ইউক্রেন যুদ্ধ কীভাবে শেষ হবে?

এম এল ক্যাভানাফ

ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা
ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা। ছবি : ইন্টারনেট

রাশিয়ানদের সক্ষমতা নেই গতানুগতিক যুদ্ধের মাধ্যমে সরাসরি বিজয় লাভ করা। বিশেষজ্ঞরা শুরু থেকেই বলে আসছেন, শহর দখল করে সেটি আয়ত্তে রাখার মতো প্রয়োজনীয় পদাতিক সৈন্যদল রাশিয়ার নেই। রাসায়নিক, জীবাণু কিংবা কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র—কোনো প্রকার বিধ্বংসী অস্ত্রই যথেষ্ট নয় ভ্লাদিমির পুতিন দুর্দশার মধ্যেই আছেন। পেন্টগনের এক কনজারভেটিভের অনুমান অনুসারে যুদ্ধের প্রথম ২০ দিনে প্রায় ৭ হাজারেরও বেশি রাশিয়ান সৈন্য নিহত হয়েছে, যেটি গত ২০ বছরে আফগানিস্তান ও ইরাকে নিহত আমেরিকান সৈন্যদের চেয়েও বেশি। ন্যাটোর হিসাবমতে, সংখ্যাটা আরো বেশি—প্রায় ৪০ হাজার রাশিয়ান সৈন্য নিহত, আহত, নিরুদ্দেশ কিংবা বন্দি হয়েছে।

অবসরপ্রাপ্ত আর্মি জেনারেল ডেভিড এইচ পেট্রোস বিষয়টি খুব সহজভাবে মূল্যায়ন করেছেন এভাবে—রাশিয়ান ও ইউক্রেনিয়ানরা একপ্রকার চরম অচলাবস্হার মধ্যে আটকে আছে। ইরাক যুদ্ধের প্রথম দিকে পেট্রোস যখন মেজর জেনারেল হিসেবে সেখানে দায়িত্ব পালন করেন, তখন তার বিখ্যাত একটি বক্তব্য ছিল, ‘আমাকে বলুন কীভাবে এর সমাপ্তি ঘটবে।’ ইউক্রেন যুদ্ধে সেই একই প্রশ্ন যখন ঘুরেফিরে সামনে চলে আসে, তখন তার উত্তরও একে একে সামনে চলে আসছে।

রাশিয়ানদের সক্ষমতা নেই গতানুগতিক যুদ্ধের মাধ্যমে সরাসরি বিজয় লাভ করা। বিশেষজ্ঞরা শুরু থেকেই বলে আসছেন, শহর দখল করে সেটি আয়ত্তে রাখার মতো প্রয়োজনীয় পদাতিক সৈন্যদল রাশিয়ার নেই। রাসায়নিক, জীবাণু কিংবা কৌশলগত পারমাণবিক অস্ত্র—কোনো প্রকার বিধ্বংসী অস্ত্রই যথেষ্ট নয়, রাশিয়া আরো সৈন্যবাহিনী নিযুক্ত করা ব্যতীত ইউক্রেনের ওপর কর্তৃত্ব আরোপ করতে সক্ষম নয়। এবং সেটি রাশিয়ার অর্থনীতিকে আরো ভঙ্গুর করে দেবে।

আবার ইউক্রেনের অপেক্ষাকৃত ছোট সৈন্যবাহিনী পশ্চিমা বিশ্ব থেকে অস্ত্রশস্ত্রের জোগান পেলেও এবং এখন পর্যন্ত তারা অসাধারণ প্রতিরোধ গড়ে তুললেও তারাও এই ধ্বংসের যুদ্ধে জিততে পারবে না, যদি সেই যুদ্ধ বছরের পর বছর প্রলম্বিত হয়।

কিন্তু আশার বিষয়টি নির্ভর করছে বাস্তবতার ওপর। বলা যেতে পারে, কূটনৈতিক শক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে বাধ্য হচ্ছে।

