আইসিডিডিআর,বিতে ডায়রিয়া রোগীর চাপ : প্রতি মিনিটে একজন রোগী ভর্তি

নিজস্ব প্রতিবেদক

আইসিডিডিআর

রাজধানীর মহাখালীর আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণা কেন্দ্র বাংলাদেশ (আইসিডিডিআর,বি) হাসপাতালে অব্যাহত রয়েছে ডায়রিয়া রোগীর চাপ । সাড়ে তিনশ বেডের এ হাসপাতালটিতে বর্তমানে গড়ে প্রতি মিনিটে একজন করে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী আসছেন। এমতাবস্থায় অসংখ্য রোগীর ভিড় সামাল দিতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন হাসপাতালটির চিকিৎসক ও নার্সসহ সংশ্লিষ্টরা।

আইসিডিডিআর,বি হাসপাতালের একাধিক দায়িত্বশীল কর্মকর্তার জানান, ডায়রিয়ার সুচিকিৎসার জন্য স্বনামধন্য রাজধানীর এ হাসপাতালে সম্প্রতি একদিনে সর্বোচ্চ প্রায় ১৪০০ রোগী ভর্তির রেকর্ড হয়েছে। এর আগে ২০০৭ সালে ১ হাজার রোগী ভর্তির রেকর্ড ছিল। চলতি বছরের মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের শুরু থেকে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকে।

প্রতিষ্ঠানটির সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. জোবয়ের মুহাম্মদ চিশতী বলেন, আইসিডিডিআর,বি কখনও কোনো রোগীকে ফিরিয়ে দেয় না। কিন্তু এবার পরিস্থিতি এতটাই জটিল হয়ে পড়ছে যে, অনেক রোগীকে পর্যবেক্ষণ করে প্রয়োজনীয় সেবা দিয়ে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, আমাদের বিছানার সংখ্যা মাত্র ৩৫০টি, কিন্তু রোগীর সংখ্যা বাড়ায় অতিরিক্ত ৫০০ বিছানা তৈরি করা হয়েছে। এখন দৈনিক প্রায় দেড় হাজার রোগী ভর্তি থাকছেন।

আইসিডিডিআর,বি হাসপাতালে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে ডায়রিয়া রোগীর প্রচণ্ড চাপ। হাসপাতালের সামনে তাঁবু টানিয়ে সেবা দেয়া হচ্ছে। যারা বেডে জায়গা পাচ্ছেন না তারা এখানে চিকিৎসা নিচ্ছেন। একসঙ্গে এত বেশি রোগী সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক-নার্সরা।

আইসিডিডিআর,বির সিনিয়র ম্যানেজার (ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড কমিউনিকেশন) এ কে এম তারিফুল ইসলাম খান জানান, চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে আজ (১০ এপ্রিল) দুপুর ২টা পর্যন্ত প্রায় ৫২ হাজার ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগী ভর্তি হয়। তার মধ্যে ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ মার্চ পর্যন্ত ৩৯ হাজার ৩৭২ জন এবং ১ থেকে ১০ এপ্রিল দুপুর ২টা পর্যন্ত ১২ হাজার ৬১১ জন রোগী ভর্তি হয়। দিনক্ষণ হিসেবে (১ এপ্রিল থেকে ১০ এপ্রিল) ভর্তিকৃত রোগীর সংখ্যা যথাক্রমে ১ হাজার ২৭৪ জন, ১ হাজার ২৭৪ জন, ১ হাজার ১৭১ জন, ১ হাজার ৩৮৩ জন, ১ হাজার ৩৭৯ জন, ১ হাজার ৩৭০ জন, ১ হাজার ৩৮২ জন, ১ হাজার ৩৭৫ জন, ১ হাজার ২৯৬ জন এবং ৭০৭ জন।

তিনি আরও বলেন, এ মুহূর্তে ঢাকা দক্ষিণের যাত্রাবাড়ী, শনিরআখড়া, জুরাইন, সায়েদাবাদ, ঢাকা উত্তরের মোহাম্মদপুর ও মিরপুর এলাকা থেকে সবচেয়ে বেশি রোগী আসছে।

