‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধা’ প্রমাণেই পঞ্চাশ বছর, স্বীকৃতি কবে?

নিজস্ব প্রতিবেদক

অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী ও বয়োবৃদ্ধ বাবা-মাকে রেখে দেশমাতৃকার জন্য সম্মুখসমরে জীবন দিয়েছেন সিপাহী মো. মমিনুল হক। তাঁর এ আত্মত্যাগের প্রমাণ দিতে আর তথ্য অনুসন্ধানে লেগেছে ৫০ বছর। স্বাধীনতার ৫১তম বছরে এসে রাষ্ট্র খুঁজে পেয়েছে— মমিনুল হকের বীরত্বের তথ্যপ্রমাণ। তাকে ‘শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা’ স্বীকৃতি দিয়ে গেজেট প্রকাশের জন্য জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলকে (জামুকা) নির্দেশও দিয়েছে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়। কিন্তু এখনো মেলেনি সেই স্বীকৃতি। এই অবস্থায় শহীদ পরিবারের প্রশ্ন, তথ্যপ্রমাণ দিতে লেগেছে ৫০ বছর, স্বীকৃতি পেতে কত বছর লাগবে?

অনুসন্ধানে জানা গেছে, চাঁদপুর জেলার কচুয়ার সাহারপাড় গ্রামের সন্তান সিপাহী মো. মমিনুল হক বিমানবাহিনীর চতুর্থ এমওডিসি (আইডি নম্বর ৮৮০৭৯২৩) পিএএফে কর্মরত ছিলেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমানের আহ্বানে পাকিস্তানি বিমানবাহিনী থেকে পালিয়ে দেশে এসে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা থানার সালদা নদীর পাড়ে সম্মুখযুদ্ধে পাকিস্তানি হানাদারদের গুলিতে শহীদ হন মমিনুল হক। কোল্লা পাথর নামক জায়গায় তাকে দাফন করা হয়। তার কমান্ডার ছিলেন মেজর এটিএম হায়দার।

universel cardiac hospital

যদিও এ খবর জানতেন না শহীদ মমিনুল হকের সন্তানসম্ভবা স্ত্রী ও বয়স্ক বাবা-মা। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরও মমিনুল হকের ফেরার অপেক্ষায় ছিলেন তারা। পরে তৎকালীন রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি চিঠি পাঠান মমিনুল হকের বাবা ওয়াহেদ আলীর কাছে। যেটি ছিল তার ছেলের যুদ্ধের ময়দানে শহীদ হওয়ার স্বীকৃতি বা শোকবার্তা। চিঠির সঙ্গে ছিল দুই হাজার টাকার একটি চেক। চাঁদপুর জেলা (তৎকালীন মহকুমা) প্রশাসক আইয়ুব কাদেরীর কাছ থেকে শহীদ মমিনুল হকের বাবা ওয়াহেদ আলী ওই চিঠি ও চেক (নম্বর ডিই-এ ২৯১৫৭৬, তারিখ ০১-০৮-১৯৭২ ইং) নেন।

এ চেক নেওয়ার জন্য চাঁদপুর জেলা প্রশাসক আইয়ুব কাদেরী স্বাক্ষরিত একটি চিঠিও মমিনুল হকের বাবা ওয়াহেদ আলীকে দেওয়া হয়। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থেকে মমিনুলের স্ত্রীর পেনশনের জন্য দুই কপি ছবি চেয়ে রেকর্ড অফিস থেকে টেলিগ্রামে বার্তাও দেওয়া হয়।

এমওডিসি সেন্টার অ্যান্ড রেকর্ডসের রেজিস্টারে সিপাহী মো. মুমিনুল হকের কাগজপত্র

এছাড়া রেকর্ড অফিসের অনেক প্রমাণাদি থাকলেও শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে রাষ্ট্রের তালিকায় নাম নেই মমিনুল হকের। মাতৃগর্ভে রেখে যাওয়া শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এমরান হোসেন পাচ্ছেন না সেই স্বীকৃতির খোঁজ।

শহীদ এ মুক্তিযোদ্ধার সন্তান এমরান হোসেন তার বাবার কর্মক্ষেত্র, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ বিভিন্ন জায়গায় ধর্ণা দিয়েও ফল পাননি। অবশেষে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের হস্তক্ষেপে স্বাধীনতার ৫০ বছর পর এতটুকু প্রমাণ করা গেছে, মো. মমিনুল হক সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন।

মানবাধিকার কমিশন এরই মধ্যে সিপাহী মো. মমিনুল হককে ‘শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার যথাযথ ব্যবস্থা নিয়ে চলতি বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারির মধ্যে অবহিত করতে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করেছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলকে শহীদ গেজেট করার জন্য বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে ২ ফেব্রুয়ারি নির্দেশ দেয় মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয়। কিন্তু এখনো সেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

মানবাধিকার কমিশন বরাবর শহীদ মমিনুল হকের ছেলে এমরান হোসেনের পাঠানো চিঠি (বাঁয়ে), শহীদের বাবা ওয়াহেদ আলীকে বঙ্গবন্ধুর পাঠানো চিঠি ডানে

চিঠিতে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় লিখেছে, ‘অভিযোগকারী এমরান হোসেনের বাবা শহীদ সিপাহী মো. মমিনুল হক, গ্রাম-শাহাড়পাড় (বড় বাড়ি), ডাকঘর-রহিমানগর, উপজেলা-কচুয়া, জেলা-চাঁদপুর এর শহীদ গেজেট করার জন্য সেনাবাহিনীর তদন্ত প্রতিবেদনপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে আবেদনের সত্যতা রয়েছে এবং সিপাহী (জিডি) নম্বর-৮৮০৭৯২৩ মৃত মমিনুল হককে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে।’

জামুকাকে দেওয়া চিঠিতে মন্ত্রণালয় আরও বলেছে, একজন প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধাকে খুঁজে বের করে তাকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সুপারিশ করার কাজটি নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। শহীদ সিপাহী মো. মমিনুল হকের শহীদ গেজেট করার জন্য বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে নির্দেশক্রমে পত্রটি পাঠানো হলো।

শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা মমিনুল হকের ছেলে এমরান হোসেন

এ বিষয়ে শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা সিপাহী মো. মমিনুল হকের সন্তান এমরান হোসেন বলেন, এতদিন আমি জামুকায় গেলে তারা আমাকে দূর দূর করে তাড়িয়ে দিত। বলতো, আপনার বাবা যেখানে চাকরি করতেন তারা প্রত্যয়ন করলে স্বীকৃতি পাবেন। আমাদের এখানে আপনাদের কাজ নেই।’ দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর হলেও বাবার কর্মস্থল থেকে প্রত্যয়ন করেছে এবং মানবাধিকার কমিশনও লিখেছে; যার পরিপ্রেক্ষিতে স্বীকৃতি দিতে জামুকাকে মন্ত্রণালয় থেকেও চিঠি দিয়েছে। এখন জামুকার সেই কর্তারাই আমাকে ধমকাচ্ছেন, ‘আপনাকে কে বলেছে মানবাধিকার কমিশনে যেতে?

আক্ষেপের সুরে এমরানের প্রশ্ন, আমাকে মাতৃগর্ভে রেখেই বাবা দেশমাতৃকার জন্য শহীদ হলেন। অথচ ৫০ বছর লাগলো স্বাধীনতাযুদ্ধে তার এ অবদান প্রমাণ করতে। আর কত বছর লাগবে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি (গেজেট) পেতে?

শেয়ার করুন