স্বাধীনতা দিবস : স্বপ্নের পূর্ণতা এখনও বাকি

আহমদ রফিক

আহমদ রফিক
আহমদ রফিক। ফাইল ছবি

১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ২০২২ সালের মার্চ। সময়ের ব্যবধানে পাঁচ দশকেরও বেশি। গত বছর আমরা স্বাধীনতা ও বিজয়ের পঞ্চাশ বছর ছুঁয়েছি। সাড়ম্বরে ওই মহান অধ্যায়ের সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপিত হয়েছে। একই সঙ্গে সামনে এসেছে পুরোনো কিছু প্রশ্ন নতুন করে। পঞ্চাশ বছর তো কম সময় নয় একটি দেশ ও জাতির জন্য। আমাদের স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছরের পথ মসৃণ ছিল না। স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় কতিপয় বিপথগামী সেনা কর্মকর্তা, সদস্য ও রাজনৈতিক যোগসাজশে ঘটে বর্বরোচিত ঘটনা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। এরপর থেকেই শুরু হয় পশ্চাৎযাত্রা। কতরকম অনাকাঙ্ক্ষিত-অপ্রত্যাশিত ঘটনা দফায় দফায় ঘটিয়েছেন তৎকালীন শাসকরা নিজেদের লাভের হিসাব কষে। এর মাশুল গুনতে হয়েছে সমগ্র জাতিকে। সচেতন মানুষ মাত্রই এসব জানেন। দীর্ঘকাল পর অন্ধকার কেটে স্বাধীন দেশটি আবার ফিরে আসে তার স্বপ্নের পথে। তার পরও স্বপ্ন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে কখনও কখনও প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতার যে দেয়াল দাঁড়ায়, তা প্রশ্নবোধক।

বিগত পঞ্চাশ বছরে নানা প্রতিকূলতা-প্রতিবন্ধকতা ডিঙিয়েও বিশ্বদরবারে আমরা একটা অবস্থান করে নিতে পেরেছি অন্যরকমভাবে। জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের ভূমিকা উল্লেখযোগ্য। একাত্তরে আমরা যেমন শরণার্থী হয়েছিলাম, সেরকমভাবে নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত-নিপীড়িত-নির্যাতিত সর্বহারা লাখ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়ে আমরা নন্দিত। মানবতার তাগিদে বাংলাদেশ স্থাপন করেছে অনন্য দৃষ্টান্ত। বিশ্বের নানা সূচকে আমাদের অগ্রগতি উল্লেখযোগ্য। অর্থনীতির আকার বড় হয়েছে, অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে, পদ্মা সেতুর মতো এত বড় কর্মযজ্ঞ নিজস্ব অর্থায়নে সম্পন্নের পথে। আরও অনেক মেগা প্রকল্প চলমান। শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতে নানা অনিয়ম সত্ত্বেও উন্নয়ন যেটুকু হয়েছে, তাও কম নয়। অর্থাৎ আমাদের অর্জনের খতিয়ান মোটা দাগে বলতে গেলে অনেক বিস্তৃত। কিন্তু এখনও যেসব বিষয় অনার্জিত রয়ে গেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে প্রশ্ন দাঁড়ায়- এর দায় কার। দায় কমবেশি সবার, তবে সবচেয়ে বড় দায় রাজনীতি-সংশ্নিষ্টদের। তাদের অনেকেরই অঙ্গীকার পালনে অনেক ক্ষেত্রেই ব্যর্থতা ও স্ববিরোধিতা স্পষ্ট। একাত্তরের পূর্বাপর আমাদের রাজনৈতিক অর্জন কতটা- এর ব্যাখ্যা-বিশ্নেষণ নতুন করে নিষ্প্রয়োজন। অনেক অর্জনের বিসর্জন ঘটেছে এও সত্য। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সুনির্দিষ্ট কিছু অঙ্গীকার-প্রত্যয় ছিল। অসাম্প্রদায়িকতা, সাম্য, ন্যায়বিচার, আইনের শাসন, গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ, মানুষের অধিকার সব ক্ষেত্রে নিশ্চিতকরণ- এগুলো ছিল অন্যতম। তবে আজও আমরা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারিনি। বাহাত্তরের সংবিধানে যে বিষয়গুলো ছিল, জনঅধিকার কিংবা স্বার্থের পরিপূরক সেগুলোতে দফায় দফায় আঘাত করলেন পঁচাত্তর-পরবর্তী শাসকরা নিজেদের স্বার্থে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমন আঘাত এলো, যা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মূলে কুঠারাঘাত। আজও সেই সংবিধানের পূর্ণ আদিরূপ ফিরে পাওয়া যায়নি জনদাবি সত্ত্বেও। কোনো উন্নয়নই টেকসই হবে না যদি দুর্নীতি, রাজনৈতিক কদাচার, সন্ত্রাস, রাজনৈতিক অস্বচ্ছতার মতো আরও অনেক নেতিবাচকতার নিরসন না ঘটিয়ে শুধু অবিরত উচ্চারণসর্বস্ব অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়। দুর্নীতির ব্যাপারে সরকারের ‘শূন্য সহিষ্ণুতা’র অঙ্গীকার সত্ত্বেও প্রায়ই সংবাদমাধ্যমে যেসব চিত্র উঠে আসছে, তা প্রশ্নবোধকই বটে। এত উন্নয়ন সত্ত্বেও বৈষম্যের ছায়া কেন বিস্তৃত হচ্ছে- এ প্রশ্নের উত্তরও জটিল নয়।

