ক্রমবর্ধমান তীব্র অর্থনৈতিক সংকটে অনেকটাই নুয়ে পড়েছে এশিয়ার দ্বীপ রাষ্ট্র শ্রীলঙ্কা। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতার পর থেকে এত খারাপ অবস্থায় আর পড়েনি দেশটি। গত কয়েক বছরে চীন, ভারত ও ইরানসহ অন্যান্য যেসব জায়গা থেকে ঋণ নিয়েছে তা পরিশোধে ব্যর্থতার মুখে পড়েছে দেশটির সরকার। জ্বালানি, খাদ্য, তারল্য সংকট এতটাই চরমে পৌঁছেছে, নিরুপায় হয়ে সরকারের বিরুদ্ধে পথে নেমেছে সাধারণ মানুষ। পরিস্থিতি আরও খারাপের দিকে যাওয়ার আশঙ্কায় জ্বালানি পাম্পসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার বাইরে মোতায়েন করা হয়েছে সেনাবাহিনী।
দেশটির অর্থনৈতিক সঙ্কট কতটা মারাত্মক সেটা বোঝার জন্য গত কয়েক দিনের সংবাদপত্রের দিকে নজর দিলেই বোঝা যায়। কাগজের সঙ্কট এবং দাম বেড়ে যাওয়ায় শনিবার পত্রিকা প্রকাশ করতে পারেনি শ্রীলঙ্কার প্রথম সারির দুটি পত্রিকা। নিউজপ্রিন্ট সঙ্কট ও মূল্যবৃদ্ধির কারণে ইংরেজি দৈনিক ‘দ্য আইল্যান্ড’ ও তার সহ-প্রতিষ্ঠান সিংহলিজ পত্রিকা ‘দিবায়িনা’ ছাপানো বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়া কাগজ কেনার মতো বৈদেশিক মুদ্রা না থাকায় সম্প্রতি সাড়ে ৪ লাখ শিক্ষার্থীর পরীক্ষা বাতিল করতে বাধ্য হয় দেশটির শিক্ষা বিভাগ।
বর্তমানে শ্রীলঙ্কার সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্তরে, সব সূচক উদ্বেগজনক। দেশটির রুপি মার্কিন ডলারের বিপরীতে ২৬৫-তে নেমেছে। আর ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে ভোক্তা মূল্যস্ফীতি ১৬.৮ শতাংশ এবং বৈদেশিক রিজার্ভ ছিল ২৩১ কোটি ডলার। উদ্বেগজনক বিষয় হলো, আগের বৈদেশিক ঋণ গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছে শ্রীলঙ্কার সরকারের। চলতি বছরেই প্রায় ৭০০ কোটি ডলার বৈদেশিক ঋণ অবশ্যই পরিশোধ করতে হবে দেশটিকে। ঋণ পরিশোধের পাশাপাশি দেশের সার্বিক অবস্থা নিয়ন্ত্রণের ব্যয়ও এই মজুত ডলার থেকেই করতে হবে। এর মানে, শ্রীলঙ্কা নিজেকে ‘আর্থিক দেউলিয়া’ ঘোষণার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে।
দেশটির এ দেউলিয়াত্ব ডেকে এনেছে করোনা মহামারি, কয়েক বছর ধরে উল্টোপাল্টা নানা প্রকল্পের জন্য বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের হিড়িক এবং রাতারাতি কৃষি খাতে ‘অর্গানিক ফার্মিং’ চালুর জন্য প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপক্ষের একটি হঠকারী সিদ্ধান্ত। গোতাবায়া দেশের কৃষিবিদ ও বিজ্ঞানীদের সঙ্গে সলাপরামর্শ না করেই সম্পূর্ণ নিজের খামখেয়ালি সিদ্ধান্তে দেশের কৃষিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। কিন্তু মতাদর্শগত অবস্থান থেকে ‘অর্গানিক ফার্মিং’ পদ্ধতি চালুর ঘোষণা দেওয়া এক কথা, আর ধাপে ধাপে পরিকল্পিত বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে তা সফলভাবে চালু করা অনেক কঠিন আরেকটা প্রক্রিয়া—এটা হয়তো তাঁর কিংবা বড় ভাই প্রধানমন্ত্রী মাহিন্দা রাজাপক্ষের বিবেচনায় যথাযথ গুরুত্ব পায়নি! এ কারণে এক অভূতপূর্ব ফলন বিপর্যয়ে পতিত হলো শ্রীলঙ্কার কৃষি খাত। খাদ্যদ্রব্য উৎপাদন এক বছরে বিপর্যয়করভাবে নেমে এল এক-চতুর্থাংশে।
সংকট উত্তরণে অনেক অর্থনীতিবিদ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)-এর সহযোগিতা গ্রহণকে সরকারের ‘একমাত্র’ উপায় বললেও ক্ষমতাসীনরা এই পথে হাঁটতে নারাজ ছিল। সম্প্রতি ব্যাপক বিক্ষোভ ও সমালোচনার মুখে সরকার নীতিগতভাবে ইউটার্ন নিয়েছে। রাজাপাকসে বলেছেন, সরকার এখন বন্ড পরিশোধে উপায় খুঁজে বের করার জন্য আইএমএফ-এর সঙ্গে আলোচনা শুরু করছে। এই মুহূর্তে আইএমএফ শ্রীলঙ্কাকে কীভাবে সহায়তা করবে এবং দেশটির খাদে পড়া অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় কতটা সাহায্য করতে পারবে তা দেখার বিষয়।
শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক দেউলিয়াত্ব থেকে শিক্ষণীয় হলো, সামনের মেগা প্রকল্প নিয়ে আমাদের এখনই ভাবতে হবে। কেননা মেগা প্রকল্পগুলোতে আমরা যে অর্থ বিনিয়োগ করছি, তা যদি সময় মতো ফেরত না আসে, তাহলে আমাদেরও অবস্থাও শ্রীলঙ্কার মতো হতে পারে। আমাদের দেশ এখনও ভাল অবস্থায় আছে। সুতরাং এই ভালো অবস্থাতে থাকার সময়ই ভবিষ্যতের সিদ্ধান্তগুলো নিতে হবে।