প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগের ভয়াবহ দৃশ্যপট পর্যালোচনায় বায়ুদূষণ কঠিন এক বাস্তবতায় নিপতিত। সমকালীন সময়ে দেশ ও বিশ্বপরিমণ্ডলে বায়ুদূষণের প্রভাব সচল জীবনযাত্রার অনুষঙ্গগুলোকে তীব্র চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। দূষণ নিয়ন্ত্রণে দ্রুততার সঙ্গে কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়ন ও প্রায়োগিক পন্থা অবলম্বন অতি জরুরি হয়ে পড়েছে। ২২ মার্চ ২০২২ গণমাধ্যমে প্রকাশিত সুইজারল্যান্ডের দূষণ প্রযুক্তি সংস্থা আইকিউএয়ারের ‘বিশ্ব বায়ুমান সমীক্ষা ২০২১’ প্রতিবেদন অনুসারে বায়ুদূষণে বাংলাদেশ আবারও শীর্ষে এবং রাজধানী ঢাকা দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। বিশ্বের ছয় হাজার ৪৭৫টি শহরের দূষণের তথ্যভিত্তিক এই সমীক্ষায় দেখা যায়, একটি দেশও ২০২১ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রত্যাশিত বায়ুমানের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ করতে পারেনি। জরিপ করা শহরগুলোর মধ্যে মাত্র ৩ দশমিক ৪ শতাংশ শহর ২০২১ সালের লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সক্ষম হয়েছে।
সর্বজনস্বীকৃত বিষয়, দূষিত বাতাসে কাচ-ধোঁয়া বা ধুলার ন্যায় কঠিন ও তরল পদার্থ উড়ে বেড়ায়; যেগুলোকে ‘বস্তুকণা’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এসব বস্তুকণার মধ্যে সবচেয়ে প্রাণঘাতী হলো পিএম ২.৫। বস্তুত পিএম বা পার্টিকুলেট ম্যাটার হচ্ছে বাতাসে ভেসে বেড়ানো কঠিন ও তরল পদার্থে মিশ্রণ যা অণুবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়া খালি চোখে দেখা যায় না। এগুলো খুব সহজে নিঃশ্বাসের সঙ্গে আমাদের শরীরে প্রবেশ করে স্বাস্থ্যের ওপর বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলতে পারে। বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক উপাদানের সমন্ব্বয়ে পিএম তৈরি হতে পারে।
মূলত বায়ুদূষণ ও বায়ুর গুণগত মানের সঙ্গে মানুষের স্বাস্থ্যের সম্পর্ক নিয়ে বিশ্বাসযোগ্য-উচ্চ মানসম্পন্ন বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রকাশে নিয়োজিত যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বরে প্রকাশিত ‘রোগের বৈশ্বিক বোঝা- বায়ুদূষণের মূল উৎসগুলো’ শীর্ষক বৈশ্বিক গবেষণায় জানা যায়, রান্নার চুলায় (স্টোভ) পোড়ানো কয়লা-কাঠ-গোবর ও শস্যের ফেলে দেওয়া অংশ থেকে সৃষ্ট ধোঁয়ায় ২০১৭ সালে বিশ্বে প্রায় ১৮ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। ২০১৭ সালে অ্যামবিয়েন্ট (আউটডোর) পিএম ২.৫-এর কারণে বাংলাদেশে ৬৩ হাজার ৭১৮ জন প্রাণ হারিয়েছেন। বাংলাদেশে বায়ুদূষণের অন্যতম মূল উপকরণ পিএম ২.৫ এর সর্বাপেক্ষা বড় উৎস হলো ঘরে ব্যবহূত জ্বালানি। প্রতিবেদন মতে, বাংলাদেশের চুলাগুলো দীর্ঘদিন ধরে রান্নার দায়িত্বে থাকা নারীদের জন্য গুরুতর ঝুঁকির কারণ হয়েছে। পরিবেষ্টিত বায়ুদূষণের ২৮ দশমিক ২ শতাংশ আসে গৃহস্থালি জ্বালানি থেকে এবং বিদ্যুৎ থেকে আসে ১২ দশমিক ৪ শতাংশ।