শুধু একজন বা গোটা কয়েকজনের সদিচ্ছায়, আন্তরিকতায় একটি দেশ ও জাতির কল্যাণ নিশ্চিত করে কাঙ্ক্ষিত সমাজ গঠনের প্রত্যাশা পূরণ সহজ বিষয় নয়। তবে রাজনৈতিক নেতৃত্বের দূরদর্শিতা একই সঙ্গে রাজনৈতিক স্বচ্ছতার নিশ্চয়তা অত্যন্ত জরুরি। এখন আরও জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে উন্নয়ন পরিকল্পনাকে মজবুত ও টেকসই করতে দুর্নীতি থেকে শুরু করে সর্বপ্রকার দূষণের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা এবং দীর্ঘস্থায়ী যথাযথ অভিযানের মাধ্যমে দুর্নীতি দূষণ-অনৈতিকতার অবসান ঘটানো। গণপ্রজাতন্ত্রের সুনাম রক্ষায় সুশাসন অত্যাবশ্যক ও অপরিহার্য, যাতে সমাজের নেতিবাচক উপাদানগুলো আর বাড়তে না পারে। যে স্বর অন্তরে ধারণ করে ‘স্বাধীন বাংলার জন্য লড়াই’ পাকিস্তানের পূর্ব-পশ্চিমের আর্থসামাজিক ব্যবধান ও বৈষম্য দূর করতে ঘটেছিল একাত্তরে, এর সমাধান ঘটলেও (সমাজ ও রাজনীতিতে) গোটা জাতি, বিশেষ করে নিম্নবিত্ত শ্রেণি ও নিম্নবর্গীয় জনতা সেই অমৃতের ভোগী হতে পারেনি। তাই স্বাধীন বাংলাদেশে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির খতিয়ান নিতে গেলে স্বীকার করতে হয় উন্নয়ন ঠিকই ঘটেছে, তবে এ ক্ষেত্রে শ্রেণিবিশেষের বিষয়টি অধিক দৃষ্টিগ্রাহ্য। দেশের সব মানুষের অধিকারের মাঠ সমতল করা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অঙ্গীকার-প্রত্যয়েরও অন্যতম বিষয় ছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা এখনও এ থেকে অনেক দূরে।

‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ এর ‘গণ’ তার খুদকুঁড়ো পেয়েই মনে হয় সন্তুষ্ট থাকছে। একটি শ্রেণির উন্নতি এতটাই ঘটেছে, যা পাকিস্তানের কথিত বাইশ পরিবারকেও ছাড়িয়ে গেছে। এমনটি তো একাত্তরে প্রত্যাশিত ছিল না। একাত্তরের সহমর্মিতার কালে আমরা কি ভাবতে পেরেছিলাম, আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশে দুর্নীতি, মাদক-বাণিজ্য, মানব পাচার, মুদ্রা পাচার, অসাম্য ইত্যাদি ফিরে ফিরে সংবাদমাধ্যমে বড় জায়গা দখল করে নেবে? আর প্রশ্নের পর প্রশ্নের জন্ম দেবে। আমরা জানি, বিলম্বিত বিচার এবং অনেক ক্ষেত্রেই বিচারহীনতার কথা, যা একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নীতির সঙ্গে মেলে না। নারী নিগ্রহের চিত্র প্রশ্ন দাঁড় করায়- এসবই কি সামাজিক অবক্ষয়ের পরিচায়ক নয়? আজকের বাস্তবতায় সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ দুর্নীতিরোধ ও সুবিচার-সুশাসন শতভাগ নিশ্চিত করা। সুশাসন নিশ্চিত হলে অনেক প্রত্যাশাই পূর্ণতা পাবে। গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণে যেসব বিষয় করণীয় এর গুরুত্ব উচ্চারিত হয় বটে, কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই এর বাস্তব প্রতিফলন দেখা যায় না।

আমরা এখন দেখতে চাই অঙ্গীকারের বাস্তবায়ন। একাত্তর আমাদের যূথবদ্ধ করেছিল, কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশে আমরা বিভক্ত হয়ে গেলাম। প্রতিক্রিয়াশীলতার যে ছায়া একাত্তর দূর করেছিল, এরই আবার বিস্তার ঘটল স্বাধীন দেশে। একাত্তরে সর্বজনের কাঁধে ভর করে যে জনক্ষোভের শিখা জ্বলে উঠেছিল, তারপর স্বাধীনতা অর্জনে যে স্বপ্ন আরও পুষ্ট হয়েছিল, সেই স্বপ্নের স্বাধীনতার চরিত্রবদল ঘটল কেন? মানুষ জীবনযাপনের প্রাথমিক ও মৌলিক প্রয়োজনগুলো সহজে মেটাতে চায়। সেখানে ব্যর্থতা তারা মেনে নেয় না। অসহায় মানুষ কি কেবল পরীক্ষা দিয়েই চলবে? সর্বাগ্রে শুদ্ধ রাজনীতির পথ মসৃণ করা ছাড়া জিইয়ে থাকা ব্যাধিগুলো দূর করা যাবে না। ২৫ ও ২৬ মার্চের রাজনৈতিক ঘটনাবলির বিশদ বিশ্নেষণ আমাদের বর্তমান দূষিত রাজনীতির উৎস সন্ধানে বিশেষ জরুরি বলে মনে করি। আমাদের নীতিনির্ধারকদের আত্মস্থ করতে অনুরোধ জানাই, একাত্তরের প্রতিরোধ সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে তৃণমূল মানুষের ভূমিকার কথা। তাদের ভূমিকা-অবদান মর্মে নিয়ে রাজনীতিকরা বুলিসর্বস্ব অঙ্গীকার-প্রতিশ্রুতি বাদ দিয়ে বিলম্বে হলেও নতুন প্রত্যয়ে প্রত্যয়ী হোন। একই সঙ্গে ইতিহাসবিদ ও গবেষকদেরও তৃণমূলের মানুষের ভূমিকা-অবদান তুলে এনে প্রজন্মের সামনে উপস্থাপনে গভীর মনোযোগে কাজ করা জরুরি বলে মনে করি।

মানুষের অধিকারের প্রশ্নে অবশ্যই থাকতে হবে দৃঢ়। আমাদের করণীয় সবকিছু নির্দিষ্ট হয়ে গিয়েছিল একাত্তর পর্বে কিংবা তারও আগে। আমরা যেন সেই পথটাই অনুসরণ করি। শুধু গণতন্ত্র গণতন্ত্র বলে চিৎকার করলেই হবে না, এর শর্ত পূরণ জরুরি। প্রকৃত গণতন্ত্র বিকশিত হলে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছার কাজটা সহজ হবে।

লেখক : ভাষাসংগ্রামী, রবীন্দ্র-গবেষক, কবি ও প্রাবন্ধিক

শেয়ার করুন