয় যে, বাংলাদেশ মৃত্যুদণ্ডের পক্ষে অবস্থান নেয়। বা দেশে মৃত্যুদণ্ড চালু হবে৷ দেশের আইনে এর সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড৷ বিপক্ষে ভোট দিয়ে সমকামিতার বিরুদ্ধে সরকার কঠোর অবস্থান প্রকাশ করে৷ ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক কারণে দেশে সমকামিতার পক্ষে অবস্থান নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’

অনুসন্ধান বলছে, ২০১৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর ঢাকার আইসিডিডিআর,বি’তে জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথের আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রথম সমকামিদের সমস্যা, সংকট ও উত্তরণ প্রসঙ্গে তুলে ধরা হয়। অনুষ্ঠানে ‘বয়েজ অব বাংলাদেশ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান ৬০০ ‘আত্মস্বীকৃত সমকামির’ ওপর পরিচালিত জরিপের ফল প্রকাশ করে।

এতে বলা হয়, দেশের সমকামি জনগোষ্ঠী নিজের উপস্থিতি জানান দিতে চায়। তারা চায় সমকামিতাকে যেন সমাজ একটি ‘স্বাভাবিক যৌনপ্রবৃত্তি’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।

জরিপ প্রকাশ অনুষ্ঠানে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথের ওই সময়ের ডিন সাবিনা ফাইয রশিদ সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘দেশের সমকামিগোষ্ঠীর (গে, লেসবিয়ান) প্রতি সমাজের মূল অংশের দৃষ্টিভঙ্গি আগের চেয়ে কিছুটা বদলেছে। পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। এ নিয়ে এখন রাস্তায় শোভাযাত্রা, সেমিনার, বা ডকুমেন্টারি হচ্ছে। সমকামিদের অধিকার নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে এখন, যা আগে ছিল না। এখন মানুষ অনেক খোলামেলাভাবে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করেন।’

ওই জরিপে অংশ নেওয়া সমকামিদের ৫৪ দশমিক ৩ শতাংশ বলে, যৌনপ্রবৃত্তি প্রকাশ হয়ে যেতে পারে এই ভীতি সারাক্ষণ তাদেরকে তাড়িয়ে বেড়ায়। জরিপের অর্ধেকেরও বেশি সমকামি সমাজের চোখে ‘অগ্রহণযোগ্য’ এ যৌনপ্রবৃত্তির কারণে মারাত্মক মানসিক কষ্টে থাকেন। নিজেদের ঘৃণা করেন, বিষন্নতায় ভোগেন, আত্মহত্যা করতে চান। অনুষ্ঠানটিতে সহযোগিতা দেয় ‘রূপবান’ ও ক্রিয়া নামের দুটি সংস্থা।

২০১৫ সালের জুন মাসে সমকামিরা ঢাকায় ঘরোয়াভাবে ‘ধী-এর গল্প’ শিরোনামে একটি কমিক স্ট্রিপ প্রদর্শন করেন৷ এর আগে তারা ‘রূপবান’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন৷ প্রকাশিত হয় সমপ্রেমী কবিতার বই ‘রুপঙতি’৷ ২০১৬ সালের ২৫ এপ্রিল ঢাকার কলাবাগান এলাকায় সমকামিদের অধিকার বিষয়ক পত্রিকা ‘রূপবানের’ সম্পাদক জুলহাজ মান্নান, তাঁর বন্ধু মাহবুব তনয়কে হত্যা করা হয়৷

হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার আগের বছরের ১৪ এপ্রিল তাঁরা ঢাকায় ‘রংধনু’ শোভাযাত্রা বের করেন।জুলহাজ মান্নানের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে তাঁর পরিবারকে চিঠি দেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওই সময়ের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা।

সমকামিদের অধিকারের পক্ষে নোবেল বিজয়ী প্রথম বাংলাদেশি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ২০১২ সালের বক্তব্যের একটি ভিডিও দেশে ‘ভাইরাল’ হয় ২০১৩ সালে। ওই বক্তব্য কেন্দ্র করে তাঁর বিরুদ্ধে ক্ষেপেন দেশের ধর্মীয় নেতারা৷ বিভিন্ন এলাকায় তাঁর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ করে ধর্মপন্থি সংগঠনগুলো।

শেয়ার করুন