যুদ্ধ অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্হিতির সৃষ্টি করে, কিন্তু অন্ততপক্ষে এটি যোদ্ধাদের কাছে নির্মম সত্যকে তুলে ধরে। প্রাথমিক অবস্হায় পক্ষগুলো যতই নিজ দলের শক্তিমত্তা আর বিপরীত পক্ষের দুর্বলতা নিয়ে নিজেদের মধ্যে ইচ্ছাকৃত মিথ্যার ফলগুধারা ছোটাক না কেন, যুদ্ধ সেই মিথ্যাকে ভাসিয়ে দেয়। এটি অবশ্যই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং তা জনমনকে প্রভাবিত করে। বিষয়টা এমন হয়ে দাঁড়ায় যে রাজনৈতিক নেতারা যেসব চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এড়াতে পারতেন, তারা সেসব সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন।

ইউএস আর্মি ২০০৯ সালে এক ডজনেরও বেশি ইতিহাসবিদ নিযুক্ত করে, যাদের কাজ হলো আমেরিকা কীভাবে যুদ্ধ শেষ করবে সেটি পর্যালোচনা করা। আমেরিকার স্বাধীনতাযুদ্ধ থেকে শুরু করে যেদিন পর্যন্ত বিষয়টি উত্থাপিত হয়েছে, সেই পর্যন্ত যতগুলো যুদ্ধ-সংগ্রাম সংঘটিত হয়েছে, সবগুলোর বিশ্লেষণই সেই গবেষণায় অন্তর্ভুক্ত ছিল। সামরিক ইতিহাসবিদ রজার স্পিলার কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্যাটার্ন চিহ্নিত করে একটি প্রবন্ধে তা একত্রিত করেছেন।

স্পিলার লিখেছেন, যুদ্ধকে সংজ্ঞায়িত করা হয়ছে তার ভয়াবহতাকে ভিত্তি করে নয়, তার সীমাবদ্ধতাকে তুলে ধরে। একটি যুদ্ধের প্রাথমিক লক্ষ্য যতই অদম্য আর আপসহীন হোক না কেন, সেই লক্ষ্য আর উদ্দেশ্যগুলো যুদ্ধে সংঘটিত ঘটনাবলি আর চাপের কারণে প্রতিনিয়তই সংশোধিত হয় এবং সব পক্ষই ধীরে ধীরে যুদ্ধ বন্ধ করার লক্ষ্যে ঐক্যমতে পৌঁছায়।

আমরা সম্ভবত এখন সেটিই দেখতে পাচ্ছি—ক্ষত ও ব্যর্থতার বাস্তবতা আমলে নিয়ে পূর্বে যেসব বিষয় আলোচনার ঊর্ধ্বে ছিল, সেই সব বিষয়কে স্বীকার করে নেওয়ার এক অভূতপূর্ব আগ্রহ।

দুই পক্ষের কূটনীতিকেরা মঙ্গলবার তুরস্কে আলোচনায় বসেছিলেন। রাশিয়া বলছে, শান্তিচুক্তির একটি খসড়া প্রস্ত্তত হলেই তারা পুতিন ও জেলেনস্কির বৈঠকের ব্যাপারে প্রস্ত্তত হবেন। রাশিয়ার একজন ডেপুটি প্রতিরক্ষামন্ত্রী দাবি করেছেন, রাশিয়া কিয়েভের আশপাশে সামরিক কর্মকাণ্ড কমিয়ে আনবে। মাসখানেক আগেও রাশিয়ার যে অবস্হান ছিল, সেখান থেকে তাত্পর্যপূর্ণ পরিবর্তনের ইঙ্গিত তার এই বক্তব্য; রাশিয়া বরাবরই হুংকার দিয়ে আসছিল, ক্ষমতার পরিবর্তন হবে আর ইউক্রেন ক্রেমলিনের সব শর্ত মেনে নেবে।

