‘তাহলে তো দেশে কোর্ট-কাছারি থাকার দরকার নাই’

নিজস্ব প্রতিবেদক

হাইকোর্ট
ফাইল ছবি

রাজধানী ঢাকার মগবাজারে আদ-দ্বীন হাসপাতালসংলগ্ন এলাকায় বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল হকের সাড়ে ১৯ কাঠা জমি অধিগ্রহণ সংক্রান্ত মামলার শুনানি করতে বারবার সময় নেওয়ায় সরকারপক্ষের ভূমিকা নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করেছেন সর্বোচ্চ আদালত। ১০ বছর আগে ২০১২ সালে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে করা আপিলের শুনানি করতে আজ রোববার সরকারপক্ষ ফের সময় চাইলে এ উষ্মা দেখান প্রধান বিচারপতির নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ। বেঞ্চের অন্য দুই বিচারক হলেন বিচারপতি ওবায়দুল হাসান ও বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম।

আদালতে আপিলের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মেহেদী হাসান চৌধুরী। আর রিটকারী পক্ষে ছিলেন আইনজীবী শেখ আওসাফুর রহমান।

universel cardiac hospital

মামলার নথি থেকে জানা যায়, ১৯৪৫ সালে দেশভাগের সময় বীরেন্দ্রনাথ রায় তার সাড়ে ১৯ কাঠা জমির আমমোক্তার (পাওয়ার অব অ্যাটর্নি) দিয়ে যান স্থানীয় সিরাজুল হককে। এর ২০ বছর পর ১৯৬৫-৬৬ সালে এ জমির খাজনা দিয়ে নিজের নামে নামজারি (মিউটেশন) করান সিরাজুল হক। এরপর দীর্ঘদিন খাজনা না দেওয়ায় ১৯৯৯ সালে সরকার এ জমির খাজনা দাবি করে মামলা করে।

এ মামলার পর ওই বছরের ২৫ জুলাই সিরাজুল হক দুই হাজার ৭৯২ টাকা খাজনা পরিশোধ করে জমি ভোগদখল করতে থাকেন। এর আগে তিনি এ জমিতে থাকা ভবনে বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানির সংযোগ নেন। এভাবেই সিরাজুল হক ও তার পরিবার এ জমির ভোগদখল করে আসছিল। ২০০৮ সালে মারা যান বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল হক। এরপর এই জমির খতিয়ান সংশোধন চেয়ে মামলা করে রাষ্ট্র। পরে ২০০৯ সালের ২৩ জুন রমনা ভূমি অভিস এই জমি অধিগ্রহণের জন্য নোটিস পাঠায়। এই নোটিস পাঠানোর পর ওই বছরের ১৫ নভেম্বর রমনা ভূমি অফিস থেকে আরেকটি নোটিস পাঠানো হয় জমির প্রকৃত মালিক বীরেন্দ্রনাথ রায়কে।

বড় মগবাজার মৌজার আরএস খতিয়ান নং-১, দাগ-২, ০.২৬৪৪ একর (কমবেশি) সম্পত্তির পরিমাণ উল্লেখ করে দেওয়া এ নোটিসে বলা হয়, ‘বিসিএস (প্রশাসন) কল্যাণ বহুমুখী সমবায় সমিতি লিমিটেড-এর অনুকূলে জনকল্যাণমূলক কার্যক্রম এবং সদস্যদের আবাসন সুবিধার জন্য স্থায়ী অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্দেশ্যে এবং জনস্বার্থে প্রয়োজন। ’ নোটিসে জমির দাম উল্লেখ করা হয় দুই কোটি ৯৮ লাখ ৬৫ হাজার ৫২৯ টাকা।

