রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে প্রায় এক যুগ ধরে সংঘবদ্ধ ডাকাতি করতেন তারা। ব্যাংক ও জুয়েলারিতে ডাকাতির পর মালামাল ভাগাভাগি করে চলে যেতেন প্রত্যন্ত গ্রামে। সেখানে ছদ্মবেশে দীর্ঘদিন থাকার পর আবারও নতুন পরিকল্পনা নিয়ে এক হতেন। দুর্ধর্ষ বেশ কয়েকটি ডাকাতির পরও তারা ছিলেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাদের ডাকাতির কৌশল যেন হার মানাবে সিনেমার গল্পকেও!
গোপন তথ্যের ভিত্তিতে এ ডাকাতি ও লুটচক্রের মূলহোতা রাজা মিয়াসহ তিনজনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব। সোমবার র্যাব সদরদপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র্যাব-৪ এর দুটি বিশেষ আভিযানিক দল মুন্সীগঞ্জ ও বরিশালে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে।
তারা হলেন- চক্রের মূলহোতা মো. কাউসার হোসেন ওরফে বাচ্চু মাস্টার, তার সহযোগী মো. রাজা মিয়া ও মো. মাসুদ খান। তাদের কাছ থেকে ১৯ দশমিক ৭০ গ্রাম স্বর্ণ ও নগদ তিন লাখ ২৯ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়েছে।
গত ৪ ফেব্রুয়ারি রাতে রাজধানীর কচুক্ষেতের রজনীগন্ধা টাওয়ারের নিচতলায় রাঙাপরী জুয়েলার্সে দুর্ধর্ষ ডাকাতির ঘটনা ঘটে। ওইদিন ৩০০ ভরি স্বর্ণ লুট হয়। এ ঘটনায় জুয়েলার্সটির মালিক আবুল কালাম ভূঁইয়া ভাষানটেক থানায় মামলা করেন। পরে র্যাব ঘটনার তথ্য-উপাত্ত ও সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে আসামি শনাক্তের কাজ এবং গোয়েন্দা নজরদারি শুরু করে।
মঙ্গলবার দুপুরে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এসব তথ্য জানান।
র্যাব জানায়, অভিযুক্তরা ইতোপূর্বে বিভিন্ন মামলায় র্যাবের হাতে একাধিকবার আটকের পর বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগ করেন। এ চক্রটির অপরাধের ধরন বিশ্লেষণে দেখা যায়, তারা প্রথমে ভুয়া জাতীয় পরিচয়পত্র, নাগরিক সনদপত্র ইত্যাদি ব্যবহার করে মিথ্যা পরিচয় দিয়ে তাদের দোকানসমূহে মার্কেটের নিরাপত্তাকর্মী, পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে যোগদান করে বা দোকান ভাড়া নেন। পরবর্তীতে স্বর্ণালঙ্কার লুট করার পর তারা আত্মগোপনে চলে যান ও নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বন্ধ করে দেন। বেশভুষা পাল্টে নিজেদের মতো করে থাকেন। পর্যায়ক্রমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে তারা কিছুদিন পর নতুন লক্ষ্যবস্তু ঠিক করার জন্য আবারও যোগাযোগ করে।
র্যাব মুখপাত্র কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ২০১৪ সালে ব্র্যাক ব্যাংকের জয়পুরহাট শাখার ভল্ট ভেঙে এক কোটি ৯৫ লাখ টাকা লুট করে এই চক্রটি। এ ঘটনায় তারা ব্যাংকের পাশের একটি ঘরে এনজিও’র নামে মিথ্যা পরিচয়ে ভাড়া নেয়। ভল্ট লুটের এক সপ্তাহ আগে থেকে স্ক্রু ড্রাইভার ও শাবল দিয়ে দেয়াল কেটে ব্যাংকের ভল্টে ঢুকে ওই টাকা লুট করে পালিয়ে যান। পরে র্যাবের অভিযানে রাজা মিয়াসহ সাতজন গ্রেপ্তার হয়। ওই ঘটনায় রাজা মিয়া তিন বছর কারাভোগ করে। একইভাবে তারা ২০১৮ সালে সিদ্ধিরগঞ্জে দুটি স্বর্ণের দোকানে ডাকাতি করে ৪৫৫ ভরি স্বর্ণ ও দুই লাখ টাকা লুট করে। র্যাবের অভিযানে তারা তিনজন গ্রেপ্তার হন এবং কারাভোগ করেন।
