বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস আজ

নিজস্ব প্রতিবেদক

আজ ৭ এপ্রিল, বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস। এ বছরে দিবসটির প্রতিপাদ্য ‘আমাদের পৃথিবী, আমাদের স্বাস্থ্য’। দূষণে বিপর্যস্ত পরিবেশ শরীর আর মনের ওপর প্রভাব ফেলে। শরীরে নানা রোগ বাসা বাধে, মানসিক অস্থিরতা বাড়ে। সুস্থ শরীর আর সুস্থ মনের জন্য দরকার শুদ্ধ বাতাস, শুদ্ধ পরিবেশ। কেবল তাই নয়, বায়ু দূষণের সঙ্গে অপরাধ প্রবণতাও বাড়ছে বলে জানিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।

২০১৮ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, বাংলাদেশে পরিবেশ দূষণজনিত নানা অসুখ-বিসুখের কারণে প্রতিবছর ২৮ শতাংশ মানুষ প্রাণ হারাচ্ছে। আর বিশ্বে ঠিক একই কারণে গড় মৃত্যু মাত্র ১৬ শতাংশ। সেই প্রতিবেদন প্রকাশের পর চার বছর পার হয়েছে। সেই সময়ের চেয়ে দেশের বা ঢাকার বাতাস এখন আরও বেশি দূষিত।

universel cardiac hospital

বায়ু দূষণের পর শব্দ দূষণেও বিশ্বের শীর্ষে বাংলাদেশের নাম ওঠে এসেছে। আর বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় এই দূষণের মাত্রা অন্য শহরগুলোর তুলনায় বেশি। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির (ইউএনইপি) ২০২২ সালের প্রতিবেদন জানিয়েছে, বিশ্বের ৬১ শহরের মধ্যে ঢাকায় শব্দদূষণ অন্য যে কোন শহরের চেয়ে বেশি।

আবার ‘ফ্রন্টিয়ারস ২০২২: নয়েজ, ব্লেজেস অ্যান্ড মিসম্যাচেস’ শীর্ষক এ প্রতিবেদন বলছে, ঢাকায় শব্দের সর্বোচ্চ তীব্রতা ১১৯ ডেসিবল, যা এ প্রতিবেদনে আসা শহরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ১৯৯৯ সালের গাইডলাইন অনুযায়ী, আবাসিক এলাকার জন্য শব্দের গ্রহণযোগ্য সর্বোচ্চ মাত্রা ছিল ৫৫ ডেসিবল, বাণিজ্যিক এলাকার জন্য ৭০ ডেসিবল। ২০১৮ সালের সর্বশেষ হালনাগাদ গাইডলাইনে সড়কে শব্দের তীব্রতা ৫৩ ডেসিবলের মধ্যে সীমিত রাখার সুপারিশ করা হয়। এই হিসাবে ঢাকার বাসিন্দাদের পথ চলতে গিয়ে জাতিসংঘের বেধে দেওয়া সীমার দ্বিগুণ মাত্রার শব্দের অত্যাচার সহ্য করতে হয়।

২০১৮ সালে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় ছিল বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকা। ইউএস এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সে (একিউআই) ১৯৫ স্কোর নিয়ে দূষণের মাত্রায় ঢাকার অবস্থান ছিল চতুর্থ। এরপরের বছরে ঢাকার অবস্থান হয় তৃতীয়। বাতাসে দৃশ্যমান দূষিত পদার্থের ওপর ভিত্তি করে ঢাকার স্কোর দাড়ায় ১৬৩। এতে ঢাকার বাতাসকে অস্বাস্থ্যকর শ্রেণীতে ফেলা হয়। ২০২০ সালে বায়ু দূষণের তালিকায় ঢাকা চলে আসে প্রথম স্থানে।

২০২০ সালে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বায়ুর মান পরিমাপকারী সংস্থা আইকিউ এয়ারের প্রতিবেদন অনুযায়ীও দূষণের শীর্ষে ছিল বাংলাদেশ।

সংস্থাটির প্রতিবেদন অনুসারে, ২০২০ সালে বাংলাদেশে বায়ুতে সূক্ষ্ম বস্তুকণা বা পিএম-২.৫ এর উপস্থিতি প্রতি ঘনমিটারে ছিল ৭৭ দশমিক ১। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার বেধে দেওয়া সীমার চেয়ে এটি সাত গুণ বেশি। এই সংস্থার ২০১৯ সালের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বায়ুতে এই কণার উপস্থিতি ছিল আরও বেশি। বছরজুড়ে গড়ে তা ছিল ৮৩ দশমিক ৩০। আর ২০১৮ সালে ছিল ৯৭ দশমিক ১০।

২০২১ সালে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) ও বায়ুমণ্ডলীয় দূষণ অধ্যয়ন কেন্দ্র (ক্যাপস), স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশের যৌথভাবে করা এক গবেষণা জানায়, ২০২০ সালে বাংলাদেশের বাতাসে গড় ধূলিকণার পরিমাণ ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৭৭.১ মাইক্রোগ্রাম। যা পরিবেশ অধিদফতরের আদর্শ মানের সাড়ে ৫ গুণ বেশি। এরমধ্যে ঢাকার ৭০টি স্থানের দূষণ গবেষণা করে দেখা যায়, পরিবেশ অধিদফতরের বায়ুদূষণের মাত্রা আদর্শ মানের চেয়ে বাতাস ৫.২ গুণ বেশি দূষিত।

চলতি বছর অর্থাৎ, ২০২২ সালেও বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বাতাসের শীর্ষে চলে আসে বাংলাদেশের নাম। বিশ্বের ৬ হাজার ৪৭৫টি শহরের তথ্য বিশ্লেষণ করে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত বাংলাদেশের বাতাস।