কী কারণে ডায়রিয়া রোগী বাড়ছে জানতে চাইলে আইইডিসিআরের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. এএসএম আলমগীর বলেন, যেহেতু ডায়রিয়া পানিবাহিত রোগ, তাই পানির সমস্যার কারণেই এটা হচ্ছে। প্রচণ্ড গরম এবং বাইরের অস্বাস্থ্যকর খাবার। আরেকটি কারণ অনেক জায়গায় ওয়াসার পানির লাইনের সঙ্গে স্যুয়ারেজ লাইন এক হয়ে যাচ্ছে। যা চিহ্নিত করা যাচ্ছে না। ফলে পানি দূষণ বাড়ছে। বিষয়টি নিয়ে ওয়াসাকে জানানোও হয়েছে।

ডায়রিয়া রোগীদের জন্য করণীয় সম্পর্কে ডা. আলমগীর বলেন, যখনই কারও ডায়রিয়া শুরু হবে, তাকে সঙ্গে সঙ্গে স্যালাইন খাওয়ানো শুরু করতে হবে। পাশাপাশি তরল খাবার যেমন, চিড়ার পানি বা ডাবের পানি খেতে দিতে হবে। বাইরের জুস বা অস্বাস্থ্যকর খাবার পরিহার করতে হবে। তারপরও রোগীর অবস্থার যদি অবনতি হয় নিকটবর্তী হাসপাতালে নিতে হবে। সবাইকে এই হাসপাতালেই চিকিৎসা নিতে হবে, বিষয়টা এমন নয়। কাছাকাছি কোনো সরকারি হাসপাতালে দ্রুত চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।

আইসিডিডিআর,বি হাসপাতালের প্রধান ডা.বাহারুল আলম বলেন, মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত দৈনিক গড়ে রোগীর সংখ্যা ৫০০ জনের কম ছিল। কিন্তু দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে ডায়রিয়া রোগীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে। তিনি বলেন, ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীদের শরীরে পানিশূন্যতা দেখা দেয়। এক্ষেত্রে তার দ্রুত চিকিৎসা গ্রহণ করা প্রয়োজন। কিন্তু সম্প্রতি দেখা গেছে দূর-দূরান্ত থেকে ডায়রিয়া আক্রান্ত রোগীদের আশপাশের হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য না নিয়ে আইসিডিডিআর,বিতে নিয়ে আসা হয়। বিলম্বের কারণে তাদের অনেকের মৃত্যু হয়। গত এক মাসের ব্যবধানে ২৫ জন রোগী মৃত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে আসা হয়। আক্রান্ত রোগীর বাড়ির আশপাশে চিকিৎসা করলে হয়তো রোগীর প্রাণ রক্ষা পেতো। এ ধরনের ভুল করা মোটেই উচিত নয়।

বর্তমান ডায়রিয়া পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের লাইন ডিরেক্টর (সংক্রামক ব্যাধি নিয়ন্ত্রণ) অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম বলেন, বর্তমানে রাজধানীসহ সারাদেশে ডায়রিয়ার প্রকোপ কিছুটা বেড়েছে এ কথা সত্য। কিন্তু প্রতি বছরই এমনটা হয়। তবে আইসিডিডিআর,বি হাসপাতালে রোগীর চাপ বেশি বলে তিনি স্বীকার করেন।

তিনি বলেন, ডায়রিয়া রোগ প্রতিরোধে জনসচেতনতামূলক বিভিন্ন প্রচার প্রচারণা (ইলেট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায়) চালানো হচ্ছে। পাশাপাশি রাজধানীসহ সারাদেশে জেলা উপজেলা পর্যায়ে মাইকিং করে বিশুদ্ধকরণের জন্য পাঁচ মিনিট পানি ফুটিয়ে গরম করে খেতে বলা হচ্ছে। তৃণমূল পর্যায়ে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেটও দেওয়া হচ্ছে।

শেয়ার করুন