জেলেনস্কি ইতিমধ্যে ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদানের যেই লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ছিল, সে ব্যাপারে নমনীয় হওয়ার ইঙ্গিত দিয়েছেন এবং ক্রিমিয়া ও ডনবাসের বিষয়ে আলোচনার কাঠামো নির্দেশ করেছেন।

এই পর্যায়ে এসে অপরিপূর্ণ কোনো সিদ্ধান্ত কৌশলগত বাজে চর্চাকেই বাড়াবে। কিন্তু আমরা জানি কীভাবে শান্তির পথ তৈরি করতে হয়।

পুতিন যতটুকু চেয়েছিলেন, সেটি তার আর্মিদের পক্ষে অর্জন করা সম্ভব নয়—বিষয়টি তিনি মেনে নেওয়ার মাধ্যমেই সমঝোতার শুরু হয়। রাশিয়ার দিক থেকে সমঝোতার বিষয়টি উদার ভাবার কোনো কারণ নেই, কিন্তু অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক এবং অন্য সব নিষেধাজ্ঞা রোধ করার জন্য জেলেনস্কিকে কনভিনস করতে যতটা করার দরকার ততটাই করেছেন পুতিন।

এরপর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে জেলেনস্কি। শুধু তিনিই বাকি বিশ্বকে রাশিয়ায় প্রতি নমনীয় করতে ভূমিকা রাখতে পারেন। এটাই তার আলাপ-আলোচনার একমাত্র উদ্দেশ্য। পুতিনের রকেট ও আরপিজি বেশি থাকতে পারে, কিন্তু বর্তমানে জেলেনস্কির সুমধুর ভাষণ সারা পৃথিবীকে আলোড়িত করছে।

পুতিন যেটাকে পশ্চিমাদের অর্থনৈতিক অভিযান বলছেন, সেই হাওয়ার গতিপথ পালটে দেওয়ার জাদুর কাঠি এখন জেলেনস্কিরই হাতে। জেলেনস্কি একাই পারেন শত শত গ্লোবাল কোম্পানি যারা রাশিয়া (এবং ইউক্রেন) থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে, তাদের ফিরিয়ে আনতে। এই কোম্পানিগুলো অবৈধ যুদ্ধের কারণে ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছে এবং তারা শুধু শান্তির নিশ্চয়তা পেলেই ফিরতে পারে। এবং এই শান্তির জন্য সমঝোতাকারী দুই পক্ষের বাইরেও অনেক কিছু প্রয়োজন।

সর্বশেষ বাধা ইউক্রেনের নাগরিকদের যে কোনো সমাঝোতার বিষয়ে রাজি করানো। যে কোনো সুনির্দিষ্ট চুক্তিই উত্থাপিত হোক না কেন, সেখানে বিভিন্ন ছাড়ের বিষয় থাকবেই। ইউক্রেনের যে কয় ইঞ্চি ভূমি ছেড়ে দেওয়া হবে, সেটিই পবিত্র ভূমি হিসেবে গণ্য হবে। শর্তগুলোকে মনে হবে আত্মসমর্পণ করা এবং যেই লাখ লাখ মানুষের জীবন রাশিয়ার আগ্রাসনে ধ্বংস হয়ে গেছে, তাদের পক্ষে এটা মেনে নেওয়াটা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে—যে কোনো আপস তাদের ত্যাগ স্বীকারের চাইতেও মূল্যবান।

এখন পর্যন্ত এটাই সম্ভবত জেলেনস্কির সবচাইতে বড় চ্যালেঞ্জ। কারণ যুদ্ধ কঠিন, শান্তিও কঠিন।

লেখক : সামরিক কৌশলবিদ, সিনিয়র ফেলো,
মডার্ন ওয়ার ইনস্টিটিউট
(লস অ্যাঞ্জেলস টাইমস থেকে ভাষান্তর—এইচ এম নাজমুল আলম)

শেয়ার করুন