প্রস্তাবিত গণমাধ্যমকর্মী আইন যে কারণে সমালোচনায়

হাসান শান্তনু

প্রস্তাবিত ‘গণমাধ্যমকর্মী (চাকরির শর্তাবলি) বিল-২০২২’ কড়া সমালোচনার মুখে পড়েছে৷ গত ২৮ মার্চ জাতীয় সংসদে খসড়া উত্থাপিত হওয়ার পর থেকে পেশাদার সাংবাদিক, সম্পাদকরা এর বিরোধিতা করছেন৷ ফেসবুকসহ সামাজিক যোগাযোগের নানা মাধ্যম থেকে শুরু করে টিভি চ্যানেলের টকশো, পত্রিকার উপসম্পাদকীয়তে তাঁরা সমালোচনামুখর। খসড়ার বিভিন্ন ধারার চুলচেরা বিশ্লেষণ করে তাঁরা বলছেন, পাস হলে তা হয়ে উঠতে পারে সাংবাদিক সমাজ ও গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণের আরেক ‘কালাকানুন’।

সাংবাদিকদের পক্ষে সোচ্চার ‘ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ’ও (টিআইবি)। প্রস্তাবিত আইনে সাংবাদিকদের চাকরির সুরক্ষা, সংশ্লিষ্ট সুবিধা ও অধিকার নিশ্চিত করা হয়নি বলে মন্তব্য টিআইবির। বিলটি সংশোধনের জন্য এককভাবে মালিকপক্ষের ওপর নির্ভরশীল না হয়ে, গণমাধ্যম কর্মী ও সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের সক্রিয় অংশ নেওয়া নিশ্চিতের দাবি জানায় সংস্থাটি।

universel cardiac hospital

সাংবাদিকরা বলছেন, আইনটি কার্যকর হলে সম্পাদকসহ সাংবাদিকদের মর্যাদা কমবে। গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানে সরকারের নিয়ন্ত্রণ, কর্তৃত্ব বাড়তে পারে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের খড়গের সঙ্গে নতুন আইন মিলে সাংবাদিকদের স্বাধীনতায় আরেক বাধা, জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে। তাঁদের মতে, প্রস্তাবিত খসড়া সংশোধন ও বিতর্কিত ধারাগুলো বাদ দেওয়া ছাড়া আইনটি প্রণয়ন হলে সাংবাদিকদের আর্থিক সুযোগ-সুবিধা আরো কমবে।

আইনটি প্রণয়ন হলে চাকরির নিশ্চয়তা, নিরাপত্তা ঠুনকো বিষয়ে পরিণত হতে পারে। সাংবাদিকদের আর্থিক নিরাপত্তা ও সামাজিক মর্যাদা ক্ষুন্ন হবে। তারা তখন ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার হারাবেন। শ্রম আইনের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন।

সাংবাদিক নেতৃত্ব বলছে, গণমাধ্যমকর্মী আইন প্রত্যাশিত। আইন প্রণয়নের দাবিও জানিয়ে আসছেন তাঁরা। এ বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ায় সাংবাদিকরা সরকারের প্রশংসা করেছে। ১৯৭৪ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রাহমানের সরকারের আমলে প্রণীত আইনটিকে ভিত্তি করে সময়োপযোগী আইন প্রণয়ন করতে পারে সরকার।

খসড়ায় কী আছে, তা এতোদিন সাংবাদিক সমাজ জানতে পারেনি। সাংবাদিকতায় দেশের নেতৃত্বস্থানীয় অবস্থানে যাঁরা আছেন, তাঁদেরকেও খসড়া দেওয়া হয়নি। খসড়া চূড়ান্তের সময় দেশের কোনো সম্পাদক, সাংবাদিক নেতার সঙ্গে আলোচনা করা হয়নি।

সাংবাদিক সমাজের অভিযোগ, নতুন করে আইন প্রণয়ন হলে সাধারণত বিদ্যমান সুযোগ-সুবিধার চেয়ে আরো বাড়ানো হয়ে থাকে। প্রস্তাবিত খসড়ায় সাংবাদিকদের সুযোগ-সুবিধা বর্তমানের তুলনায় কমানোর কথা উল্লেখ আছে। এতে তাঁরা ‘বিস্মিত’।

কোনো সাংবাদিককে চাকরিচ্যুত করতে হলে এখন চারমাসের অগ্রিম বেতন দেওয়ার নিয়ম আছে। খসড়ায় তা কমিয়ে একমাসের বেতনের জন্য প্রস্তাব করা হয়। এতে চাকরির ‘নিশ্চয়তায়’ আরো আঘাত আসবে।

খসড়ায় সাংবাদিকদের জন্য দৈনিক ৮ ঘণ্টা হিসাবে সপ্তাহে ৪৮ ঘণ্টা কাজের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। উন্নত বিশ্বজুড়ে সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা কাজের রেওয়াজ আছে। দেশের সরকারি কর্মচারিরা সপ্তাহে ৪০ ঘণ্টা কাজ করেন।

