অব্যাহত রাজনৈতিক উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে শ্রীলঙ্কায় রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ব্যতীত মন্ত্রিসভার ২৬ সদস্য এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের পদত্যাগের পর অবস্থার উন্নয়ন ঘটেনি। এই রাজনৈতিক বিক্ষুব্ধতার কারণ হচ্ছে অর্থনৈতিক যার মূলে আছে অদূরদর্শী লাভালাভ বিবেচনাহীন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড। শ্রীলঙ্কায় বৈদেশিক মুদ্রার সংকটের কারণে পরীক্ষার কাগজও কেনা যাচ্ছে না। বিদ্যুৎ স্বল্পতার জন্য দিনে অন্তত ১০/১২ ঘণ্টা ব্লাক-আউট পালন করতে হচ্ছে। বৈদেশিক মুদ্রার লেভেল এমন এক জায়গায় পৌঁছেছে, যা দিয়ে মাত্র ১০ দিনের আমদানি চলমান রাখা সম্ভব।
দেশটি বরাবরই একটি ঈর্ষণীয় দেশ ছিল। কয়েক বছর আগেই দেশটি পর্যটন শিল্প ও শ্রমজীবী মানুষের বৈদেশিক আয়ের ওপর ভিত্তি করে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে পদার্পণ করেছিল। এখন তার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পথ সংকোচিত। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত ও বাংলাদেশ ছাড়া শ্রীলঙ্কা এখন চীন, এডিবি ও ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের ঋণের ভারে জর্জরিত। ঋণ পরিশোধের বোঝা অবর্ণনীয়, যা ৬ বিলিয়নের কাছাকাছি। ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে একটি বৃহৎ বন্দর লিজ দেয়া হয়েছে চীনের একটি কোম্পানির কাছে। দেশটির মুদ্রাস্ফীতি ১৭ ভাগ ছাড়িয়ে গেছে। মানুষের আয় উপার্জন বহু গুণ কমেছে। বেকারত্বের হার বেড়েছে বহুগুণ। এই প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা পৌঁছেছে ক্ষমতাসীনদের দোরগোড়ায়।
এমনি অবস্থার জন্য ভুল অর্থনৈতিক নীতিকে দোষারোপ করা যায়। সম্ভাব্যতা যাচাই ছাড়া বিশাল অঙ্কের বৈদেশিক ঋণের মেগা প্রকল্প দেশটি গ্রহণ করেছে, সঙ্গে দোদল্যমান ও পরিবর্তনশীল বৈদেশিক নীতিও বোধ হয় অন্যতম প্রধান কারণ হয়ে দেখা দিচ্ছে। দেশটি এখন কার্যত দেউলিয়া পর্যায় পৌঁছে গেছে। মেগা প্রকল্প সাময়িক মর্যাদা বর্ধক হলেও সেসব কিন্তু জনগণের আয় উপার্জন বৃদ্ধিতে সহায়ক হচ্ছে না। ফলত মানুষের ক্রয়ক্ষমতা কমেছে, অর্থনীতি স্থবির হয়ে আসছে। করোনাও ব্যাপক ক্ষতিসাধন করেছে।
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম ঈর্ষণীয় এই দেশটির অবস্থা আমাদের ভাবিয়ে তুলছে। ভাবিয়ে তুলছে সে দেশকে দেয়া ২৫০ মিলিয়ন ডলার আমরা আদৌ ফেরত পাব কিনা। শ্রীলঙ্কা আরো ২৫০ মিলিয়ন ঋণের জন্য বলতে গেলে হত্যা দিয়ে পড়ে আছে। করোনার কারণে আমাদের আয় উপার্জন কমেছে, দারিদ্র্যসীমার নিচের জনসংখ্যা মুদ্রাস্ফীতির হার বেড়েছে। এক বছর আগে আমাদের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার সক্ষমতা ছিল ১০ মাসের সমপরিমাণ আমদানি, বর্তমানে তা ৫.৫ মাসে দাঁড়িয়েছে। অন্যতম কারণ হচ্ছে আমদানির ৪৬ শতাংশ বৃদ্ধি আর রপ্তানি আয়ে ১৯ শতাংশ বৃদ্ধি। বেকারত্বের হার ক্রমবর্ধনশীল। সরকারি উদ্যোগে ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির প্রয়াস ছিল বলে আমরা করোনার আঘাত কাটিয়ে নিতে পারছি বটে, তবে মেগা প্রকল্পগুলো যদি সহসাই আয় উপার্জনের পথ খুলে না দেয় তাহলে আমাদের ক্ষেত্রে কিছু সমস্যা যে দানা বাঁধবে না তা বলা যাবে না। আমাদের মেগা প্রকল্পগুলো সুচিন্তিত বলেই মনে হচ্ছে। পদ্মা সেতুর কার্যক্রম শুরু হলে জিডিপি ২ ভাগ বেড়ে যেতে পারে। মেট্রোপলিটন রেল যোগাযোগ ব্যবস্থাটা আরো আগে চাঙ্গা করা গেলে ভালো হয়। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে আনুষঙ্গিক সুবিধাদির অভাবে মেট্রোরেল সিস্টেম সময়মতো চালু হবে না। প্রকল্পগুলোর ব্যাপারে আমরা কার্যকারিতার নীতি মেনে চলছি কিন্তু দক্ষতার নীতি বিবর্জিত এসব প্রকল্প কত দ্রুত বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা অর্জন করতে পারবে তা এক বড় প্রশ্ন।
শ্রীলঙ্কাকে দেখে আমাদের আরো কতিপয় ব্যবস্থা দ্রুত নিতে হবে। প্রথম কথা অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা নিবিড়ভাবে যাচাই না করে কোনো প্রকল্প নেয়া সমীচীন হবে না। ভূ-রাজনৈতিক অবস্থা বিবেচনা নিয়ে কারো মনঃতুষ্টির জন্য কোনো প্রকল্প নেয়া উচিত হবে না।
আমাদের জনগণের ক্রয়ক্ষমতা বাড়াতে হবে। সে কারণে ২০ বছর আগেকার ওয়ার্কস প্রোগ্রাম কার্যক্রম চাঙ্গা করা উচিত হবে। এতে কর্মযজ্ঞ সৃষ্টি হবে। ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং অর্থনীতি চাঙ্গা হবে। মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য কর, শুল্ক ও ভ্যাটে ছাড় দিতে হবে।
বাজারে মুদ্রাস্ফীতি আছে, অনেকেই মুদ্রার অবমূল্যায়নের কথা বলছেন কিংবা অদৃশ্যমান অবমূল্যায়ন ঘটতেই আছে। বেতন ভাতা বাড়ানোর কথা উঠছে। পণ্যসামগ্রীর সরবরাহ বৃদ্ধি, ব্যবসায়ীদের কারসাজি নিয়ন্ত্রণ, খাদ্য, কৃষি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম সমন্বিত করা না গেলে শুধু ট্রাকে করে পণ্য বিক্রিতে বর্তমান সংকটকে ধারণ করা যাবে না। চাঁদাবাজদের ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও রাজনীতিকে নির্মোহ হতে হবে। দেশপ্রেম বিবর্জিত রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী ও সেøাগানদাতাদের সংযত করতে না পারলে বাজার নিয়ন্ত্রণ কঠিন হবে। ক্ষমতাসীন দল ও জোটের অভ্যন্তরীণ সংকটের প্রতি নজর দিতে হবে। কেননা অভ্যন্তরীণ সংকট বহিঃসংকটের তীব্রতা বাড়িয়ে দেয়। একই সঙ্গে ঘুষ, দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের পথ রোধ করতে হবে।
ভালো খবর হচ্ছে রপ্তানি আয় আমাদের বাড়ছে। তবে কেবলমাত্র গার্মেন্ট রপ্তানির ওপর ভরসা করা ঠিক হবে না। বৈদেশিক শ্রমবাজার সম্প্রসারণ এবং বাজার বহুমুখীকরণ অত্যাবশ্যক। শ্রীলঙ্কা আমাদের মতোই করোনাক্রান্ত ছিল, যার কারণে তার পর্যটন শিল্প ও বৈদেশিক আয় মুখ থুবড়ে পড়েছে। প্রাপ্ত শিক্ষাটা হচ্ছে সব ডিম এক ঝুড়িতে রাখতে নাই।
শ্রীলঙ্কার জন্য কষ্ট হয়। বিংশ শতাব্দীর মধ্য ও শেষভাগে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে পড়াশোনা ও কাজ করার সুযোগ হয়েছিল। তারা বড্ড সুশীল জাতিসত্তা হিসেবে বিকশিত হচ্ছিল। তামিল বিদ্রোহ তাদেরকে কাবু করেছে। মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রতি ইতর বিশেষ ভেদাভেদ তাদেরকে নিবীর্য করেছে। মোটকথা সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা অর্থনীতির ফলপ্রসূতা ও দক্ষতাকে প্রভান্বিত করে। এগুলো মনে রাখা প্রয়োজন। আমাদের অবস্থা শ্রীলঙ্কার মতো হবে তা বলছি না। ‘তবে সাবধানের মার নেই’- প্রবাদটির গুরুত্ব দিতে হবে।
লেখক : বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধা