শ্রীলঙ্কায় জনরোষের কেন্দ্রে রাজাপাকসে পরিবারের ৫ প্রভাবশালী সদস্য

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

রাজাপাকসে পরিবারের ৫ প্রভাবশালী সদস্য
রাজাপাকসে পরিবারের ৫ প্রভাবশালী সদস্য। ছবি : সংগৃহীত

স্মরণকালের ভয়াবহতম আর্থিক বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে শ্রীলঙ্কা। বিদ্যুৎ-জ্বালানির সংকট ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি এবং সেই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ কমতে থাকায় নাভিশ্বাস উঠেছে দেশটির সাধারণ মানুষের।

এই পরিস্থিতিতে জনগণের রোষ স্বাভাবিকভাবেই পড়েছে দেশটির সবচেয়ে ক্ষমতাধর গোষ্ঠী রাজাপাকসে পরিবারের সদস্যদের ওপর। গত কয়েক দশক ধরে দেশটির শাসনব্যবস্থার বিভিন্ন শীর্ষপদে এই পরিবারের মোট ৫ জন সদস্য রয়েছেন এবং শ্রীলঙ্কার রাজনীতি ও অর্থনীতির ওপর প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ আসলে তাদেরই হাতে।

বৃহস্পতিবার শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের বাসভবনের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন বিক্ষোভকারী ও সাংবাদিকসহ ৪৫ জন।

বার্তাসংস্থা এএফপি এই পরিবারের ৫ প্রভাবশালী সদস্যের একটি সংক্ষিপ্ত প্রোফাইল তৈরি করেছে। এ সদস্যরা হলেন— শ্রীলঙ্কার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে, তার তিন ভাই গোতাবায়া, বাসিল ও চামাল রাজাপাকসে এবং মাহিন্দা রাজাপাকসের বড় ছেলে নামাল রাজাপাকসে।

দলনেতা

শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে
শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসে। ছবি : ইন্টারনেট

রাজাপাকসে পরিবারের ক্যারিশম্যাটিক প্রধান বলে মনে করা হয় শ্রীলঙ্কার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপাকসেকে। ৭৬ বছর বয়সী মাহিন্দা প্রথমবারের মতো শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন ২০০৪ সালে। তারপর ২০০৫ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট ছিলেন তিনি।

মাহিন্দা রাজাপাকসে শ্রীলঙ্কার সংখ্যাগরিষ্ঠ সিনহালা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কাছে বেশ জনপ্রিয়; আর তার এই জনপ্রিয়তার মূল কারণ— ২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কার বিচ্ছিন্নতাবাদী তামিল বিদ্রোহীদের দমনে তার নেতৃস্থানীয় ভূমিকা। তবে তিনি নৃশংস সামরিক পন্থায় এ কাজ করেছিলেন বলে অভিযোগ রয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘণের একাধিক অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, গৃহযুদ্ধের শেষ দিকে শ্রীলঙ্কার ‘নো ফায়ার জোন’ এলাকায় দেশটির সেনাবাহিনীর বোমাবর্ষণে প্রায় ৪০ হাজার বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছিলেন। সেই সময় ক্ষমতায় থাকা মাহিন্দা রাজাপক্ষে এই নিহতের সংখ্যা অস্বীকার করেছেন এবং নৃশংসতার ওই অভিযোগ আন্তর্জাতিকভাবে তদন্ত করার বিষয়টিও প্রত্যাখ্যান করেছেন তিনি।

মাহিন্দা রাজাপাকসের শাসনামলে চীনের সঙ্গে সম্পর্ক আরও বেশি ঘনিষ্ট হয়েছে শ্রীলঙ্কার। দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন সময়ে চীনের কাছ থেকে প্রায় ৭০০ কোটি ডলার ঋণও নিয়েছেন মাহিন্দা, তবে তার প্রায় সব উন্নয়ন প্রকল্পে সীমাহীন দুর্নীতি ঘটেছে।

পাশাপাশি, তামিল বিদ্রোহীদের দমন করলেও দেশটির সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধ সম্প্রদায় ও তামিল ভাষাভাষি গোষ্ঠীর মধ্যকার বৈরিতা অবসানে তিনি তেমন কোনো ভূমিকা নেননি। এখন পর্যন্ত তামিলদের প্রায় কোনঠাসা করে রাখা হয়েছে এবং গৃহযুদ্ধে নিহত বিদ্রোহীদের স্মরণ করতে তাদের বাধা দেওয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।

‘দ্য টার্মিনেটর’

শ্রীলঙ্কার বর্তমান প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসে। ছবি : ইন্টারনেট

মাহিন্দার ছোটভাই ও শ্রীলঙ্কার বর্তমান প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসেকে তার পরিবারের সদস্যরাই ডাকেন ‘দ্য টার্মিনেটর’ বা ‘বিধ্বংসী’ নামে। খুব দ্রুত মেজাজ হারান বলে প্রতিপক্ষের লোকজনও ভয় পান ৭২ বছর বয়সী গোতাবায়াকে।

শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট থাকাকালে তার প্রধান সহচর বা লেফটেন্যান্ট ছিলেন গোতাবায়া রাজাপাকসে। দেশটির সরকারের সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব গোতাবায়া তার প্রশাসনিক পদ ব্যবহারের মাধ্যমে দিনের পর দিন ধীরে ধীরে প্রভাব বিস্তার করেছেন শ্রীলঙ্কার সেনাবাহিনী ও পুলিশের ওপর।

