আ স ম আবদুর রবের জেএসডি, কর্নেল (অব.) অলি আহমদের এলডিপি ও সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের কল্যাণ পার্টির নেতৃত্বে নতুন জোট গঠন ঠেকাতে রাজনৈতিক কৌশলে পরিবর্তন আনার ইঙ্গিত দিয়েছে বিএনপি। তাদের জাতীয় সরকার গঠনের দাবি ‘কৌশলে’ মেনে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি।
পরবর্তী সংসদ নির্বাচনের সময় অন্তর্বর্তীকালীন, না জাতীয় সরকার—এ নিয়ে দলগুলোর মধ্যে ওঠা বিতর্কের রেশ টানতে জাতীয় সরকারের নতুন ধারণা নিয়ে হাজির হতে চাচ্ছে বিএনপি। শরিকদের চাপের মুখে শিগগিরই জাতীয় সরকারের এ ধারণা তুলে ধরে সরকারবিরোধী দলগুলোকে একত্র করার উদ্যোগ নেবে দলটি।
বিএনপির সূত্র বলছে, আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে চলতি বছরে দলের নেতৃত্বে বৃহত্তর নতুন ঐক্য গড়ার উদ্যোগ ‘হোঁচট’ খায় জাতীয় সরকার প্রশ্নে। বিএনপির নির্বাচনকালীন দলনিরপেক্ষ সরকারের দাবি হলেও জোটের শরিক বেশ কয়েকটি দল চায় জাতীয় সরকার। এতে জোট গঠন প্রক্রিয়া গতি হারায়।
তাই নতুন রাজনৈতিক কৌশলের সিদ্ধান্ত নেন দলটির নীতিনির্ধারকরা। গত সোমবার বিএনপির যুক্তরাজ্য শাখার আলোচনা সভায় বক্তব্যে জাতীয় সরকারের বিষয়ে আভাস দেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান।
বিএনপি বলছে, নির্বাচনের আগে নয়, বিজয়ী হলেই জাতীয় সরকার গড়তে চায় দলটি। আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হতে হবে। গত দুইদিন ধরে দলটির নেতাকর্মীরা ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে এ ধারণার প্রচারণা করছেন।
দলের স্থায়ী কমিটির বৈঠকে জাতীয় সরকার ইস্যুতে ঐকমত্যে পৌঁছেছেন নেতারা। ২০ দলীয় জোট ও ঐক্যফ্রন্টের শরিকদের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হয়েছে। আগামী সপ্তাহ থেকে এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু হতে পারে।
তবে শরিক দলের নেতারা তাদের যুক্তিতে এখনও অনড় রয়েছে। নেতারা আশা করছেন, বিএনপির যুক্তির সঙ্গে তারা একমত হবেন। জোটের শরিকরা চায়, দুই বছর মেয়াদি জাতীয় সরকারের অধীনে আগামী সংসদ নির্বাচনের আয়োজন হোক। বিএনপি মনে করছে, দীর্ঘমেয়াদের জাতীয় সরকার গঠন হলে গণতন্ত্র ব্যাহত হতে পারে।
অন্যদিকে গুঞ্জন আছে, আগামী সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নতুন রাজনৈতিক জোট গঠনের পরিকল্পনা করছে আবদুর রবের জেএসডি, অলি আহমদের এলডিপি ও মুহাম্মদ ইবরাহিমের কল্যাণ পার্টি। বিএনপির বলয়ের বাইরে এসে জাতীয়তাবাদী ঘরানার নতুন জোটের কথা ভাবছে দলগুলো। বিএনপির নেতৃত্বের ঐক্যফ্রন্ট ও ২০ দলীয় জোটের শরিক কয়েকটি দল নতুন জোট হলে যোগ দিতে পারে।
জোট গঠনের প্রক্রিয়ায় মাহমুদুর রহমান মান্নার নাগরিক ঐক্যকে যুক্ত করার আলোচনা চলছে। গণফোরামের সভাপতি ড. কামাল হোসেন রাজি হলে তাঁকে জোটের নেতৃত্বে রাখার পরিকল্পনা আছে।
সম্ভাব্য জোটের নেতারা বিএনপির ‘নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের দাবির’ সঙ্গে একমত ছিলেন আগে। গত কয়েক মাস ধরে তাঁদের দাবি, জাতীয় সরকার গঠনের। দেশে বিদ্যমান ‘সব সংকট নিরসনের একমাত্র বিকল্প জাতীয় সরকার গঠন’ বলে মনে করেন তাঁরা।
তাঁদের দাবির পক্ষে ইতোমধ্যে সমমনা দল গণফোরাম (মন্টু), বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, গণসংহতি আন্দোলন, রাষ্ট্র সংস্কার, গণঅধিকার পরিষদ ঐকমত্যে পৌঁছেছে বলে বিভিন্ন সূত্র মত ও পথকে জানায়।
