অভিনেতা সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলার দ্বিতীয় আসামি এখন সরকারদলীয় ‘বড় নেতা’!

হাসান শান্তনু

ঢাকার সিনেমার একসময়ের দর্শকনন্দিত অভিনেতা সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলার অন্যতম আসামি ও কুখ্যাত সন্ত্রাসী ফারুক সরকার আব্বাসী এখন সরকারদলীয় ‘বড় নেতা’! বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পদে থাকা আব্বাসীর গত বেশ কয়েক বছর ধরে পরিচয় কথিত ‘আওয়ামী লীগার’ হিসেবে।

নারায়ণগঞ্জের একসঙ্গে তিনজনকে হত্যাসহ কমপক্ষে ছয়টি হত্যা মামলার এ আসামি আওয়ামী লীগের টিকিটে কুমিল্লার মেঘনা উপজেলার ভাওরখোলা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান ‘নির্বাচিত’ হন। তিনি ওই ইউপির তিনবারের সাবেক চেয়ারম্যান।

পুরান ঢাকার একসময়ের ‘শুটার আব্বাসী’, বা ‘কিলার আব্বাসী’ চেয়ারম্যান হওয়ার পর এলাকায় তার বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টা, হামলা, দখল, চাঁদাবাজির বিস্তর অভিযোগ ওঠে। বিভিন্ন অপকর্মে গণমাধ্যমের শিরোনাম হন। এতে ‘বিব্রতকর অবস্থায়’ পড়ে কুমিল্লা জেলা আওয়ামী লীগ। গত বছরও তার বিরুদ্ধে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বীর বাড়িতে হামলা চালিয়ে ওই পরিবারের এক নারীকে হত্যার অভিযোগ ওঠে। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতা ও মন্ত্রিসভার প্রভাবশালী এক সদস্যের প্রশ্রয় ও মদদে আব্বাসী এলাকায় ভয়াল সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন বলে অভিযোগ আছে।

আওয়ামী লীগের সমর্থিত প্রার্থী হিসেবে ২০১৬ সালে ভাওরখোলা ইউপির নির্বাচনে চেয়ারম্যান হন আব্বাসী। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা মত ও পথকে জানান, দলে আব্বাসীর কখনো কোনো পদ ছিল না। তিনি কী করে নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সমর্থন পান, তা নিয়ে তখন সবাই ‘বিস্মিত’ হন। অবশ্য প্রভাবশালী ওই মন্ত্রীর সঙ্গে সখ্যতার কথা তিনি অনুসারীদের কাছে প্রকাশ্যেই বলতেন।

গোয়েন্দা সূত্র বুধবার দুপুরে মত ও পথকে জানায়, গত নব্বইয়ের দশকে ফারুক আব্বাসী ঢাকার হাজারীবাগে ট্যানারিতে কাজ করতেন। সেখান থেকে অপরাধজগতে পা রাখেন। ১৯৯৮ সালের ডিসেম্বরে ঢাকার বনানীর ট্রাম্পস ক্লাবে হত্যা করা হয় অভিনেতা সোহেল চৌধুরীকে। ওই হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার হন তিনি।

১৯৯৯ সালের ৩০ জুলাই ওই মামলার অভিযোগপত্র দেয় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। অভিযোগপত্রে আলোচিত ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাইসহ নয়জনকে আসামি করা হয়। ফারুক আব্বাসীর নাম রয়েছে দুই নম্বরে। ওই মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, হাজারীবাগকেন্দ্রিক অপরাধী চক্রের মাধ্যমে ‘শুটার’ হিসেবে সোহেল চৌধুরী হত্যাকাণ্ডে অংশ নেন আব্বাসী।

