মাদক, মানব পাচার এবং নকল পণ্যাদি পাচারের মতোই বন্যপ্রাণী পাচার একটি বড় অবৈধ বাণিজ্য। বন্যপ্রাণী পাচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকাণ্ডের মধ্যে অবৈধভাবে সংগ্রহ করা, পরিবহন এবং প্রাণী ও তাদের ডেরিভেটিভস বিতরণ জড়িত। এটি আন্তর্জাতিক বা স্থানীয়ভাবে হতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর বন্যপ্রাণী পাচারকে বিশ্বের তৃতীয় সর্বাধিক মূল্যবান অবৈধ বাণিজ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। এই জাতীয় অবৈধ ক্রিয়াকলাপের সঙ্গে জড়িত আর্থিক লেনদেনের পরিমাণ এত বেশি যে তা নিরূপণ করা অবিশ্বাস্যভাবে কঠিন। অবৈধ পাচারকৃত বন্যপ্রাণীদের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের পরিমাণ অপরিসীম এবং ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১২ সালে হরমোনাইজড সিস্টেম কাস্টমসের পরিসংখ্যানের বিশ্লেষণ অনুসারে, বন্যপ্রাণীর বিশ্বব্যাপী আমদানি হয়েছে ১৮৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যার মধ্যে মৎস্য পণ্যাদির পরিমাণ ছিল ১১৩ বিলিয়ন ডলার; উদ্ভিদ এবং বনজ ৭১ বিলিয়ন এবং ৩ বিলিয়ন ডলারের অমৎস্যজীবী প্রাণী। বিশ্বব্যাপী বন্যপ্রাণী বাণিজ্যের সুষ্ঠু তদারকি ও এ সংক্রান্ত আইনগুলোর প্রয়োগ জোরদার করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার সংস্কারের আহ্বান ক্রমবর্ধিত হচ্ছে।
পাচার হওয়া বহুল প্রচলিত হাতির দাঁত বা আইভরি উৎস দেশ থেকে খুবই কম দামে ক্রয় করে গন্তব্য দেশগুলোতে উচ্চ মূল্যে বিক্রয় করা হয়ে থাকে। দাম উৎস দেশ এবং পণ্যের ধরনের ওপর নির্ভর করে। আইভরির দাম এবং চাহিদা আকাশছোঁয়া এবং এটি একটি ক্রমবর্ধমান এবং খুব লাভজনক বাজারে পরিণত হয়েছে। চীন অবৈধ হস্তিদন্তের বৃহত্তম আমদানিকারক এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দ্বিতীয় অবস্থানে। বন্যপ্রাণী-বিষয়ক সংস্থা সেভ দ্য এলিফ্যান্টসের প্রতিবেদন অনুসারে চীনে হাতির কাঁচা দাঁতের দাম প্রতি কেজি ২,১০০ মার্কিন ডলার। ২০১০-১২ সালের মধ্যে প্রতি বছর গড়ে ৩৩,০০০ হাতি অবৈধ শিকারিদের দ্বারা হত্যা করা হয়েছে।
বন্যপ্রাণী চোরাচালান সরাসরি বিভিন্ন বাস্তুতন্ত্রের জীববৈচিত্র্যকে প্রভাবিত করে। নির্দিষ্ট কিছু প্রাণী পাচারকারীদের বেশি চাহিদার কেন্দ্রে থাকে, যার ফলে তাদের আবাসস্থলে ওই প্রজাতির একটি দৃশ্যমান হ্রাস ঘটে। বন্যপ্রাণী চোরাচালান একটি বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে আক্রমণাত্মক এবং ক্ষতিকারক প্রজাতিগুলোর প্রবর্তনের কারণও হতে পারে, যা প্রজাতির মধ্যে স্বতন্ত্র প্রতিযোগিতার মাধ্যমে পরিবেশের উৎসগুলোতে একটি চাপ সৃষ্টি করে দেশীয় বন্যজীবনকে বিপন্ন করতে পারে। গত শতাধিক বছর ধরে প্রায় কুড়িটি প্রাণী শিকার ও অবৈধ চোরাচালানের কারণে বিলুপ্ত হয়েছে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য পশ্চিম আফ্রিকার কালো গণ্ডার, পারফহয়ান ইবেক্স, যাত্রী কবুতর, কচ্ছপ এবং লাল-মাথা যুক্ত ম্যাকাও।
অনেক প্রজাতিই বিপদাপন্ন প্রাণী হিসেবে স্বীকৃতি না পাওয়া পর্যন্ত তাদের সুরক্ষার কোনো ব্যবস্থা থাকে না এবং এই সুরক্ষা বিলম্বের ফলে বাস্তুতন্ত্রের জীববৈচিত্র্যের উল্লেখযোগ্য ক্ষতি হয়। বিপন্ন প্রজাতি আইনের মতো আইন বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, বন্যপ্রাণী এবং গাছপালা সংরক্ষণ এবং সংরক্ষণের জন্য আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মানব পরিবেশগত হস্তক্ষেপ নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়তা করে। বন্যপ্রাণী পাচার একটি ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক সংকট, যা কেবলমাত্র পশুর অধিকার হরণ করে না, বিশ্বব্যাপী পরিবেশগত, সামাজিক এবং অর্থনৈতিক স্তরেও হুমকিস্বরূপ। এটি একটি অবৈধ অর্থনীতিতে অবদান রাখছে এবং মানুষের কল্যাণে ক্ষতিকারক প্রভাব ফেলছে। বিপন্ন প্রজাতি আইন অপরাধ মোকাবিলা এবং বন্যজীবন সুরক্ষার জন্য যৌথ প্রচেষ্টা করার অংশ হিসেবে অভিবাসী প্রজাতিগুলোর কনভেনশন (সিএমএস) এবং বিপন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী ও উদ্ভিদের আন্তর্জাতিক ব্যবসা সংক্রান্ত কনভেনশনের (সিআইটিইএস) মতো চুক্তি ও আইন কার্যকর করার কাজ করে যাচ্ছে।
এই আইন ভাঙার ফলে জরিমানার পরিমাণ অনেক কম। এই সীমিত শাস্তি ও জরিমানা এই আইনগুলোকে দুর্বল করেছে। অবশ্য এর মাঝেও কিছু ব্যতিক্রম রয়েছে। যেমন- বৈজ্ঞানিক উদ্দেশ্য বা প্রভাবিত প্রজাতির প্রকার বা বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় গবেষণা। বন্যজীবন ও বন্যজীবন সামগ্রীর অবৈধ বাণিজ্য সমাপ্ত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন দেশের সরকার ও সংস্থার স্বেচ্ছাসেবক জোট হিসেবে ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় কোয়ালিশন অ্যাগেইনস্ট ওয়াইল্ডলাইফ ট্র্যাফিকিং (সিএডব্লিউটি)। তাদের কর্মকাণ্ডের মধ্যে রয়েছে বন্যপ্রাণী থেকে উৎপাদিত বিভিন্ন পণ্যের চাহিদা কমাতে জনসচেতনতা বৃদ্ধি, সরবরাহ সীমিত করার জন্য আন্তঃসীমান্ত আইন প্রয়োগকে আরো জোরদার করা এবং উচ্চপদস্থ রাজনৈতিক সমর্থন জড়িত করার প্রচেষ্টা।
লেখক : সহকারী কর্মকর্তা, সাউথইস্ট বিশ্ববিদ্যালয়।