পুলিশের যে কারণে ‘মৌলবাদী আচরণের’ প্রবণতা!

হাসান শান্তনু

কপালে টিপ পরায় ঢাকার তেজগাঁও কলেজের প্রভাষক লতা সমাদ্দারকে পুলিশের এক কনস্টেবলের ‘হয়রানি ও হত্যাচেষ্টার’ ঘটনা, ওই কনস্টেবলের পক্ষ নিয়ে আরেক পুলিশ কর্মকর্তার ফেসবুকে দেওয়া ‘প্রতিক্রিয়াশীল স্ট্যাটাস’ নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। জননিরাপত্তায় নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের এ রকম ‘কট্টর আচরণ ও মৌলবাদী চিন্তাধারণের বিষয়গুলো’ প্রায়ই আলোচনায় আসে। বিশেষজ্ঞদের মতে, পুলিশ প্রশাসনে সাম্প্রদায়িক মানসিকতার ব্যক্তিরা বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বের চারদলীয় জোট সরকারের আমলসহ বিভিন্ন সময় নিয়োগ পেয়েছেন।

তাঁদের মতে, মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ দমন ও নিয়ন্ত্রণে গত একদশকে পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকা প্রশংসার দাবি রাখে। জঙ্গিদের ধরতে গিয়ে পুলিশের প্রাণ দেওয়া, জীবনের ঝুঁকি নেওয়ার ঘটনাও আছে। প্রগতিশীল চিন্তাচেতনায় বিশ্বাসী কর্মকর্তাদেরকে প্রশাসনের শীর্ষপদগুলোতে দায়িত্বে রাখার বিষয়টি সরকার গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করে। পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ও ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কমিশনার শফিকুল ইসলামসহ শীর্ষপদের আরো কয়েক কর্মকর্তা বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছেন সাধারণ সদস্যদের মানবাধিকার বোধ উন্নতকরণের লক্ষ্যে।

গত একযুগের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের মানবাধিকারের ওপর প্রশিক্ষণের নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে দেশি-বিদেশি সহযোগিতায়। এসব প্রশিক্ষণের গভীর ও সুদূরপ্রসারী প্রভাব সাধারণভাবে বাহিনীর সদস্যদের আচরণে প্রতিফলিত কতোটুকু হয়, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে বিশেষজ্ঞদের। তবে ঢালাও নয়, পুলিশ প্রশাসনের একটা অংশের বিভিন্ন সময়ের ‘মৌলবাদী আচরণগুলোকেই’ অভিযুক্ত করেন বিশেষজ্ঞরা।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ (সদর ও বিজয়নগর) আসন থেকে নির্বাচিত ও জনপ্রিয় সংসদ সদস্য র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী গত বছরের অক্টোবরে অভিযোগ করেন, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রশাসন হেফাজতের দাস। প্রশাসন হেফাজতের নির্দেশে চলে। কাকে ছাড়বে, কাকে ধরবে, সেটা পুলিশকে নির্দেশ করে হেফাজত।’ বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মোকতাদির চৌধুরীর ওই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে প্রশাসনের ‘মৌলবাদী আচরণের’ চিত্র ফুটে ওঠে।

প্রখ্যাত সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘দেশের প্রশাসনে, বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীতে সাম্প্রদায়িকতা আছে কী না, তা নিয়ে কখনো কোনো জরিপ হয়েছে বলে আমার জানা নেই। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি- যখন যে দল ক্ষমতায় এসেছে, দাবি করেছে- তাদের প্রশাসন, পুলিশ বিভাগ ধোয়া তুলসীপাতা। তারা সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতামুক্ত। এ দাবি সঠিক হলে আমরা খুশি হতাম। সরকারের দাবি এক, বাস্তবতা বলে অন্য কথা।’

তিনি বলেন, ‘ব্রিটিশ সরকার স্বীকার করে, তাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে এখনো বর্ণবাদী প্রবণতা আছে। প্রায়ই এ বাহিনীর মধ্য থেকেই রেসিজমের (বর্ণবাদ) অভিযোগ ওঠে। এখন তো ব্রিটিশ রাজপরিবারেই রেসিজম বা বর্ণবাদের রোগ আছে বলে অভিযোগ উঠেছে।’

