গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি কতদূর?

বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

২৫ মার্চ : জাতীয় গণহত্যা দিবস
ফাইল ছবি

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি নরপিশাচরা যখন বাংলাদেশে গণহত্যার উল্লাসে মত্ত, তখন গোটা পৃথিবী মেনে নিয়েছিল, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নাৎসি বাহিনীর গণহত্যার পর এটি বিশ্বালয়ে জঘন্যতম গণহত্যা। বহু দেশের সরকার প্রকাশ্যে পাকিস্তানিদের সমালোচনা না করলেও, জনগণ থেমে ছিল না।

১৯৪৮ সালে জাতিসংঘের উদ্যোগে যে গণহত্যা নিবারণ এবং শাস্তির জন্য কনভেনশন প্রণীত হয়েছিল, যেটি ছিল সদ্য প্রতিষ্ঠিত জাতিসংঘের উদ্যোগে মানবাধিকারসংক্রান্ত প্রথম আন্তর্জাতিক চুক্তি, বাংলাদেশে পাকিস্তানি সৈন্য এবং তাদের স্থানীয় দোসরদের দ্বারা সংঘটিত গণহত্যা সম্পূর্ণরূপে তার সংজ্ঞাভুক্ত। সরকারি হিসাবে পাকিস্তানি হায়নাদের বুলেটে-কামানে শহিদ হওয়া লোকের সংখ্যা ৩০ লাখ হলেও গণহত্যা কনভেনশনের সংজ্ঞা অনুযায়ী বাংলাদেশে গণহত্যার সংখ্যা অনেক বেশি। কেননা এই সংজ্ঞায় শুধু নিহতদেরই কথা বলা হয়নি, বরং মানসিক এবং শারীরিকভাবে নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকারদের কথা এবং আক্রান্ত জনগোষ্ঠীর মানুষের ওপর হেন আক্রমণের কথা রয়েছে, যা সেই জনগোষ্ঠীকে ধ্বংস করার প্রয়াস।

universel cardiac hospital

সে অর্থে ধর্ষিতা নারী, যাদের সংখ্যা ৫ লাখের কম ছিল না বলে স্বনামধন্য গবেষক এবং বর্তমানে গণহত্যা জাদুঘরের ট্রাস্টি বোর্ডের প্রধান, অধ্যাপক মুনতাসির মামুনের গবেষণায় প্রকাশ পেয়েছে এবং ড. ডেভিড নামে অস্ট্রেলিয়ার যে চিকিত্সককে বিশ্ব স্বাস্হ্য সংস্থা ১৯৭২ সালে ধর্ষণের ফলে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে যাওয়া নারীর সংকট নিরসনের জন্য বাংলাদেশে পাঠিয়েছিলেন তিনি ধর্ষিতা নারীর সংখ্যা ৪ লাখের নিচে ছিল না বলে মত দিয়েছেন, যাদের মধ্যে তার জানামতে ন্যূনতম ৫ হাজার জন আত্মহনন করেছেন, বহু হাজার জন ভারত চলে গেছেন। এই সংখ্যা এবং পশ্চিম বাংলায় যাত্রাপথে এবং আশ্রয়শিবিরে কলেরা, আমাশয়, ম্যালেরিয়া ও ক্লান্তিজনিত কারণে যে লক্ষাধিক লোকের মৃতু্য হয়েছিল, তা যোগ করলে গণহত্যার শিকার হয়েছিল ৩০ লাখের চেয়ে বেশি।

গণহত্যা কনভেনশনের জের ধরে জাতিসংঘ ৯ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস বলে নির্ধারণ করেছে। কারণ ১৯৪৮-এর সেই দিনেই জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ এই কনভেনশনের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, যেটি সেই বছরই ১০ ডিসেম্বর কনভেনশনের রূপ লাভ করেছিল।

প্রথম মহাযুদ্ধকালে ১৯১৫ সালে তুরস্কের অটোমান সাম্রাজ্য আর্মেনিয়ান সম্প্রদায়ের ওপর যে গণহত্যা চালিয়েছিল, যার ফলে ৬ লাখ আর্মেনিয়ান নিহত হয়েছিল, এ পর্যন্ত সে গণহত্যাই মোটামুটি আন্তর্জাতিক গণহত্যা হিসাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ২০২২ সাল পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, কানাডা, ব্রাজিল, গ্রিস, লিবিয়া, লেবানন, নেদারল্যান্ডস, সিরিয়া, মিশর, পোল্যান্ড, সু্ইডেনসহ মোট ৩৩টি দেশ আর্মেনিয়ার গণহত্যা স্বীকার করায়, এটি আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়। ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৯টি অঙ্গরাজ্য আর্মেনিয়ার গণহত্যা স্বীকার করেছে।

