ফায়দা হাসিলের জন্য সংখ্যালঘু শিক্ষকদের বিরুদ্ধে বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদেরকে প্রায়ই ব্যবহার করছে বিভিন্ন উগ্রগোষ্ঠী। ‘ইসলাম অবমাননার’ কথিত অভিযোগ তুলে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও জাতিগত সংখ্যালঘু শিক্ষককে গ্রেপ্তার, চাকরিচ্যুত করা, বিভিন্ন সাজা দেওয়ার ঘটনা দেশে ক্রমেই বাড়ছে। ‘স্পর্শকাতর’ বিষয় হওয়ায় ও প্রশাসনের এক ধরনের প্রশ্রয় থাকায় ‘ধর্মীয় কৌশলকে’ কাজে লাগাচ্ছে স্বার্থান্ধ গোষ্ঠীগুলো।
এতে ‘অভিযুক্ত’ শিক্ষকসহ তাঁর পরিবার নতুন ঝুঁকির কবলে পড়ছে। শিক্ষক, তাঁদের পরিবারে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা বাড়ছে। সবশেষ মুন্সিগঞ্জের বিনোদপুর রাম কুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও গণিতের শিক্ষক হৃদয় চন্দ্র মণ্ডলের বিরুদ্ধে ‘ইসলাম সম্পর্কে কটূক্তির’ অভিযোগে মামলা ও তাঁর কারাবাস দেশের সংখ্যালঘু শিক্ষকদেরকে আরো আতঙ্কিত করে তোলেছে। সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর অপকৌশলের শিকার হয়ে কখন কোন শিক্ষককে জেলে যেতে হয়, এমন দুশ্চিন্তা পেয়ে বসেছে তাঁদেরকে।
ঢাকার মতিঝিল এলাকায় অবস্থিত চারটি নামকরা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অন্তত ছয় শিক্ষকের সঙ্গে আজ সোমবার দুপুর ১২টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টার মধ্যে কথা বলে মত ও পথ। তাঁরা বলেন, ধর্ম ও বিজ্ঞানের পার্থক্য নিয়ে শ্রেণিকক্ষে আলোচনায় ‘ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত’ করার অভিযোগে হৃদয় মণ্ডলের গ্রেপ্তারের আগে থেকেই সংখ্যালঘু শিক্ষকরা আতঙ্কিত। হৃদয় মণ্ডলকে শ্রেণিকক্ষে ফাঁসানো হয়েছে পরিকল্পিতভাবে। এভাবে যে কাউকে ফাঁসানো সম্ভব। তিনি বলেছেন, ধর্ম বিশ্বাসের আর বিজ্ঞান প্রমাণের বিষয়। এটা যে কোনো শিক্ষকেরই বক্তব্য।
তাছাড়া, শ্রেণিকক্ষে মুঠোফোন সেট নিয়ে যাওয়ার নিয়ম নেই। এক শিক্ষার্থী কীভাবে, কেন মুঠোফোন সেট নিয়ে গেল, বা কেন হৃদয় মণ্ডলের বক্তব্য রেকর্ড করল- এর কোনো তদন্ত করে বিচারের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। হৃদয় মণ্ডল পুরো বক্তব্যে কোনো ধর্ম সম্পর্কে অবমাননা করেননি। প্রশাসন তা বিবেচনা না করে তাঁকে গ্রেপ্তার করে।
শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশের জন্য শিক্ষকরা শ্রেণিকক্ষে নানা বিষয় নিয়ে আলোচনা করতেই পারেন। যৌক্তিক আলোচনার পরও শুধু ধর্মীয় বিশ্বাসের নিরিখে ভিন্ন হওয়ায় কোনো শিক্ষকের গ্রেপ্তার হওয়ার ঘটনা শিক্ষাব্যবস্থার জন্য ‘অশনি সংকেত’। সংখ্যালঘু শিক্ষকরা এখন শ্রেণিকক্ষে মুক্ত ও বিজ্ঞানভিত্তিক আলোচনার সাহস হারিয়ে ফেলছেন। ঝামেলা এড়াতে ঢাকার ওই ছয় শিক্ষকের মধ্যে কেউ মত ও পথের কাছে নিজের নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।
তাঁদের অভিযোগ, সম্প্রতি নওগাঁয় একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে ইউনিফর্ম (বিদ্যালয়ের নির্ধারিত পোশাক) না পরায় সহকারী প্রধান শিক্ষিকা আমোদিনী পাল দুই শিক্ষার্থীকে শাস্তি দেন। এ ঘটনাকে ‘হিজাব পরার কারণে শাস্তি’ হয় বলে গুজব রটিয়ে তাঁকে হেনস্থা করা হয়। চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ে জোরারগঞ্জ বৌদ্ধ উচ্চ বিদ্যালয়ে এক ছাত্রী হিজাব খুলতে রাজি না হওয়ায় প্রধান শিক্ষক মৌখিকভাবে শাসন করেন। এ ঘটনা কেন্দ্র করে মিথ্যা কাহিনি রটিয়ে ওই শিক্ষককে হেনস্তা করেন সাম্প্রদায়িক উগ্ররা। যারা অপকৌশলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিক্ষককে হেনস্থা করেন, গুজব রটান, তাদেরকে প্রশাসন বিচারের মুখোমুখি করেনি।