‘সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের’ (সিপিডি) বিশেষ ফেলো, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, ‘দেশের সংবিধানে ধর্ম এসেছে। রাজনীতিতে ধর্মের ব্যবহার এসেছে। পরবর্তীকালে দেশে সংকীর্ণ রাজনীতির স্বার্থে ধর্মীয় অপশক্তির সঙ্গে যেসব মীমাংসা হয়েছে বা প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে, সেই প্রবণতার কারণে আজকে এই পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে।’

সাবেক তত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা, মানবাধিকার নেত্রী সুলতানা কামাল বলেন, ‘লতা সমাদ্দারের ঘটনায় দুঃখজনকভাবে আবারো প্রতীয়মান হলো, আমাদের রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সদস্যদের মধ্যেও জাতি, ধর্ম কিংবা যে কোনো পরিচয়নির্বিশেষে সেবা প্রদান ও সম্মান প্রদর্শনের নিরপেক্ষ মানসিকতা ও সংস্কৃতিবোধের কী প্রকট অভাব বিদ্যমান। একটি ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়তে আমরা কতোটা ব্যর্থ, এ ঘটনা সেটাই জানান দিচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের জেন্ডার প্রশিক্ষণ, বা মানবাধিকারের ওপর প্রশিক্ষণের নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে দেশি-বিদেশি সহযোগিতায়। যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গেই এসবের আয়োজন করা হয়েছে। একটা সময় বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠনকেও প্রশিক্ষণের সঙ্গে যুক্ত করা হয়েছে। কিছু কিছু মডেল থানা ও ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টারে নিগৃহীত নারীরা ভালো আচরণ পেয়েছেন। আমার অভিজ্ঞতায় মানবাধিকারের কাজে পুলিশ বাহিনীর অনেকের উল্লেখযোগ্য সহযোগিতা পেয়েছি। তবে তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যক্তিনির্ভর।’

তিনি বলেন, ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে এই প্রশিক্ষণের গভীর, সুদূরপ্রসারী বা ব্যাপক কোনো প্রভাব সাধারণভাবে বাহিনীর সদস্যদের আচরণে প্রতিফলিত হতে দেখা যায় না। ইদানীং আন্দোলনরত কিছু নারী ভুক্তভোগী জানান, নারী-পুরুষনির্বিশেষে পুলিশ সদস্যরা যেভাবে শারীরিক আঘাত করেন তাঁদেরকে, তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।’

‘আমরাই পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটির’ কো-চেয়ারপারসন শাহীন আনাম বলেন, ‘লতা সমাদ্দারের সঙ্গে জননিরাপত্তায় নিয়োজিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য সংবিধান ও মুক্তিযুদ্ধপরিপন্থী আচরণ করেছেন। দীর্ঘদিন ধরে এ ধরনের বাহিনীতে নারীর প্রতি কট্টর ও মৌলবাদী চিন্তাধারণ করা ব্যক্তিদের নিয়োগ দেওয়ার ফলে এ ঘটনা ঘটেছে।’

টিপকাণ্ডের প্রতিবাদ জানিয়ে ‘হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ’ এক বিবৃতিতে বলে, ‘লতা সমাদ্দারের ওপর সংঘটিত ঘটনা পুলিশ প্রশাসনের একাংশের চলমান সাম্প্রদায়িকতার নগ্ন রূপ। মুক্তিযুদ্ধের সরকার ও প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সাম্প্রদায়িকতা আজ মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে কুরে কুরে খাচ্ছে। এ থেকে মুক্তি না পেলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিশ্চিতভাবেই অন্ধকার।’

গত শনিবার পুলিশের ‘হেনস্তার শিকার হওয়ার’ কথা জানিয়ে তেজগাঁও কলেজের থিয়েটার অ্যান্ড মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের প্রভাষক লতা সমাদ্দার ঢাকার শেরেবাংলা নগর থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। প্রতিবাদের মুখে অভিযুক্ত পুলিশ কনস্টেবলকে ‘সাময়িক বরখাস্ত’ করা হয়। টিপ পরা নিয়ে ফেসবুকে ‘আপত্তিকর পোস্ট’ দেওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সিলেট জেলার কোর্ট পরিদর্শক লিয়াকত আলীকেও গতকাল সোমবার রাতে প্রত্যাহার করা হয়।

শেয়ার করুন