পানিদূষণের বিষয়ে কার বক্তব্য ঠিক, ওয়াসা না স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের?

হাসান শান্তনু

ঢাকা ওয়াসার দাবি, তাদের সরবরাহ করা ‘পানিতে সমস্যা নেই’। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় বলছে, পানিদূষণের কারণে ঢাকাজুড়ে ডায়রিয়ার প্রকোপ। এবার ডায়রিয়ায় আক্রান্তের সংখ্যা সবকালের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। আইসিডিডিআর,বি বলছে, প্রতিষ্ঠানটির ৬০ বছরের ইতিহাসে এবারের মতো রোগীর চাপ আগে তাদেরকে সামাল দিতে হয়নি। বিশেষজ্ঞরাও রোগটির এমন তীব্রতার জন্যে পানিদূষণকে দায়ী করছেন। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও ঢাকা ওয়াসার দুইরকম দাবির কারণে দ্বন্দ্বে পড়েছেন নগরের বাসিন্দারা।

আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র, বাংলাদেশের (আইসিডিডিআর,বি) তথ্য অনুযায়ী, সেখানে গত মার্চ মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে প্রতিদিন গড়ে অন্তত বারোশত রোগী ভর্তি হচ্ছেন। এসব ডায়রিয়ার রোগী রাজধানীর যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, শনির আখড়া, মোহাম্মদপুর, টঙ্গী ও উত্তরা থেকে আসছেন। আইসিডিডিআর,বি ছাড়াও ঢাকার অন্য সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালেও কমবেশি ডায়রিয়া রোগী ভর্তি হচ্ছেন। বাসায় থেকেও অনেকে চিকিৎসা নিচ্ছেন।

universel cardiac hospital

‘ডায়রিয়ার সঙ্গে ওয়াসার পানির কোনো সম্পর্ক নেই’ বলে গত মঙ্গলবার দাবি করেন ‘ঢাকা পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষের’ (ওয়াসা) ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান। তিনি বলেন, ‘আইসিডিডিআর,বির সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ আছে। ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়ে যাওয়া ১০টি এলাকার তালিকা পাই। আমরা ওইসব এলাকার পানি ল্যাবে পরীক্ষা করে কোনো ব্যাকটেরিয়া পাইনি। আমাদের পরীক্ষার মাধ্যমে যা পেয়েছি, তাতে ডায়রিয়ার সরাসরি কোনো সম্পৃক্ততা নেই।’

দেশে হঠাৎ ডায়রিয়া ও কলেরার প্রাদুর্ভাব বাড়ার পেছনে পানিদূষণকে দায়ী করেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। গতকাল বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, ‘পানিদূষণের কারণে ডায়রিয়া, কলেরা বেশি হচ্ছে। এ জন্য পরিবেশদূষণও দায়ী। স্বাস্থ্য ভালো রাখতে হলে দেশের পানি, বায়ু ও মাটিকে ভালো রাখতে হবে।’

সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও প্রতিষ্ঠানটির সাবেক বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোশতাক হোসেন বলেন, ‘ডায়রিয়ার একটি ফর্ম কলেরা। এর জীবাণু সাধারণত অপরিচ্ছন্ন খাবার, দূষিত পানি থেকে আসে। এবার ঢাকায়, এর আশেপাশে কেন কলেরা রোগী বেশি পাওয়া যাচ্ছে, তা গবেষণা ছাড়া বলা যাবে না। অবশ্য ডায়রিয়া এ সময়ে বেশি হয় পানির কারণেই।’

আইসিডিডিআর,বির তথ্যমতে, ৬০ বছর আগে ১৯৬২ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম শুরুর পর এবারের মতো এতো রোগীর চাপ আগে দেখা যায়নি। ২০০৭ সালে প্রথম সবচেয়ে বেশি ডায়রিয়া রোগী আসেন এ হাসপাতালে। তখন প্রতিদিন গড়ে এক হাজার রোগী এসেছিলেন। এরপর ২০১৮ সালে ডায়রিয়ার প্রকোপ শুরু হলে প্রতিদিন গড়ে এক হাজার ৫৭ রোগী ভর্তি হন।

ঢাকা ও এর আশপাশ এলাকায় খাবারের পানি সরবরাহ করে থাকে ঢাকা ওয়াসা। প্রতিষ্ঠানটির পানির মান নিয়ে অনেকের অভিযোগ আছে। বিশেষ করে তাদের সরবরাহ লাইনের ভেতরে ময়লা-আবর্জনা থাকে, অনেক এলাকায় ওয়াসার পাইপ থেকে ময়লাযুক্ত একধরনের হলুদ পানি বের হয়। যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

এর আগেও ওয়াসার প্রধানকর্তা তাকসিম এ খান দাবি করেছিলেন, ঢাকা ওয়াসার পানি পুরোপুরি বিশুদ্ধ। ২০১৯ সালে যাত্রাবাড়ীর এক বাসিন্দা ময়লাযুক্ত পানি নিয়ে ওয়াসা অফিসে গিয়ে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিলেও তিনি তা গ্রহণ করার সাহস দেখাননি। টিআইবির জরিপ অনুযায়ী ওয়াসার পানির মান খারাপ থাকায় গ্রাহকদের পানি ফুটিয়ে পান করতে হয়। এ জন্য ৩৩২ কোটি টাকার গ্যাস পোড়াতে হয় বছরে।

সুপেয় পানি সরবরাহ না করতে পারলেও দফায় দফায় বাড়িয়ে চলেছে পানির দাম। গত ১৩ বছরে ওয়াসা ১৪ বার পানির দাম বাড়িয়েছে। গত পাঁচ বছরে রাজধানীতে পানির দাম বেড়েছে পাঁচবার। অথচ ওয়াসা গত বছর প্রায় ৫০ কোটি টাকা মুনাফা করেছে। প্রতিষ্ঠানটির নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুসারে এ তথ্য জানা গেছে।

দিনে ঢাকা ওয়াসা যতো পানি উৎপাদন করে, তার ২০ ভাগ গ্রাহক পর্যন্ত পৌঁছায় না। বিষয়টি কাগজে-কলমে ওয়াসায় ‘সিস্টেম লস’ (কারিগরি অপচয়) হিসেবে পরিচিত। শুধু এ অপচয় কমাতে পারলেই বছর বছর ওয়াসাকে পানির দাম বাড়াতে হতো না।

শেয়ার করুন