এ ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে, ১৯১৫ সালে আর্মেনিয়ান গণহত্যা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবিদার। কিন্তু বাংলাদেশে পাকিস্তানি অসুর এবং তাদের স্হানীয় অনুগামী হায়েনারা যে গণহত্যা ঘটিয়েছিল, সেটিও যে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির দাবিদার, সে কথা খণ্ডন করার পেছনে কোনো যুক্তি থাকতে পারে না। এই স্বীকৃতি ’৭০-এর দশকেই পাওয়ার কথা ছিল, বাংলাদেশের গণহত্যার ঘটনা যখন বিশ্বজনতার মুখে মুখে। কিন্তু চীন, যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশের পাকিস্তান প্রীতির কারণে তা সম্ভব হয়নি। এছাড়াও বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানপ্রেমীরা হত্যা করার পর আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া আরো সুদূরপরাহত হয়ে যায়। এরপর ২৫ বছর চলে পাকিস্তানি দোসরদের রাজত্ব, যারা আন্তর্জাতিক গণহত্যা স্বীকৃতির কথা তাদের মনোজগতেও রাখেনি, বরং যাদের নীতি ছিল তাদের পাকিস্তানি প্রভুদের আজ্ঞা বহন করা।

আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির পূর্বে আমাদের নিজ দেশের স্বীকৃতি ছিল অপরিহার্য, আর সেটিও করা হয়নি পাকিস্তানি প্রেতাত্মাদের শাসন আমলে। অবশ্য ২০১৭ সালে বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া সরকার ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করেন, যেটি আদায়ের পেছনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল ’৭১-এর ঘাতক দালান নিমূ‌র্ল কমিটি এবং সহায়তায় ছিলেন বিখ্যাত মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, শীর্ষ আওয়ামী লীগ নেতা জনাব তোফায়েল আহমেদ। জাতীয়ভাবে এই স্বীকৃতি আমাদের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির পথ খুলে দিলেও এখনো বড় বাধা হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে পাকিস্তান এবং এই মুহূর্তে তার বিশিষ্ট বন্ধুরাষ্ট্র চীন এবং সম্ভবত তুরস্ক। মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে এরই মধ্যে চেতনা বোধের এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের প্রশ্নে বিস্তর পরিবর্তন সাধিত হওয়ায় এদের অধিকাংশ দেশই আমাদের দাবির সমর্থনে আসবে বলে আশা করা যায়, যা অবশ্য নির্ভর করছে এ বিষয়ে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষ লবিংয়ের ওপর। তবে যে যুক্তরাষ্ট্র ’৭১-এ আমাদের চরম বিরুদ্ধে ছিল, ২০২২-এ তার মধ্যে ১৬০ ডিগ্রি পরিবর্তনের ফলে সে দেশটি এরই মধ্যে ’৭১ সালে আমাদের দেশে পাকিস্তান কতৃ‌র্ক চালিত গণহত্যার স্বীকৃতি দিতে অনেকখানি এগিয়ে গেছে।

মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সবচেয়ে বড় বন্ধু, ভারত, যার সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক রক্তের অক্ষরে লেখা, এরই মধ্যে নিরাপত্তা পরিষদে, বর্তমানে যে দেশটি পরিষদের অস্হায়ী সদস্য, ’৭১-এ বাংলাদেশে গণহত্যার স্বীকৃতি এবং পাকিস্তানের বিচারের দাবি তুলেছেন, যা থেকে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার প্রত্যাশা বহু গুণে বেড়ে গেছে। কিন্তু একটি গুরুত্বপূর্ণ পরাশক্তি হিসেবে গত কয়েক বছরে উদিত হওয়া চীনের অবস্হান সম্পূর্ণ অপরিবর্তিত রয়েছে বিধায়, সে দেশটি আমাদের বিরুদ্ধে থাকবে এবং পাকিস্তানকে নাখোশ করবে না, এমন ইঙ্গিত স্পষ্ট। বলা হয় চীনের প্রেরিত বুলেট দিয়েই ১৯৭১-এ আমাদের ৩০ লাখ শহিদকে হত্যা করা হয়েছিল। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ঘোর বিরোধী এই দেশটি যে আমাদের দেশের পাকিস্তানি গণহত্যায় বিশেষ ভূমিকা রেখেছিল তা আর নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে না। এই দাবিটি যে ১০০ ভাগ সত্য, ইতিহাসই তার প্রমাণ। তাছাড়া চীন তার দেশে উইঘুর সম্প্রদায়ের লোকদের ওপর যে গণহত্যা এবং কঠোর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে, সে ঘটনা আড়াল করার জন্যও দেশটি গণহত্যাসংক্রান্ত কোনো আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টায় সমর্থন দেবে না। চীন আমাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব এগিয়ে নেওয়ার জন্য যত কথাই বলুক না কেন, নীতির প্রশ্নে পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় বন্ধু এ দেশটি অন্তত অদূর ভবিষ্যতে আমাদের পাশে থাকবে না, এটা বলাই ঠিক।

