ইউক্রেনে রুশ বাহিনী সহজ জয়ের ভাবনায় বেশ ধাক্কা খেয়েছে। তারা এখন নিজেদের শক্তিক্ষয়ের চক্রে পড়েছে, প্রলম্বিত হতে যাচ্ছে যুদ্ধ। যদিও ধ্বংসযজ্ঞ ঘটছে ব্যাপক মাত্রায়। এতে ক্ষতি যা হওয়ার হচ্ছে বেসামরিক নাগরিকদের। এরই মধ্যে বাস্তুচ্যুত হয়েছেন এক কোটি মানুষ। এর মধ্যে দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন ৩৬ লাখ। ইউক্রেন যুদ্ধের এক মাসে এমন মূল্যায়ন বার্তা সংস্থা এএফপির।
গত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেনে সর্বাত্মক সামরিক অভিযান শুরু করে রাশিয়া। প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের নির্দেশে এ অভিযান শুরু হয়। এর প্রতিক্রিয়ায় পশ্চিমারা পুতিন ও তাঁর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদেরসহ দেশটির ওপর তিন হাজারের বেশি অবরোধ দিয়েছে। এসব অবরোধ মূলত আর্থিক। এতে রাশিয়ার অর্থনীতি কিছুটা ধাক্কা খেয়েছে। অন্যদিকে রণাঙ্গনেও তারা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য থেকে অনেকটাই দূরে। শুরুতে যতটা সহজে কিয়েভের পতন ঘটানো সম্ভব হবে বলে মনে করা হচ্ছিল, তা হয়নি।
মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, সাম্প্রতিক দিনগুলোতে বোমাবর্ষণের ব্যাপকতা বেড়েছে। রুশ পদাতিক বাহিনী ও নৌবাহিনী ব্যাপক বোমা ফেলছে। কেননা ইউক্রেনীয়দের প্রতিরোধের মুখে স্থলপথে রুশ বাহিনীর অগ্রগতি থমকে আছে। রাজধানী কিয়েভ থেকে উত্তর–পশ্চিমে ১৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করছেন রুশ সেনারা, পূর্ব দিকে এই দূরত্ব ৩০ কিলোমিটার।
এরই মধ্যে ‘ইউক্রেনে পুতিনের পিঠ ঠেকে গেছে’ বলে মন্তব্য করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। আর মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জন কিরবির ভাষ্য, নৈতিক জোরই শুধু হারাতে বসেননি রুশ সেনারা, তাঁদের খাদ্য ও জ্বালানিতেও টান পড়েছে।
ইউক্রেনে পা রাখার পর থেকেই রাজধানী কিয়েভের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার ওপর সবচেয়ে গুরুত্ব দিয়েছে রুশ বাহিনী। তাদের আশা ছিল, কিয়েভের পতনের সঙ্গে সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির জমানা শেষ হবে।
ফরাসি এক শীর্ষ সামরিক কর্মকর্তার মতে, সমন্বয়ের অভাব দেখা যাচ্ছে। সঠিক নিশানায় হামলাও করতে পারছে না রুশ বাহিনী। তাঁর কথায়, এটা রাশিয়ার নেতৃত্ব ও নিয়ন্ত্রণনীতির সত্যিকারের ঘাটতি।
রণাঙ্গন পরিস্থিতি
কতসংখ্যক সেনা এরই মধ্যে নিহত হয়েছেন, তা নিশ্চিত হওয়া কঠিন। তবে পেন্টাগনের ধারণা, প্রথম মাসে সাত হাজারের মতো রুশ সেনার প্রাণ গেছে।
জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ গতকাল বুধবার বলেন, ধ্বংসযজ্ঞ চালানো সত্ত্বেও পুতিনের অভিযান আটকা পড়েছে।
প্রাণহানির প্রশ্নে কিয়েভের ভাষ্য হলো, ১২ মার্চ পর্যন্ত তাদের ১ হাজার ৩০০ সেনা মারা গেছেন। তবে পর্যবেক্ষকেরা মনে করেন, সত্যিকারের সংখ্যার চেয়ে অনেকটাই কম করে বলা হচ্ছে।
