বরেণ্য শিক্ষাবিদদের মধ্যে অনেকে স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে কাজ করতে আগ্রহী নন। শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি সংসদে তা স্বীকার করেন। আস্থার সংকট, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের নানা চাপ, স্বাধীনভাবে দায়িত্ব পালনের পরিবেশের অভাব, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অসাধু চক্রের দাপটের কারণে আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন শিক্ষকরা উপাচার্যের দায়িত্ব নিতে আগের মতো উৎসাহিত হচ্ছেন না।
এ পদে থেকে অনেকের অনিয়ম, দুর্নীতি করে পার পেয়ে যাওয়া, বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের পরও দলীয় বিবেচনায় তাদেরকে রক্ষার ঘটনাগুলো দেশে উপাচার্যের পদটিকে বিতর্কিত করে তুলছে। এ অবস্থা উচ্চশিক্ষা ব্যবস্থার জন্য ‘অশনি সংকেত’ বলে শিক্ষাবিদরা মনে করেন।
তারা বলেন, কোনো শিক্ষকের উপাচার্য হিসেবে দায়িত্ব পাওয়া তার জন্য অনেক সম্মান ও মর্যাদার। দেশে সামরিক শাসনের আমল থেকে শুরু হয় দলীয় বিবেচনায় স্বায়ত্তশাসিত, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উপাচার্য নিয়োগ। গণতান্ত্রিক সরকারের আমলেও এ ধারার চর্চা চলতে থাকে। চার দশক ধরে চলমান বিভিন্ন অপকাণ্ডের জের ধরে এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে যে, অনেকে উপাচার্যের দায়িত্ব নিয়ে ‘বিব্রতকর অবস্থার’ মুখোমুখি হতে চান না।
সাধারণত উপাচার্যদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, নিয়োগে অনিয়মসহ নানা অভিযোগ ওঠলেও ব্যতিক্রম ছাড়া ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। পদক্ষেপ নেওয়ার নজিরও খুব কম। শিক্ষার্থীদের আন্দোলন জোরদার হলে কখনো কখনো অভিযুক্ত উপাচার্যকে সরিয়ে দেওয়া বা পদত্যাগের সুযোগ দিয়ে পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ করে থাকে সরকার।
উপাচার্যদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়ায় যুগের পর যুগ ধরে অনিয়ম ও দুর্নীতি চলে আসছে বলে অভিযোগ আছে। রাজনৈতিক পরিচয়ে উপাচার্য হওয়া শিক্ষক বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে গুরুত্ব দেন না। ‘ক্ষমতাবান’ এসব উপাচার্যের বিরুদ্ধে ক্ষমতাহীন বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নিতে পারে না। সরকার বললে শুধু তদন্ত করে সুপারিশ করতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে সেই তদন্তও আলোর মুখ দেখে না। এমনকি তদন্ত করতে গিয়ে উপাচার্যের চাপে ইউজিসির তদন্ত দলের ফিরে আসার ঘটনাও আছে।
জানা যায়, উপাচার্য নিয়োগ দেওয়া ও তাদের বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার এখতিয়ার আচার্যের। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের পরামর্শও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আচার্যের (রাষ্ট্রপতি) সাচিবিক কাজটি করে থাকে। ফলে রাষ্ট্রপতি ও সরকারের শীর্ষ পর্যায়কে এসব বিষয় অবহিত করার মূল দায়িত্ব মন্ত্রণালয়ের।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান মনে করেন, ‘দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যেসব উপাচার্যের দুর্নীতি প্রমাণিত হয়েছে, তাদেরকে আইনের আওতায় আনা উচিত। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকা উচিত নয়। ঢাবির গবেষণায় চৌর্যবৃত্তির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’
দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের বিরুদ্ধে প্রায়ই দুর্নীতি, নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা ধরনের অভিযোগ ওঠছে। প্রায়ই আলোচনায় আসেন তারা। আজ মঙ্গলবার জাতীয় সংসদেও এ আলোচনা উঠে আসে। সংসদের বিরোধীদল জাতীয় পার্টির মুজিবুল হক চুন্নু, বিএনপির হারুনুর রশীদ, রুমিন ফারহানা উপাচার্যদের কর্মকাণ্ড নিয়ে সমালোচনা করেন।
শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি সংসদে বলেন, ‘আমাদের বরেণ্য শিক্ষক আছেন, যাদেরকে উপাচার্য হিসেবে পেলে গর্ব অনুভব করতাম। তাদের মধ্যে অনেকে এ প্রশাসনিক দায়িত্ব নিতে আগ্রহী হন না। আমরা চাইলেও সবচেয়ে ভালো কেউ আগ্রহী হবেন, তেমন নয়।’
তিনি বলেন, ‘কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের কার্যকলাপ নিয়ে কিছু কিছু সমালোচনা আছে। যেগুলোর সত্যতাও আছে। সেগুলোর বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ঢালাওভাবে সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যকে নিয়ে মন্তব্য করা সমীচীন নয়।’
শিক্ষামন্ত্রীর এ বক্তব্যের জবাবে বিএনপির সংসদ সদস্য হারুনুর রশীদ বলেন, ‘আস্থার সংকট ও স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ নেই বলে বরেণ্য শিক্ষাবিদরা উপাচার্য হতে আগ্রহী হন না।’
তথ্যমতে, অভিযুক্ত উপাচার্যকে বিভিন্ন সরকার পদে রাখার চেষ্টা করলেও আন্দোলনের মুখে পদ ছাড়তে বাধ্য হওয়ার ঘটনা দেশে অনেক আছে। কখনো শিক্ষার্থী, শিক্ষকদের আন্দোলনের চাপে, কখনো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের আভ্যন্তরিণ রাজনীতির মারপ্যাঁচের কারণে। কখনো বা উপাচার্যের বিতর্কিত কর্মকাণ্ড, অনিয়ম, দুর্নীতির অভিযোগে।
কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদত্যাগের বিরুদ্ধে যৌক্তিক আন্দোলন হলে শেষ পর্যন্ত সাধারণত শিক্ষার্থীদের দাবি পূরণ হয়ে থাকে। সাম্প্রতিক অতীতে এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) উপাচার্য ফারজানা ইসলাম, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) উপাচার্য ফরিদ উদ্দিন আহমেদ। জোরালো আন্দোলন হলেও তাঁদেরকে শেষ পর্যন্ত পদত্যাগ করতে হয়নি।
আওয়ামী লীগ সরকারের গত ১৩ বছরে স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ উপাচার্য শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করেন। উপাচার্যদের সম্মানজনক উপায়ে পদত্যাগ করার ঘটনাও আছে। মর্যাদাপূর্ণ উপায়ে বিভিন্ন সময়ে ঢাবির অন্তত পাঁচজন উপাচার্য পদত্যাগ করেন। তাঁদের কথা মানুষ শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করেন।
স্বাধীনতার পর পঞ্চাশ বছরে একজন উপাচার্যকে অপসারণ করে সরকার। ওই সরকার এর জন্য আজও সমালোচিত। ১৯৯২ সালে ছাত্রশিবিরের দাবির মুখে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার উপাচার্য আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীনকে বিতর্কিত কায়দায় অপসারণ করে জামায়াতের সমর্থনে গঠিত বিএনপির সরকার।