গত কয়েক বছর চীন মিয়ানমারের পক্ষে নিরাপত্তা পরিষদে ভেটো না দিলে, নিরাপত্তা পরিষদেই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হতো, এ কথাগুলো আমাদের মনে রাখতে হবে। একই কথা গণহত্যাকারী দেশ পাকিস্তানের বেলায়ও প্রযোজ্য। সে দেশটিও, কী কারণে জানি না, বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব বাড়ানোর জন্য পাগল হয়ে গেলেও ’৭১-এর গণহত্যা, ধর্ষণ, ধ্বংস ইত্যাদির জন্য ক্ষমা চাইতে নারাজ। শুধু তা-ই নয়, তাদের গোয়েন্দা সংস্হা আইএসআই বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়া সরকারকে হটানোর জন্য সম্ভাব্য সব কিছুই করে যাচ্ছে, অনেক সময়ে চীনকে ব্যবহার করে। এ ব্যাপারে ঢাকায় তাদের দূতাবাস যে তত্পর তার বহু প্রমাণ গত কয়েক বছরে হাতেনাতে ধরা পড়েছে। বাংলাদেশের খেলার মাঠে আমাদের বিজয়ের মাসে পাকিস্তানি পতাকা টানিয়ে তারা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে অবমাননা করেছে। এখন ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের পদাঙ্ক অনুসরণ করে যেন অন্যান্য দেশসমূহ আমাদের দেশে সংঘটিত গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়া যায় তার চেষ্টা করার দায়িত্ব পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের।

পাকিস্তান, চীন এবং সম্ভবত তুরস্ক আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আমাদের দাবির বিরোধিতা করবে ধরে নিয়েই আমাদের এগোতে হবে। তবে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সমর্থন পেলে সেটি হবে উল্লেখযোগ্য অর্জন। ২০১৫ সাল থেকে জাতিসংঘের উদ্যোগে এই দিবসটি পালিত হয়, যার উদ্দেশ্য ভবিষ্যতে গণহত্যার পথ বন্ধ করা। ২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বর, গণহত্যা কনভেনশনের ৭০তম বার্ষিকী পালনকালে, জাতিসংঘ তার নিরাপত্তা পরিষদের সোয়াহ ফাউন্ডেশনকে অনুরোধ করেছিল গণহত্যার বিষয়ে বিভিন্ন ভুক্তভোগী দেশের পুরুষ এবং নারীদের সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য, এমনি আটটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের পুরুষ ও নারীরাও সাক্ষ্য দিয়েছিলেন, যা এখন সংরক্ষিত দলিল হিসাবে জাতিসংঘে থাকায় আমাদের দাবি বেগবান করা যাবে।

বাংলাদেশে চালানো গণহত্যা নিশ্চিতভাবে আর্মেনিয়ার গণহত্যার চেয়ে নৃশংস ছিল এবং এমনকি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে নাত্সিদের দ্বারা ঘটানো গণহত্যার চেয়েও ব্যাপক ছিল এই অর্থে যে, সেখানে জার্মানিতে চার বছরে ৬০ লাখ লোককে হত্যা করা হয়েছিল, সেখানে বাংলাদেশে কমপক্ষে ৩০ লাখ লোককে শহিদ করা হয়েছিল, ৯ মাসে। গণহত্যাকারী পাকিস্তানি সৈন্যদের বিচার করা হবে, এই প্রতিজ্ঞা করে পাকিস্তান তাদের সৈন্যদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করলেও দায়ী দেশটি তাদের প্রতিজ্ঞা রক্ষা তো করেইনি, বরং বাংলাদেশে তাদের দোসর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে, তারা সংসদে নিন্দা প্রস্তাব করে বাংলাদেশে বিচারাধীন যুদ্ধাপরাধীদের দেশপ্রেমিক বলে আখ্যায়িত করে আমাদের দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করেছিল।

সম্প্রতি মাননীয় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বলেছেন, রাজাকারের সন্তানদের সরকারি-আধাসরকারি চাকরিতে নেওয়া হবে না। এটি অত্যন্ত প্রশংসিত মন্তব্য। রাজাকারদের সন্তানরা যে প্রশাসন এবং পুলিশে অবস্হান করে জঙ্গি, মৌলবাদী, সন্ত্রাসীদের সহায়তা করছে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টকারী দাঙ্গাবাজদের পক্ষ অবলম্বন করে ধর্মীয় ঘৃণা এবং হিংস্যা বাড়াচ্ছে, সাম্প্রদায়িক হাঙ্গামা তদন্তের জন্য গঠিত গণতদন্ত কমিশনের ৯ মাসের তদন্তে তা ফুটে উঠেছে। তাই এদের ঠেকাতে হবে। জার্মানিতেও নাৎসিদের বংশধরদের ব্যাপারে এ ধরনের আইন বলবৎ। এছাড়া আরো প্রয়োজন রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের যারা সমালোচনা করে অথবা শহিদদের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তকর বক্তব্য প্রদান করে, যেমনটি করেছিলেন খালেদা জিয়া এবং তার দলের কয়েক জন, সে ধরনের বক্তব্যকে শাস্তিযোগ্য অপরাধে পরিণত করে আইন প্রণয়ন করাও প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে, যে ধরনের আইন পৃথিবীর বহু দেশেই বিদ্যমান।

লেখক : আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি

শেয়ার করুন