প্রস্তাবিত ‘গণমাধ্যমকর্মী (চাকরির শর্তাবলি) বিল-২০২২’ পাস হলে তা হয়ে উঠতে পারে সাংবাদিক সমাজ ও গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের আরেক ‘কালাকানুন’। আইনটি কার্যকর হলে সম্পাদকসহ সাংবাদিকদের মর্যাদা কমবে। গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে সরকারের নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব বাড়তে পারে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খড়গের সঙ্গে নতুন আইন মিলে সাংবাদিকদের স্বাধীনতায় আরেক বাধা, জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে। সংসদে উত্থাপিত খসড়া পর্যালোচনা করে এসব আশঙ্কা ব্যক্ত করেছেন দেশের জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও সাংবাদিক নেতারা।
তাঁদের মতে, প্রস্তাবিত খসড়া সংশোধন ও বিতর্কিত ধারাগুলো বাদ দেওয়া ছাড়া আইনটি প্রণয়ন হলে সাংবাদিকদের আর্থিক সুযোগ-সুবিধা আরো কমবে। চাকরির নিশ্চয়তা ও নিরাপত্তা ঠুনকো বিষয়ে পরিণত হতে পারে। আইনটি পাস হলে সাংবাদিকদের আর্থিক নিরাপত্তা ও সামাজিক মর্যাদা ক্ষুন্ন হবে। তারা তখন ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার হারাবেন। শ্রম আইনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন।
সাংবাদিক নেতৃত্ব বলছে, গণমাধ্যমকর্মী আইন প্রত্যাশিত। আইন প্রণয়নের দাবিও জানিয়ে আসছেন সাংবাদিকরা। এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ায় সাংবাদিকরা সরকারের প্রশংসা করেছে। ১৯৭৪ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর সরকারের আমলে প্রণীত আইনটিকে ভিত্তি করে সময়োপযোগী আইন প্রণয়ন করতে পারে সরকার। তবে সংসদে উত্থাপিত আইনের খসড়া নিয়ে ‘সন্দেহ, আপত্তির’ দিক আছে। খসড়ায় কী আছে, তা এতোদিন সাংবাদিক সমাজ জানতে পারেনি। সাংবাদিকতায় দেশের নেতৃত্বস্থানীয় অবস্থানে যারা আছেন, তাদেরকেও খসড়া দেওয়া হয়নি। খসড়া চূড়ান্তের সময় দেশের কোনো সম্পাদক, সাংবাদিক নেতার সঙ্গে আলোচনা করা হয়নি।
সাংবাদিক সমাজের অভিযোগ, নতুন করে আইন প্রণয়ন হলে সাধারণত বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধার চেয়ে আরো বাড়ানো হয়ে থাকে। প্রস্তাবিত খসড়ায় সাংবাদিকদের সুযোগ-সুবিধা বর্তমানের তুলনায় কমানোর কথা উল্লেখ আছে। এতে ‘বিস্মিত’ সাংবাদিকরা। কোনো সাংবাদিককে চাকরিচ্যুত করতে হলে এখন চারমাসের অগ্রিম বেতন দেওয়ার নিয়ম আছে। খসড়ায় তা কমিয়ে একমাসের বেতনের জন্য প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে চাকরির ‘নিশ্চয়তায়’ আরো আঘাত আসবে।
খসড়ায় সাংবাদিকদের জন্য দৈনিক ৮ ঘণ্টা হিসাবে সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টা কাজের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বিশ্বজুড়ে সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা কাজের রেওয়াজ আছে। দেশের সরকারি কর্মচারিরা সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা কাজ করেন। বিভিন্ন গবেষণা বলছে, সাপ্তাহিক কাজের সময় সপ্তাহে ৩০ থেকে ৩২ ঘণ্টা রাখা হলে ফল ভালো পাওয়া যায়। যে কারণে আধুনিক প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মীদের সপ্তাহে তিনদিন ছুটি নিতে উৎসাহিত করছে। সাংবাদিকদের সপ্তাহে দুইদিন ছুটি কার্যকরের দাবি ওঠেছে দীর্ঘদিন ধরে।
দৈনিক ভোরের কাগজের সম্পাদক, সম্পাদক পরিষদের সহসভাপতি শ্যামল দত্ত এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘খসড়াটি আমি পড়েছি। প্রস্তাবে কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। আইনটি পাস হলে গণমাধ্যম এতোদিন যেসব সুবিধা ভোগ করে আসছিল, সেগুলো খর্ব হবে। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা ভালো নয়। সবার সঙ্গে আলোচনা করে ত্রুটিমুক্ত খসড়া যেন প্রস্তুত করা হয়, এ দাবি জানাই।’
গ্লোবাল টিভির প্রধান নির্বাহী কর্মকতা সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বলেন, ‘গণমাধ্যমকর্মী আইনের প্রস্তাবিত খসড়ায় সম্পাদকের ভূমিকা বিলুপ্ত করে দেওয়া হয়েছে। সাংবাদিকদের পরিচয় বিলুপ্ত করা হয়েছে। আমি সাংবাদিকতা করি, আমার পরিচয় থাকতে হবে।’
কোনো কোনো সাংবাদিক নেতার অভিযোগ, খসড়ায় গণমাধ্যমকর্মী ও মালিকপক্ষের মধ্যে বিরোধ নিরসনে কিছু সুবিধার কথা বলা হলেও তা মূলত মালিকদের স্বার্থ বেশি রক্ষা করবে। যা হয়ে উঠতে পারে মালিকদের কর্তৃত্ব ও স্বার্থরক্ষার আইন। তবে মালিকদের কেউ কেউ প্রস্তাবিত খসড়ার অসঙ্গতি দূর করার দাবি জানাচ্ছেন।
সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন ‘নিউজপেপার্স ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের’ (নোয়াব) সভাপতি এ. কে. আজাদ বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে কিছু আইন গণমাধ্যমের স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করেছে। এ ক্ষেত্রে বলা হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কথা। এ আইন নিয়ে অনেকে উদ্বেগের কথা বলেছেন। অতি সম্প্রতি গণমাধ্যমকর্মী আইন সংসদে উঠেছে। আইনটি নিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্যেই আপত্তি রয়েছে। এমন আইনের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত আলোচনা সাপেক্ষে নেওয়া উচিত।’
প্রস্তাবিত আইনের বিষয়ে গত ৮ জানুয়ারি আপত্তি জানায় আওয়ামী লীগের সমর্থিত ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন (বিএফইউজে)। বিবৃতিতে সংগঠনটির সভাপতি ওমর ফারুক ও ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব শেখ মামুনুর রশীদ বলেন, ‘দেশে বিদ্যমান আইনে চলমান সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো যায়। কমানোর কোনো বিধান নেই। গণমাধ্যমকর্মী আইনে অবশিষ্ট সুবিধাগুলো কর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে। আইনটি পাস হলে সাংবাদিকদের আর্থিক নিরাপত্তা ও সামাজিক মর্যাদা বলতে কিছুই থাকবে না।’
গত ১২ জানুয়ারি এ আইনকে সুরক্ষার মোড়কে নতুন ‘কালাকানুন’ ও পুরোপুরি গণমাধ্যমকর্মীদের স্বার্থের পরিপন্থি বলে অভিহিত করে তা প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি-জামায়াতের সমর্থিত ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) নির্বাহী পরিষদ।
গণমাধ্যম আদালত স্থাপনের বিধান রেখে নতুন আইন করছে সরকার। এতে আদালত স্থাপনের পাশাপাশি বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির বিধানও রাখা হয়েছে। এ সংক্রান্ত বিল গত ২৮ মার্চ জাতীয় সংসদে তোলা হয়। এতে মাসের প্রথম সাত কর্মদিবসের মধ্যে বেতন পরিশোধ করা, গণমাধ্যমকর্মীর সংজ্ঞা, সর্বোচ্চ কর্মঘণ্টা, মজুরি বোর্ড গঠন, চাকরিচ্যুত করার বিধান, চাকরির সর্বোচ্চ বয়সসীমা ইত্যাদি নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।
তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ বিলটি সংসদে উত্থাপন করেন। পরে বিলটি ৬০ দিনের মধ্যে পরীক্ষা করে সংসদে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়।