গত সংসদ নির্বাচনের আগে গঠিত ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম উদ্যোক্তা, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী জেএসডি ও এলডিপির ‘জাতীয় সরকার গঠনের’ দাবির সঙ্গে একমত। তিনি বিএনপির শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে পরিচিত। বিএনপির ‘সন্দেহ’, রব-অলি-ইবরাহিমের নেতৃত্বে গঠন হতে যাওয়া জোটের পেছনে ডা. জাফরুল্লাহর ‘ভূমিকা’ থাকতে পারে।
এ ছাড়া বিএনপি নিজ দলসহ জোটের অন্তত দশ-বারো নেতার দিকে সন্দেহের চোখ রাখছে। বিকল্প জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক জোট গঠনের বিষয়ে দলটির শীর্ষপর্যায়ের কাছে তথ্য আছে। এর সঙ্গে দল ও জোটের গুরুত্বপূর্ণ কয়েক নেতা যুক্ত আছেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির দুজন সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে মত ও পথকে বলেন, ‘২০১৯ সালে দেশে বিকল্প জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক শক্তি দাঁড় করানোর প্রক্রিয়া শুরু হয়। ওই বছর এ বিষয়ে দেশ-বিদেশে গোপন একাধিক বৈঠকের আয়োজন হয়। সেগুলোতে দলটির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল, কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য নিপুণ রায়সহ কয়েকনেতা অংশ নেন। ওই প্রক্রিয়ার সঙ্গে দলের দুই ভাইস চেয়ারম্যান হাফিজ উদ্দিন আহমদসহ আরেকজনের যুক্ত থাকার বিষয়ে দলের ভেতরে আলোচনা আছে। এ কারণে গত বছর তাঁদেরকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেয় বিএনপি। এর নেপথ্য কারণ ছিল ওই সন্দেহ।’
বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি, মধ্যবর্তী নির্বাচনসহ ১৮ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ২০১৯ সালের জুনে ‘জাতীয় মুক্তি মঞ্চ’ নামে নতুন একটি ‘প্লাটফর্মের’ ঘোষণা দেন এলডিপির সভাপতি অলি আহমদ। তাঁর ওই ‘প্লাটফর্ম’ গঠনের কার্যক্রম সন্দেহ হওয়ায় একপর্যায়ে দলের নেতাকর্মীদেরকে মুক্তি মঞ্চের কর্মসূচি এড়িয়ে চলতে মৌখিক নির্দেশ দেয় বিএনপি।
একইসঙ্গে কল্যাণ পার্টির কর্মসূচিও এড়িয়ে চলতে মৌখিক নির্দেশ দেয় দলটি। দলটির সন্দেহ, অলি-ইবরাহিম দেশের ডানপন্থি ভাবধারার বড় একটি অংশকে সংগঠিত করতে চান বিএনপির বলয়ের বাইরে।
গত সংসদ নির্বাচনের পর বিভিন্ন সময় দেওয়া বক্তব্যে আবদুর রব, অলি আহমদ, মুহাম্মদ ইবরাহিম ‘নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন’ আয়োজনের দাবি জানান। এ দাবিতে বিএনপির সঙ্গে এক মঞ্চে তাঁরা আন্দোলন করেন। এখন তাঁদের বক্তব্য ভিন্ন। তাঁরা বলছেন, জাতীয় সরকার গঠনের কথা। তাঁদের নেতৃত্বে সম্ভাব্য জোটের বিশেষ দাবি হবে জাতীয় সরকারের কথা।
ঐক্যফ্রন্টের শরিক জেএসডির পক্ষ থেকে গত বছর প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে জাতীয় সরকারের দাবি তুলে ধরা হয়। এ দাবির পক্ষে বিভিন্ন যুক্তি তুলে ধরে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে দলটি। এরপর ২০ দলীয় জোটের অন্যতম শরিক এলডিপিও জাতীয় সরকারের পক্ষে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য-বিবৃতি দেওয়া শুরু করে।
আ স ম রব বলেন, ’শুধু ক্ষমতাকে দীর্ঘস্থায়ী করার জন্য বর্তমান সরকার বাঙালি জাতীয়তাবাদ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা দুটোকেই পরিত্যাগ করেছে। এখন রাষ্ট্রের একমাত্র পথ হচ্ছে গণজাগরণের মাধ্যমে জাতীয় নৈতিক শক্তির পুনরুজ্জীবন করা। পুনরুজ্জীবিত শক্তিই জাতীয় সরকার গঠন করবে। বিদ্যমান সংকট নিরসনের একমাত্র বিকল্প জাতীয় সরকার গঠন করা।’
এলডিপির সভাপতি অলি আহমদ মনে করেন, ‘জাতীয় সরকার সব সমস্যার সমাধান করবে। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে। অনেকে তত্বাবধায়ক সরকারের কথা বলে যাচ্ছেন। ক্ষমতায় যেতে এতো তাড়াহুড়ো কেন? সব প্রতিষ্ঠানে ভারসাম্য আনতে কাজ করতে হবে।’