সামনে এগোতে না পেরে রুশ সেনারা আশপাশের লোকালয় অবরোধ করছেন। ধারণা করা হচ্ছে, ইউক্রেনের জনগণের মনোবলে আঘাত করতে তাঁরা এ কৌশল বেছে নিয়েছেন। এর মধ্যে প্রায় এক কোটি ইউক্রেনীয় বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। জাতিসংঘের হিসাবে, প্রায় ৩৬ লাখ মানুষ দেশ ছেড়েছেন।
যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমাদের সামরিক জোট ন্যাটোর ঘনিষ্ঠ একটি সূত্র বলেছে, ‘রাশিয়ার পদাতিক বাহিনী যত গাড্ডায় পড়বে, বিমানবাহিনী তত বেশি আগ্রাসী হবে এবং তারা যত্রতত্র ক্ষমতা ব্যবহার করবে।’
এক মাসের অভিযানে ইউক্রেনের দক্ষিণাঞ্চলের খেরসনের একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকা শুধু দখলে নিতে পেরেছে রুশ বাহিনী। মারিউপোল অবরুদ্ধ করলেও দখল নিতে পারেনি। উত্তরাঞ্চলীয় শহর খারকিভে টানা বোমা হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। দক্ষিণ ও পূর্ব দিক থেকে শহরটির দিকে ধীরে এগোনোর জোর চেষ্টা চালাচ্ছেন রুশ সেনারা। মিকোলাইভে গোলা ছুড়ছে পদাতিক বাহিনী।
ধ্বংসযজ্ঞ
এখন পর্যন্ত যুদ্ধ বন্ধে কোনো অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে না। রাশিয়ার অভিযোগ, যুক্তরাষ্ট্রের প্ররোচনায় যুদ্ধ বন্ধে পদক্ষেপ নিচ্ছে না ইউক্রেন। ইউক্রেন দায়ী করছে রুশ প্রেসিডেন্টকে।
পশ্চিমা বিশ্লেষকেরা বলছেন, যদি অস্ত্রবিরতিতে রাজিও হয় মস্কো, তবে তা হতে পারে নিজেদের জন্য সময় বের করে পুনরায় শক্তি সঞ্চয় করা লক্ষ্যে।
মারিউপোলে দুই লাখের বেশি মানুষ আটকা পড়ে আছে। শহরটির বড় অংশ পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে। খাদ্যসংকটে পড়েছে মানুষ। পানি নেই। বন্ধ বিদ্যুতের সরবরাহ। বন্দরনগরীটি কৌশলগতভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ রাশিয়ার কাছে। এটি ক্রিমিয়া ও দনবাসের মধ্যে সংযোগের কাজ করবে। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়ার দখল নেয় রাশিয়া আর রাশিয়াপন্থী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দখলে রয়েছে দনবাস। সামরিক অভিযান শুরুর আগে দনবাসের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেয় মস্কো।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক থিঙ্কট্যাংক সিএনএনের মাইকেল কফম্যান লিখেছেন, ‘যদি শক্তিক্ষয়ের চক্রে পড়ে রুশ বাহিনী, তবে যুদ্ধের পরের পর্ব হয়ে উঠতে পারে আরও বেশি কুৎসিত। রুশ বাহিনী বেসামরিক এলাকায় ব্যাপক বোমাবর্ষণ করবে। তারা হয়তো তাদের পারদর্শিতার ঘাটতি ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞের মাধ্যমে ঢাকার চেষ্টা চালাবে।’
যুক্তরাজ্যভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের উইলিয়াম আলবার্কও মনে করেন, আলোচনার মাধ্যমে যদি কোনো সমঝোতায় পৌঁছানো না যায়, তাহলে শক্তিক্ষয়ের চক্রে পড়বে রুশ বাহিনী। যেকোনো মূল্যে কিয়েভের অস্ত্রবিরতি মেনে নেওয়ার বিরোধিতা করেন তিনি।
তার ভাষ্য, ‘সবচেয়ে খারাপ দিক হলো ইউক্রেনীয় জনগণকে দুর্ভোগ থেকে রক্ষায় যুদ্ধ বন্ধে পশ্চিমাদের আকাঙ্ক্ষা রুশদের জন্য সহায়ক হবে। তারা একে সুযোগ হিসেবে নিতে পারে। অস্ত্রবিরতি কাজে লাগিয়ে নিজেদের শক্তি সঞ্চয় করবে তারা।’