এ নোটিসের পরপরই জমি অধগ্রহণের গেজেটও জারি করা হয়। গেজেট জারির কিছুদিন পর জমির ভোগদখলকারী সিরাজুল হকের পরিবারকে উচ্ছেদ করে প্রশাসন। এরপর ২০১০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি জমি অধিগ্রহণের গেজেট চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন সিরাজুল হকের স্ত্রী মালেকা সিরাজ তার পাঁচ সন্তান। এই রিটের শুনানি শেষে হাইকোর্ট ২০১১ সালে গেজেট বাতিল ও জমি অধিগ্রহণ অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন।

হাইকোর্টের এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের অনুমতি (লিভটু আপিল) চেয়ে ওই বছরই আবেদন করে সরকার। চেম্বার আদালত প্রথমে আদেশ না দিলেও পরে হাইকোর্টের আদেশে স্থিতাবস্থা (স্টেটাস কো) দেন। তখন চেম্বার বিচারপতি ছিলেন সাবেক প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। পরে হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হলে সরকার ২০১২ সালে রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে। ছয় মাস ধরে মামলাটি আপিল বিভাগের কার্যাতালিকায় থাকলেও সরকারপক্ষ শুনানি করেনি। এর মধ্যে রিটকারী পক্ষ শুনানি করেছে। আজ সরকারপক্ষের আইনজীবী শুনানির জন্য ফের সময় চাইলে আদালত উষ্মা প্রকাশ করে বলেন, ১০ বছরেও একটা মামলার প্রস্তুতি নিতে পারেন না, এটা লজ্জার। এটা হতে পারে না। তাহলে আমাদের এখানে (এজলাসে) বসে থেকে লাভ কী!

সারকারপক্ষের আইনজীবীদের উদ্দেশ করে আদালত আরও বলেন, যাদের ভিটেমাটি আগে তো তাদের কথা ভাবতে হবে। একজনের ভিটেমাটি নিয়ে যাবেন, তা তো হতে পারে না। তাহলে তো দেশে কোর্ট-কাছারি থাকার দরকার নাই ।

অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মেহেদী হাসান চৌধুরী তখন আপিলটি নিষ্পত্তি করে দিতে বললে উষ্মা প্রকাশ করে বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিম বলেন, আমরা নিষ্পত্তি করব কি করব না, এই সিদ্ধান্ত আমরা নেব। আপনার কাছ থেকে শুনে সিদ্ধান্ত নিতে হবে?

এ সময় সংবিধানের ৪২ অনুচ্ছেদ উল্লেখ করে বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, এভাবে সময় নিলে তো সম্পত্তিতে জনগণের অধিকার থাকে না। জনগণের সম্পত্তির সুরক্ষাই যদি না থাকে, তাহলে আদালত থেকে লাভ কী? আদালত বলে তো কিছু থাকল না। আমরা যদি এভাবে অ্যালাও (সময়ের আবেদন) করতে থাকি…।

এরপর আদালত মামলাটির শুনানি নট টুডে (আজ নয়) করেন।

সংবিধানের ৪২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আইনের দ্বারা আরোপিত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে প্রত্যেক নাগরিকের সম্পত্তি অর্জন, ধারণ, হস্তান্তর বা অন্যভাবে বিলি-ব্যবস্থা করিবার অধিকার থাকিবে এবং আইনের কর্তৃত্ব ব্যতীত কোন সম্পত্তি বাধ্যতামূলকভাবে গ্রহণ, রাষ্ট্রায়ত্ত বা দখল করা যাইবে না।

বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজুল হকের পরিবারের আইনজীবী শেখ আওসাফুর রহমান বলেন, ২০১২ সালে আপিল করার পর এখন পর্যান্ত শুনানি করেনি সরকারপক্ষ। গত বছর আগস্টে প্রধান বিচারপতিকে সব বলার পর আপিলটি শুনানির জন্য কার্যতালিকায় আসে। কিন্তু সরকারপক্ষ বারবার সময় নেওয়ায় আর শুনানি হচ্ছিল না। অবকাশের দুই সপ্তাহ আগে সর্বশেষ সময় নেয় সরকারপক্ষ। আজকে আবার সময় নিতে এলে আদালত উষ্মা প্রকাশ করেছেন।

শেয়ার করুন