গোয়েন্দা সূত্র মত ও পথকে নিশ্চিত করে, সোহেল চৌধুরী হত্যা মামলায় কিছুদিন কারাগারে ছিলেন আব্বাসী। এরপর জামিনে বেরিয়ে তিনি একপর্যায়ে ঢাকা ছেড়ে চলে যান মেঘনার নিজ বাড়িতে। গ্রামে গড়ে তোলেন সন্ত্রাসী বাহিনী। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর তিনি বিএনপিতে যোগ দেন। হাওয়াভবনের ঘনিষ্ঠনেতা হয়ে ওঠেন। বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় জোট সরকারের আমলে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে তিনি হাওয়াভবনের মদদ পান।

২০০৩ সালে প্রথমবারের মতো ভাওরখোলা ইউপি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে আবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এরপর সরকার পরিবর্তন হলে তিনি আওয়ামী লীগের এলাকার রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন। ২০১৬ সালে ভাওরখোলা ইউনিয়নের সর্বশেষ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের সমর্থন পেয়ে চেয়ারম্যান হন।

জানা যায়, ১৯৯০ সালের দিকে ফারুক আব্বাসী অভাব-অনটনের কারণে বিষপান করে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। পরে এলাকা ছেড়ে চলে আসেন ঢাকায়, আশ্রয় নেন হাজারীবাগ এলাকায়। ট্যানারিতে কাজ শুরু করেন। একপর্যায়ে পুরান ঢাকার ট্যানারি কারখানাগুলোতে চাঁদাবাজি শুরু করেন। ধীরে ধীরে অপরাধ জগতের ‘ডন’ হয়ে ওঠেন। ঢাকার শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তালিকায় নাম ওঠে তার।

২০০৫ সালে নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ের নামকরা পরিবার সুলতান হাজির ছেলে মিজানুর রহমানের সঙ্গে ফারুক আব্বাসীর ছোট বোন লাকি আক্তারের বিয়ে হয়। একপর্যায়ে ওই পরিবারের সঙ্গে দ্বন্দ্বের জেরে সুলতান হাজির মেয়ে ও দুই নাতিকে ঢাকায় নিয়ে হত্যা করে মরদেহ ডাস্টবিনে ফেলে রাখেন বলে অভিযোগ ওঠে আব্বাসীর বিরুদ্ধে। ওই ঘটনায় তার নামে হত্যা মামলা হয়। বিএনপি সরকারের আমলে রাজনৈতিক বিবেচনায় ওই মামলা থেকে অব্যাহতি পান তিনি।

হত্যা ও অস্ত্র মামলার প্রধান আসামি হওয়ায় আব্বাসীকে ইউপি চেয়ারম্যানের পদ থেকে গত বছর স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় ‘সাময়িক বরখাস্ত’ করে। ওই বছরের ১৩ এপ্রিল স্থানীয় সরকার বিভাগের উপসচিব আবুজাফর রিপন স্বাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে তাকে বরখাস্ত করা হয়। এক নারীকে হত্যা মামলায় গত বছর গ্রেপ্তার হন আব্বাসী। পরে জামিনে বেরিয়ে আসেন।

২৩ বছর আগে চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরীকে হত্যার ঘটনায় আশীষ রায় চৌধুরী বোতলকে গতকাল মঙ্গলবার রাত ১১টার দিকে ঢাকার গুলশানের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব। গত ২৪ মার্চ এ মামলায় আদালতে হাজিরা দেন জামিনে থাকা আসামি ফারুক আব্বাসী।

১৯৮৪ সালে এফডিসির ‘নতুন মুখের সন্ধানে’ শিরোনামের প্রতিযোগিতার মাধ্যমে চলচ্চিত্র জগতে পা রাখেন সোহেল চৌধুরী। ওই একই প্রতিযোগিতায় নির্বাচিত হয়েছিলেন তাঁর সাবেক স্ত্রী, অভিনেত্রী দিতিও। হত্যাকাণ্ডের পর তাঁর ভাই তৌহিদুল ইসলাম চৌধুরী গুলশান থানায় মামলা করেন। ওই হত্যাকাণ্ডে বিতর্কিত চলচ্চিত্র প্রযোজক ও ব্যবসায়ী আজিজ মোহাম্মদ ভাইয়ের সম্পৃক্ততার অভিযোগ ওঠে।

শেয়ার করুন