দূষণের কারণে দেশের মানুষের স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে—এ কথা স্বীকার করেছেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপসও। গত ২৭ জানুয়ারি প্রথম জাতীয় অসংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণ সম্মেলনে অংশ নিয়ে তিনি বলেন, ঢাকায় দূষণে বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি।

ডিএসসিসি মেয়র বলেন, বাংলাদেশে এনসিডি (অসংক্রামক রোগ) একটি নতুন ও চলমান বোঝা। ডায়বেটিস, হৃদরোগ, ক্যান্সার রোগী উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। দুর্ভাগ্যবশত ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহর, এর কারণে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে।

আর স্বাস্থ্য অধিদফতর জানিয়েছে, এসব অসংক্রামক রোগে মৃত্যু হচ্ছে ৬৭ শতাংশ।

চিকিৎসকরা বলছেন, স্বাস্থ্য হচ্ছে শারীরিক-মানসিক এবং সামাজিকভাবে ভালো থাকা। কিন্তু এসবই বিঘ্নিত হয় দূষণের কারণে। তার মধ্যে—অন্যতম বায়ুদূষণ এবং শব্দ দূষণ। তাই শারীরিক এবং মানসিকভাবে ভালো থাকতে হলে এসব দূষণকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

এবারে স্বাস্থ্য দিবসের প্রতিপাদ্য—আমাদের পৃথিবী, আমাদের স্বাস্থ্য। আর সেখানে মূল বায়ুদূষণ, সঙ্গে রয়েছে অন্য দূষণগুলোও—জানিয়ে প্রিভেনটিভ মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, বায়ুদূষণের কারণে শ্বাসতন্ত্রে প্রভাব পরে। সর্দি কাশি, হাঁচি, শ্বাসতন্ত্রের অ্যালার্জি, হাঁপানি, নিউমোনিয়া, যক্ষ্মা, লাং ক্যান্সারের মতো রোগ হয়।

এর বাইরে ক্ষুদ্র বস্তুকণা রক্তস্রোতের মাধ্যমে পুরো শরীরে প্রবাহিত হয় এবং সেটা লিভারকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, যা একসময় লিভার বিকলের কারণ হয়ে যায়, জানান তিনি।

ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, দূষিত বাতাসে যেসব রাসায়নিক পদার্থ থাকে সেগুলো শরীরের ক্রিয়া-বিক্রিয়াকে প্রভাবিত করে। যেহেতু দূষিত বায়ুর কারণে দেহের কোষ পর্যাপ্ত অক্সিজেন পায় না, ফলে শরীরে ক্লান্তি এবং দুর্বলতা তৈরি হয়।

আবার শব্দদূষণের কারণে শ্রবণেন্দ্রিয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যার কারণে সাম্প্রতিক সময়ে শহরে বসবাস করা একটি জনগোষ্ঠীকে মৃদু বধিরতায় ভুগতে দেখা যাচ্ছে, এবং এ সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে।

ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, শব্দ দূষণ মস্তিষ্ককে বিরক্ত করে। ফলে হৃদস্পন্দন-উচ্চ রক্তচাপ বেড়ে যায়, মেজাজ খারাপ হয়। আবার মন-মেজাজ খারাপ হবার কারণেও উচ্চ রক্তচাপ বেড়ে যায়। মানুষের মনো-সংযোগ ক্ষমতা কমে ক্রমান্বয়ে নষ্ট হয়ে যায়।

বায়ু দূষণ, শব্দ দূষণ, জলবায়ু পরিবর্তনসহ যে কোনও দূষণ একদম প্রত্যক্ষভাবে স্বাস্থ্যের সঙ্গে জড়িত এবং এর প্রভাব ক্ষণস্থায়ী নয়, দীর্ঘমেয়াদি বলে জানান জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের সহযোগী অধ্যাপক ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ।

শব্দ দূষণ মানুষকে বিক্ষিপ্ত করে, খিটখিটে মেজাজ করে দেয়। যার কারণে আমাদের আচরণ পরিবর্তন হয়-তাই এর সঙ্গে অবশ্যই মানসিক স্বাস্থ্যের সম্পর্ক রয়েছে।

ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, শব্দ দূষণের কারণে মানুষের কনস্ট্রেশন, অ্যাটেনশন যখন নষ্ট হয়, তখন সেখান থেকে স্বল্প মেয়াদে স্ট্রেস আর দীর্ঘ মেয়াদে বিষণ্ণতা তৈরি হয়। অপরদিকে, বাতাসে যদি সিসার পরিমাণ বেশি থাকে তাহলে মস্তিষ্কের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়।

আর গর্ভবতী নারীরা যখন সিসাযুক্ত বাতাসে নিঃশ্বাস নেন তখন গর্ভের শিশুর নিউরোলজিক্যাল ডিজঅর্ডার অর্থাৎ স্নায়ুবিকাশজনিত সমস্যা হতে পারে। যেটা পরে তার মানসিক আচরণকে নেতিবাচকভাবে প্রভাবিত করে।

আবার বাতাসে যদি অক্সিজেনের পরিমাণ কম থাকে কিংবা দূষিত থাকে তাহলে সেটা মস্তিষ্কে গিয়ে আমাদের ধীরগতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়, উদ্দীপনা কমিয়ে দেয়। সেই সঙ্গে বায়ুদূষণের সঙ্গে অপরাধও বাড়ে—এটাও প্রমাণিত, বলেন ডা. হেলাল উদ্দিন আহমেদ।

শেয়ার করুন