বায়ুদূষণের কারণে সারাবিশ্বে মানুষের গড় আয়ু কমেছে প্রায় তিন বছর এবং অকালে মারা যাচ্ছে প্রায় ৮৮ লাখ মানুষ। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- তেল, গ্যাস, কয়লা ও জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে উৎপন্ন দূষণ সৃষ্টিকারী কণার প্রভাব মানুষের ফুসফুসে প্রায় এক বছর পর্যন্ত থাকতে পারে। ২২ সেপ্টেম্বর ২০২১ বাতাসের গুণগত মান পরিমাপের মানদণ্ড ‘এয়ার কোয়ালিটি গাইডলাইনস (একিউজিস)’ আরও কঠোর করায় বাংলাদেশের নিরাপদ বায়ু নিশ্চিত করা অধিক কঠিন হয়ে দাঁড়াবে বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্নিষ্টরা।
নতুন নীতিমালায় বায়ুদূষণকারী তিনটি মূল উপকরণ পার্টিকুলেট ম্যাটার (পিএম) ২.৫, পিএম১০ ও নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডের (এনও২) গ্রহণযোগ্য মাত্রা কমানো হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বিশ্নেষণ অনুযায়ী, পিএম ২.৫-এর ফলে সারাবিশ্বে যত মানুষ মারা যায়. তার ৮০ শতাংশই প্রতিরোধ সম্ভব হবে যদি প্রস্তাবিত একিউজিস অনুসারে বায়ুদূষণের মাত্রা কমিয়ে আনা যায়। সবচেয়ে বেশি সুফল পাবে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও আফ্রিকা অঞ্চল। এই একিউজিস বাস্তবায়ন করা হলে অধিক জনসংখ্যা ও পিএম ২.৫ সমৃদ্ধ দেশগুলোতে রোগে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা কমবে এবং তারা সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবে।
পরিবেশ মন্ত্রণালয় বায়ুদূষণের জন্য ২০টি কারণ চিহ্নিত করেছে। কারণগুলো হলো- ইটভাটা, রাস্তা নির্মাণ-পুনর্নির্মাণ-মেরামত, সেবা সংস্থাগুলোর নির্মাণকাজ ও রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি, বড় উন্নয়ন প্রকল্প (এক্সপ্রেসওয়ে, মেট্রোরেল), সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বহুতল ভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ, সড়ক বা মহাসড়কের পাশে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে বালু উত্তোলন ও সংগ্রহ, ট্রাক বা লরিতে বালু-মাটি-সিমেন্টসহ অন্য নির্মাণসামগ্রী উন্মুক্ত অবস্থায় পরিবহন, রাস্তায় গৃহস্থালি-পৌর বর্জ্য স্তূপাকারে রাখা ও বর্জ্য পোড়ানো, ড্রেন থেকে ময়লা তুলে রাস্তায় ফেলে রাখা, ঝাড়ূ দিয়ে রাস্তা পরিস্কার করতে গিয়ে ধুলাবালি ছড়ানো, বিভিন্ন সড়কের পাশে থাকা অনাবৃত স্থান, ফুটপাত ও রাস্তার আইল্যান্ডের মধ্যের ভাঙা অংশের মাটি ও ধুলা, ফিটনেসবিহীন পরিবহন থেকে নিঃসৃত ক্ষতিকর ধোঁয়া, বিভিন্ন যানবাহনের চাকায় লেগে থাকা কাদামাটি, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সরকারি কলোনির ময়লা-আবর্জনা পোড়ানো, বিভিন্ন মার্কেট-শপিংমল-বাণিজ্যিক ভবনের আবর্জনা ও ধুলাবালি রাস্তায় ফেলা, ঢাকা শহরের দূষণপ্রবণ এলাকার ধুলা, হাসপাতালের বর্জ্য রাস্তায় ফেলা, অধিক সালফারযুক্ত ডিজেল ব্যবহার এবং জনসচেতনতার অভাব।
সমস্যাগুলো যথার্থ অর্থে চিহ্নিত হলেও আশু স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি যুক্তিজ্ঞাননির্ভর কর্মকৌশল প্রণয়ন এবং অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পরিত্রাণের উপায় অনুসন্ধান একান্তই আবশ্যক। সদিচ্ছা-বাচনিক অঙ্গীকার দুর্ভোগ কমানোর লক্ষ্যে যুক্তিযুক্ত পদক্ষেপ হতে পারে না। বাস্তবতার নিরিখে পর্যায়ক্রমে ভারসাম্য নিশ্চিত করে যথোপযুক্ত সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ সময়ের দাবি।
ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী : সাবেক উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়