সাঁওতাল কৃষকের আত্মহত্যা যে বার্তা দেয়

পাভেল পার্থ

পানিশূন্যতায় জমি চৌচির হয়ে যায়
পানিশূন্যতায় জমি চৌচির হয়ে যায়। ফাইল ছবি

বরেন্দ্র অঞ্চল পাতাল পানির আধার, যা অনবরত শূন্য হচ্ছে। মেশিন দিয়ে টেনে তুলে ব্যবহার হচ্ছে পাতালের পানি। ভূ-উপরিস্থ পানির আধারগুলো অনেক আগেই বিলীন হয়েছে। পাতাল পানির ওপরেই এখন টিকে আছে বরেন্দ্রর জীবন-মরণ; কৃষিকাজ থেকে শুরু করে দৈনন্দিন যা ব্যবহার্য। ভূগর্ভস্থ এই পানির নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) কাছে। বরেন্দ্র অঞ্চলে একটু পরপর তাদের মেশিনঘর আছে। আছে পানির কল ও সেই পানি কিনে নেওয়ার ব্যবস্থা। তথাকথিত সবুজ বিপ্লবের পর যখন যন্ত্রনির্ভর পাতাল পানির সেচ চালু হলো তখন এই নয়া সেচব্যবস্থা স্থানীয় ক্ষমতা কাঠামোকে একতরফাভাবে নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করল। সমাজে বিদ্যমান শ্রেণিসম্পর্ক ও বিরাজিত কাঠামোগত বৈষম্য পাতাল পানি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে আরও পোক্ত হলো এবং কোথাও কোথাও এটি দ্বন্দ্ব-সংঘাতের নয়া মেরূকরণ উস্কে দিল। কারণ বিএমডিএর মেশিনঘর থেকে সব সময় পানি দেওয়া হয় না। প্রয়োজন ও চাহিদা মোতাবেক একটি রুটিন ও সিরিয়াল থাকে। কিন্তু দেখা যায়, এলাকা, শ্রেণি ও বর্গভেদে হরহামেশা এর ব্যত্যয় ঘটে। চাহিদা ও নিয়ম মোতাবেক সবকিছু হাজির করার পরও কিছু মানুষকে দিনের পর দিন পানির জন্য অপেক্ষা করতে হয়।

পানিশূন্যতায় জমি চৌচির হয়ে যায়। চোখের সামনে রক্ত জল করা ফসল মরে যায়। বরেন্দ্রর গ্রামগুলোতে ঘুরলে এমন অভিযোগ হরহামেশাই পাওয়া যায়। বিশেষত গরিব, নারী, আদিবাসী, ভূমিহীন ও প্রান্তজনের সঙ্গে পানি সরবরাহ নিয়ে এমন বৈষম্য করা হয়। সম্প্রতি পানি বঞ্চনার এমন নির্দয় ঘটনা আবারও ঘটেছে বরেন্দ্র এলাকায়। ১২ দিন ঘুরেও পানি না পেয়ে আত্মহত্যা করেছেন দুই সাঁওতাল কৃষক। বাংলাদেশ যখন গর্বের সঙ্গে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছে তখনি রাজশাহীর গোদাগাড়ীর দেওপাড়া ইউনিয়নের নিমঘুটু গ্রামে ঘটেছে এমন নির্মম ঘটনা। কৃষিকাজের জন্য সেচের পানি না পেয়ে নিমঘুটু গ্রামের অভিনাথ মার্ডি ও রবি মার্ডি আত্মহত্যা করতে বাধ্য হন। কৃষকের এই মৃত্যু আমাদের কী জানান দেয়?

গোদাগাড়ীর ঈশ্বরীপুর গ্রামের ঘটনাটি ঘটেছে ২৩ মার্চ বুধবার। অভিনাথের স্ত্রী রোজিনা হেমব্রম গোদাগাড়ী থানায় ডিপকলের অপারেটর মো. সাখাওয়াত হোসেনকে আসামি করে একটি মামলা করেন। মামলার এজাহার থেকে জানা যায়, অভিনাথের পরিবার ৭ নম্বর দেওপাড়া ইউনিয়নের ঈশ্বরীপুর মৌজার ইউনিয়ন পরিষদ সংলগ্ন ঈশ্বরীপুর ২ নম্বর বরেন্দ্র ডিপকলের আওতাধীন ২৫ কাঠা জমি বর্গা নিয়ে চাষাবাদ করতেন। জমিতে বোরো মৌসুমে ধান আবাদ করেছেন। জমিতে পানি সেচের প্রয়োজন হওয়ায় অভিনাথ অভিযুক্ত আসামি ডিপ মেশিন অপারেটরকে জানান। ১০-১২ দিনেও পানি না পাওয়ায় জমির ধান-চারা নষ্ট হতে থাকে। ঘটনার দিন বিকেল ৪টায় অভিনাথ ডিপকলের কাছে এসে অভিযুক্ত আসামির কাছে জানতে চান, কেন তাকে পানি দেওয়া হচ্ছে না। তখন অভিযুক্ত আসামি অভিনাথকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেন এবং বলেন, ‘আমি তোর জমিতে পানি দেব না। তুই বিষ খা গা।’