জিজ্ঞাসাবাদে অভিযুক্তরা আরও জানান, তারা ২০২০ সালে ডেমরার হাজী হোসেন প্লাজায় স্বর্ণের দোকানে ডাকাতি করে ২৩০ ভরি স্বর্ণ ও দেড় লাখ টাকা লুটে নেন। এ ঘটনার দুই মাস আগে এ চক্রের তিন সদস্য মিথ্যা পরিচয়ে একটি সিকিউরিটি কোম্পানির নিরাপত্তারক্ষী হিসেবে মার্কেটের নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে যোগ দেন।
র্যাব জানায়, এ চক্রের সদস্য সংখ্যা ৮-১০ জন। গ্রেপ্তার কাউসার রজনীগন্ধা মার্কেটে স্বর্ণের দোকান লুটের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ঘটনার দেড় মাস আগে ওই মার্কেটে ভুয়া পরিচয়ে একটি দোকান ভাড়া নেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি ভাড়া করা দোকানে নামসর্বস্ব মালামাল রেখে কৌশলে চুরির কাজে ব্যবহৃত বিভিন্ন সরঞ্জাম মজুদ করেন।
খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী চক্রের মূলহোতা গ্রেপ্তার রাজা মিয়া ও তার সহযোগী কাউসার মাস্টারসহ অজ্ঞাত আরও তিন-পাঁচজন সদস্য রাত ১২টার দিকে মিরপুর-১৪, গোলচত্ত্বর একত্রিত হন। গ্রেপ্তার মাসুদ তাদেরকে রাত ১টার দিকে মার্কেটে যেতে বলেন। এসময়ের মধ্যে গ্রেপ্তার মাসুদ মার্কেটের অন্যান্য নিরাপত্তাকর্মীদের কৌশলে খাবার ও পানীয়ের সঙ্গে চেতনানাশক সেবন করিয়ে তাদেরকে অচেতন করেন। অন্যরা মার্কেটের সামনে এলে মাসুদ ও তার এক সহযোগী গেটের তালা খুলে তাদেরকে কাউসারের ভাড়া করা দোকানের ভেতর নিয়ে যান। কাউসার মাস্টার ও তার এক সহযোগী মার্কেটের বাইরের চারপাশ নজরদারিতে থাকেন। রাত ২টার দিকে কাউসার মাস্টারের দোকানে আগে থেকে মজুত করে রাখা তালা ভাঙার যন্ত্রপাতি দিয়ে দুটি দোকানের তালা এবং শাটার ভেঙে রাজা মিয়াসহ আরও দুই-তিনজন দোকানের ভেতর প্রবেশ করেন। দোকানের ভেতর থাকা স্বর্ণালঙ্কার ও নগদ টাকা লুট করে তাদের ভাড়া করা দোকানে নিয়ে যান। এসময়ে মাসুদ দোকানের বাইরে পাহারা দেন। দোকান লুটের ঘটনা যেন বোঝা না যায়, সেজন্য তারা দোকানে নতুন তালা লাগিয়ে দিয়ে যান। এরপর ভোরে লুট করা স্বর্ণ নিয়ে কেরানীগঞ্জে কাউসার মাস্টারের ভাড়া বাসায় নিয়ে যান।
কে এই রাজা মিয়া?
রাজা মিয়া ১৯৯০ সাল থেকে বাসের কন্ডাক্টরের কাজ করতেন। ২০০২ সালে সংঘবদ্ধ চক্রটির সঙ্গে তার সখ্যতা গড়ে ওঠে এবং সেই থেকেই তিনি অপরাধে জগতে ঢুকে পড়েন। পরে তিনি অটোরিকশা চালানো শুরু করেন। এর আড়ালে ডাকাতির উদ্দেশে বিভিন্ন মার্কেটে রেকি করতেন। রাজা মিয়া একজন দক্ষ তালা-চাবির মেকার। তিনি অর্ধশতাধিক চুরি ও ডাকাতিতে জড়িত বলে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন। তার নামে চুরি ও ডাকাতি সংক্রান্ত দুটি মামলা রয়েছে। তিনি কারাভোগও করেছেন।