বিভিন্ন গবেষণা বলছে, সাপ্তাহিক কাজের সময় সপ্তাহে ৩০ থেকে ৩২ ঘণ্টা রাখা হলে ফল ভালো পাওয়া যায়। যে কারণে আধুনিক প্রতিষ্ঠানগুলো কর্মীদের সপ্তাহে তিনদিন ছুটি নিতে উৎসাহিত করছে। সাংবাদিকদের সপ্তাহে দুইদিন ছুটি কার্যকরের দাবি ওঠেছে দীর্ঘদিন ধরে।

তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান, সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু গগণমাধ্যমকে এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমরা আইনটি পর্যালোচনা করে দেখব। অংশীজনের সঙ্গে কথা বলবো৷ তারপর আমরা মতামত দেব।’

দৈনিক ভোরের কাগজের সম্পাদক, সম্পাদক পরিষদের সহসভাপতি শ্যামল দত্ত বলেন, ‘খসড়াটি আমি পড়েছি। প্রস্তাবে কিছু সীমাবদ্ধতা আছে। আইনটি পাস হলে গণমাধ্যম এতোদিন যেসব সুবিধা ভোগ করে আসছিল, সেগুলো খর্ব হবে। আমাদের অতীত অভিজ্ঞতা ভালো নয়। সবার সঙ্গে আলোচনা করে ত্রুটিমুক্ত খসড়া যেন প্রস্তুত করা হয়, এ দাবি জানাই।’

গ্লোবাল টিভির প্রধান নির্বাহী কর্মকতা সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বলেন, ‘গণমাধ্যমকর্মী আইনের প্রস্তাবিত খসড়ায় সম্পাদকের ভূমিকা বিলুপ্ত করে দেওয়া হয়েছে। সাংবাদিকদের পরিচয় বিলুপ্ত করা হয়েছে। আমি সাংবাদিকতা করি, আমার পরিচয় থাকতে হবে।’

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘অবাক করার মতো বিষয় হলো, পুরো বিলের কোথাও সম্পাদক শব্দটির উল্লেখ পর্যন্ত নেই। গণমাধ্যমে যে ভিন্ন ভিন্ন পেশাজীবীরা কাজ করেন, সেসবের কোনো উল্লেখ নেই। তাই আইনটি শুধু করতে হবে বলে করা হচ্ছে- এমনটা ভাবা অবান্তর হবে না।’

ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের (বিএফইউজে) সভাপতি ওমর ফারুক এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘প্রস্তাবিত আইনটির ৫৪টি ধারার মধ্যে ৩৭টি ধারাই সাংবাদিকবান্ধব নয়৷ আইনটি মালিকদের সুবিধার জন্য করা হয়েছে৷ আইনটি পাস হলে সাংবাদিকরা রুটি-রুজি, অধিকার আদায়ের জন্য ট্রেড ইউনিয়ন করতে পারবেন না৷ তারা শ্রম আইনের সুবিধা পাবেন না৷’

তিনি বলেন, ‘আগে গ্র্যাচুইটির বিধান ছিল প্রতিবছর দুইটি, এখন একটি করা হয়েছে৷ আগে বিনোদন ছুটি তিনবছরে ৩০ দিন ছিল। তা কেটে ১৫ দিন করা হয়েছে৷ কোনো সাংবাদিক যদি অন্য প্রতিষ্ঠানে কর্মরত সহকর্মীর বিপদে ছুটে যেতে চান, তাকে ছুটি নিয়ে যেতে হবে। তা না হলে শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে৷ খসড়ায় ঢাকার বাইরের সাংবাদিকদের জন্য কিছু বলা হয়নি। যা অসম্পূর্ণ ও ত্রুটিপূর্ণ আইন৷’

কোনো কোনো সাংবাদিক নেতার অভিযোগ, খসড়ায় গণমাধ্যমকর্মী ও মালিকপক্ষের মধ্যে বিরোধ নিরসনে কিছু সুবিধার কথা বলা হলেও তা মূলত মালিকদের স্বার্থ বেশি রক্ষা করবে। যা হয়ে উঠতে পারে মালিকদের কর্তৃত্ব, স্বার্থরক্ষার আইন। তবে মালিকদের কেউ কেউ প্রস্তাবিত খসড়ার অসঙ্গতি দূর করার দাবি জানাচ্ছেন।

সংবাদপত্র মালিকদের সংগঠন ‘নিউজপেপার্স ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের’ (নোয়াব) সভাপতি এ. কে. আজাদ বলেন, ‘সাম্প্রতিক সময়ে কিছু আইন গণমাধ্যমের স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করেছে। এ ক্ষেত্রে বলা হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের কথা। এ আইন নিয়ে অনেকে উদ্বেগের কথা বলেছেন। অতি সম্প্রতি গণমাধ্যমকর্মী আইন সংসদে উঠেছে। আইনটি নিয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্যেই আপত্তি রয়েছে। এমন আইনের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত আলোচনা সাপেক্ষে নেওয়া উচিত।’

শেয়ার করুন