গণমাধ্যমসূত্রে জানা যায়, জমিতে সেচের পানি পাওয়ার পর কীটনাশক প্রয়োগ করতে চেয়েছিলেন অভিনাথ। কিন্তু অপারেটর পানি না দিয়ে বলেন, পানি দিতে পারব না, তোরা নিজেরাই বিষ খেয়ে নে (দেখুন : দৈনিক সমকাল, ২৪ মার্চ)। বিষপানের পর গ্রামের ভ্যানচালক বাপ্পি মার্ডির ভ্যানে অভিনাথকে তুলে দেন অভিযুক্ত আসামি। বাপ্পি মার্ডি তাকে বাড়ি নিয়ে আসেন, তখন অভিনাথের মুখ দিয়ে লালা ঝরছিল আর তিনি কাশছিলেন। অভিনাথ তখনও সাখাওয়াতকে বলছিলেন, আমি বিষ খেয়েছি, মারা যাব। বাড়িতে আনার পর রাতে অভিনাথ মারা যান। অভিনাথকে বাড়িতে আনার পর রবি মার্ডিকে ঘটনাস্থল থেকে ধরাধরি করে রাজশাহী মেডিকেলে নেওয়া হয়। চিকিৎসাধীন অবস্থায় রবি মার্ডি মারা যান স্বাধীনতা দিবসের রাতে।

অভিনাথের স্ত্রীর করা মামলার এজাহারে বিবৃত হয়েছে, ‘আমার স্বামী আসামির কথায় প্ররোচিত হয়ে মনের দুঃখে কীটনাশক পান করেন।’ গণমাধ্যমের ভাষ্য, হাসপাতালে রবি ঠিকমতো কথা বলতে পারছিলেন না। কেন বিষ পান করেছেন, এর উত্তরে রবি জানান, দুঃখ লেগেছিল। ২৬ মার্চ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন রাজশাহী-২ আসনের সংসদ সদস্য ও আদিবাসীবিষয়ক সংসদীয় ককাসের আহ্বায়ক ফজলে হোসেন বাদশা। এই জনপ্রতিনিধি সাংবাদিকদের অভিযোগ করেন, বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ গভীর নলকূপের পানি দেওয়ার ক্ষেত্রে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের সঙ্গে বৈষম্য করে। এ নিপীড়ন গোটা গোদাগাড়ী ও তানোর এলাকার।

কর্তৃপক্ষ কী বলছে?

গণমাধ্যমে এ ঘটনায় সংশ্নিষ্ট কর্তৃপক্ষের ভাষ্য যতটুকু এসেছে সেসব বিশ্নেষণ করে দেখা যায়, কৃষকের এই নিদারুণ মৃত্যুতে তাদের ভাষ্যে কোনো অনুশোচনা নেই, গ্লানি কিংবা দরদ নেই। বিএমডিএর অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, পানির অভাবে তাদের জমির ধান মারা যায়নি। সেই শোকে তারা বিষপান করেছেন- এটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। পানি দেওয়ার ক্ষেত্রে অপারেটরের কোনো অনিয়ম থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। গোদাগাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে বলেছেন, চৈত্র মাসে আট-দশ দিন জমিতে পানি না পেয়ে কি একজন মানুষ বিষ খেয়ে মারা যেতে পারে? বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে, ময়নাতদন্তের পর ঘটনার কারণ জানা যাবে (দেখুন : প্রথম আলো, ২৪ মার্চ)।

পানি দিবস ও দুই কৃষকের প্রশ্ন

২২ মার্চ বিশ্বব্যাপী পালিত হয় ‘বিশ্ব পানি দিবস’। এ বছরের প্রতিপাদ্য ছিল ‘ভূগর্ভস্থ পানি’। পানি দিবসের পরদিনই ভূগর্ভস্থ পানি না পেয়ে আত্মহত্যার মাধ্যমে দুই কৃষকের এই মৃত্যু আমাদের অপরাধী করে দেয়। দুই সাঁওতাল কৃষকের মৃত্যুর ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে, আশা করি। কিন্তু পিপাসার্ত বরেন্দ্র অঞ্চলের পানি ব্যবস্থাপনা, কৃষিপ্রকল্প ও গ্রামীণ বিকাশ নিয়ে আমাদের ভিন্নভাবে ভাবতে হবে। সবুজ বিপ্লব থেকে শুরু করে করপোরেট নিয়ন্ত্রিত কোনো কৃষিব্যবস্থাই আমাদের জীবন, স্বাস্থ্য, বাস্তুতন্ত্র ও সামাজিক সংহতিকে সুরক্ষিত করে না। অভিনাথ মার্ডি ও রবি মার্ডি জীবন দিয়ে আমাদের মধ্যে এক জটিল অমীমাংসিত প্রশ্ন ছুড়ে গেলেন। কাউকে বাদ দিয়ে বা দূরে সরিয়ে রেখে এর উত্তর আমরা খুঁজে পাব না।

পাভেল পার্থ : লেখক ও গবেষক

শেয়ার করুন