গোতাবায়ার বিরুদ্ধে অভিযোগ, প্রতিপক্ষের লোকজনকে গুম করে ফেলার জন্য ‘ডেথ স্কোয়াড’ গঠন করেছিলেন তিনি। তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ‘দ্য টার্মিনেটর’ গোতাবায়া। বর্তমানে শ্রীলঙ্কার প্রেসিডেন্ট পদের পাশাপাশি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ও তার অধীনে।

২০১৯ সালে গোতাবায়া যখন প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব নেন, তখন থেকেই বেশ বিপর্যস্ত ছিল শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি সন্ত্রাসী হামলা ও রাজনৈতিক সংকট দেশটির ওপর মারাত্মকভাবে আঘাত করে।

নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর দ্রুতই কাজে নেমে পড়েন গোতাবায়া। তার সরকার বিভিন্ন খাতে কর ছাড় দেওয়ার পাশাপাশি বাজারে নগদ অর্থ ছাড়তে শুরু করে। এতে মুদ্রাস্ফীতি বাড়তে থাকে এবং কমে আসে কর আদায়। ফলে, বাজেট ঘাটতি আরও বেড়ে যায়।

২০১৬ সালের ইস্টারে বোমা হামলা শ্রীলঙ্কার পর্যটন খাতে ধস নামিয়েছিল। এই ধস আরও দীর্ঘায়িত হয় ২০১৯ সালে করোনা মহামারি শুরু হওয়ার পর। তবে অনেক বিশেষজ্ঞের বক্তব্য, গত কয়েক বছরের বাজেট ঘাটতি, অযৌক্তিকভাবে কর কাটছাঁট এবং সর্বোপরি রাজাপাকসে পরিবারের নেতৃত্বাধীন সরকারের অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনাই বর্তমান সংকটের জন্য দায়ী ।

মি. টেন পার্সেন্ট

শ্রীলঙ্কার বর্তমান অর্থমন্ত্রী বাসিল রাজাপাকসে। ছবি : ইন্টারনেট

মাহিন্দা ও গোতাবায়া রাজাপাকসের ছোটোভাই এবং দেশটির বর্তমান অর্থমন্ত্রী বাসিল রাজাপাকসে (৭০) শ্রীলঙ্কার বর্তমান সরকারের অর্থমন্ত্রীর দায়িত্বে আছেন। তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সরকারি চুক্তি থেকে ১০ শতাংশ কমিশন নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে এবং এ কারণে শ্রীলঙ্কার রাজনীতিতে তিনি মি. টেন পার্সেন্ট নামেও পরিচিত।

এছাড়া আরও অভিযোগ—দেশের বাইরে বিভিন্ন ব্যাংকে লাখ লাখ ডলার পাচারের করেছেন বাসিল। এ ঘটনায় তার বিরুদ্ধে কয়েক দফা তদন্তও হয়েছে, কিন্তু অভিযোগ প্রমাণ করা যায়নি। গোতাবায়া রাজাপাকসে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ তুলে নেওয়া হয়।

‘দ্য বডিগার্ড’

চামাল রাজাপাকসে। ছবি : ইন্টারনেট

রাজাপাকসে ভাইদের মধ্যে বয়সে সবার চেয়ে বড় চামাল রাজাপাকসে (৭৯)। পরিবারের ‘দলনেতা’ মাহিন্দা রাজাপাকসের চেয়ে তিন বছরের বড় তিনি। মাহিন্দা যখন প্রেসিডেন্ট ছিলেন, সে সময় শ্রীলঙ্কার পার্লামেন্টের স্পিকার ছিলেন চামাল। এছাড়া শ্রীলঙ্কার সাবেক জাহাজ পরিচালনা ও বিমান পরিবহন পরিষেবা মন্ত্রীর পদেও ছিলেন তিনি।

বর্তমানে যদিও সরকারের সেচ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী তিনি, কিন্তু তার মূল প্রভাব প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে। গোতাবায়ার পর ওই মন্ত্রণালয়ের দ্বিতীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসেবে মনে করা হয় চামালকে।

পরিবারের উত্তরসূরী

মাহিন্দার বড় ছেলে নামাল রাজাপাকসে। ছবি : ইন্টারনেট

মাহিন্দার বড় ছেলে নামাল রাজাপাকসেকে এই পরিবারের প্রধান উত্তরসূরী হিসেবে মনে করা হয়। ৩৫ বছর বয়সী নামাল পেশায় একজন আইনজীবী। ২০১০ সালে মাত্র ২৪ বছর বয়সে জনপ্রতিনিধি হিসেবে পার্লামেন্টে জনপ্রতিনিধি হিসেবে প্রবেশ করেন তিনি এবং কোনো মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে না থাকলেও বাবার প্রেসিডেন্টের পদের প্রভাব খাটিয়ে নিজেকে ব্যাপক প্রভাবশালী করে তোলেন নামাল।

শ্রীলঙ্কার বর্তমান সরকারের যুব ও ক্রীড়ামন্ত্রী তিনি। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও মুদ্রা পাচারের অভিযোগ থাকলেও বরাবরই তা অস্বীকার করেছেন নামাল রাজাপাকসে।

শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক মহলে গুঞ্জন, নামালকে দেশের ভবিষ্যৎ প্রেসিডেন্ট হিসেবে তৈরি করছেন মাহিন্দা রাজাপাকসে।

শেয়ার করুন