শুধু তাই নয়, এসব ঘটনায় এ পর্যন্ত কারোই সাজা হয়নি। সরকারের গঠিত তদন্ত কমিটি শিক্ষকের বিরুদ্ধে ওঠা ‘ইসলাম অবমাননার’ প্রমাণ না পেলেও ঘটনার সঙ্গে জড়িতরা শাস্তি পাননি, এমন নজিরও আছে। কোনো কোনো ঘটনার পর বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মুক্তচিন্তার মানুষের প্রতিবাদের মুখে কারাগারে থাকা শিক্ষকের জামিন হয়। কিন্তু তাঁর, বা তাঁদের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মিথ্যা মামলার বিচারিক কার্যক্ররম বছরের পর বছর ধরে চলতে থাকে। এতে ভুক্তভোগীরা আর্থিক, মানসিক, শারীরিক, সামাজিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। প্রশাসন ও সরকারের শীর্ষপর্যায় থেকে দেওয়া বিভিন্ন আশ্বাসের বাস্তবায়ন তাঁরা দেখেন না।
হৃদয় মণ্ডলকে গ্রেপ্তার নিয়ে দেশে-বিদেশের মানবাধিকার কর্মী, আইনজীবী, শিক্ষক ও সাংবাদিকরা প্রশ্ন তুলেছেন। এটা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করছেন তাঁরা। একের পর এক বিভিন্ন কৌশলে উস্কানিমূলক বিভিন্ন অপপ্রচার চালিয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার লক্ষ্যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শিক্ষকদের হেনস্থা করা হচ্ছে বলে মনে করে মহিলা পরিষদ। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এ ঘটনায় উদ্বেগ জানায়।
বিশিষ্ট সাংবাদিক, সাপ্তাহিক যায়যায়দিনের তারিখ ইব্রাহিম ছদ্মনামে পাঠকনন্দিত কলামিস্ট বিভুরঞ্জন সরকার ওই শিক্ষকের গ্রেপ্তার হওয়া প্রসঙ্গে বলেন, ‘একজন বিজ্ঞান শিক্ষককে মিথ্যা অভিযোগে কারাগারে রেখে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নের বুলি কপচানো অর্থহীন।’
১৯ দিন কারাভোগ শেষে ওই শিক্ষকের জামিনে কারামুক্তির পর এখন ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনার দাবি জানিয়ে গণমাধ্যম ব্যক্তিত্ব, গ্লোবাল টিভির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা বলেন, ‘সেই ছাত্রকে গ্রেপ্তার করা দরকার। যে গোপনে ক্লাসরুমের কথা মোবাইল ফোন সেটে রেকর্ড করেছিল। তাকে কারা মদদ দিয়েছেন, সেটাও বের করতে হবে।’
জানা যায়, ‘ইসলামবিদ্বেষী’ কথিত মন্তব্যের জের ধরে গত বছরের অক্টোবরে ঢাকার ভিকারুন নিসা নূন স্কুল ও কলেজের সহকারী প্রধান শিক্ষক জগদীশ চন্দ্র পালকে চাকরিচ্যুত করার ঘটনা ঘটে। লালমনিরহাটের কালীগঞ্জের তালুক শাখাতি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক পবিত্র রায়কে গত বছরের ২৪ জুলাইয়ে পুলিশ গ্রেপ্তার করে একই অভিযোগে। ২০১৮ সালের ২২ নভেম্বর চাঁদপুরের ইনস্টিটিউট অব মেরিন টেকনোলজির ইলেক্ট্রিক্যাল বিভাগের শিক্ষক জয়ধন তনচঙ্গাকে ‘ইসলাম অবমাননার’ অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়।
‘ধর্মীয় অবমাননার’ অভিযোগ এনে নারায়ণগঞ্জের পি আর সাত্তার লতিফ উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষক শ্যামল কান্তি ভক্তকে ২০১৬ সালে কান ধরে উঠ-বস করানোর ভিডিও ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ার পর বিষয়টি ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। জাতীয় পার্টির স্থানীয় সংসদ সদস্য সেলিম ওসমানের নির্দেশে তাঁকে কান ধরিয়ে উঠ-বস করানো হয়।
ওই ঘটনা তদন্তের জন্য উচ্চ আদালতের নির্দেশে গঠিত বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি শ্যামল কান্তির ধর্মীয় অবমাননার কোনো সত্যতা পায়নি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটিও একই কথা বলে।
২০২০ সালের জানুয়ারিতে ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলার রঘুনন্দনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক পিন্টু মজুমদার কথিত একই অভিযোগে গ্রেপ্তার হন।
২০১১ সালের ২৬ জুলাই ঢাকার ধানমন্ডি গভ. বয়েজ হাই স্কুলের সহকারি প্রধান শিক্ষক মদনমোহন দাস, একই বছর গোপালগঞ্জের টুঙ্গীপাড়ার জিটি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজি শিক্ষক শংকর বিশ্বাসের বিরুদ্ধে ‘ইসলাম অবমাননা’র অভিযোগ ওঠে। পরে জানা যায়, তাঁরা বিদ্যালয়ের অন্য শিক্ষকদের দ্বন্দ্বের শিকার হন। ধর্ম নিয়ে কটূক্তি করেননি।