সিরামিক শিল্পসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগের কথা বলে একাধিক ব্যাংক ও ব্যবসায়ীর কাছ থেকে শতকোটি টাকা আত্মসাৎ এবং বিপুল পরিমাণ অর্থ পাচারের অভিযোগে কথিত ‘ফোসান গ্রুপ’-এর চেয়ারম্যান জিয়া উদ্দিনকে (জিয়া) গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
সোমবার (১১ এপ্রিল) রাজধানীর দিয়াবাড়ী এলাকা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এ তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, জিয়া উদ্দিনকে রাজধানীর উত্তরা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তার বিষয়ে আগামীকাল সকালে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে ব্রিফিং করে বিস্তারিত জানানো হবে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্র জানায়, প্রযুক্তির সহায়তায় তারা ভয়ংকর প্রতারক জিয়ার অবস্থান শনাক্ত করতে পারেন। এরপর তারা জিয়াকে ধরতে অভিযানে নামেন। তাকে গ্রেপ্তারে উত্তরার দিয়াবাড়ি ও বনানীতে পৃথক অভিযান চালানো হয়।
এর আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র জানিয়েছিল, জিয়ার বিরুদ্ধে প্রতারণার অভিযোগের প্রাথমিক অনুসন্ধানে তার ভয়ংকর প্রতারণার অনেক তথ্য পাওয়া গেছে।
বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, দেশে-বিদেশে টাইলস ও সিরামিক পণ্যের কারখানা প্রতিষ্ঠা, ব্রিক্সস কারখানা তৈরিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা, তার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পার্টনার করা, ভবন তৈরির বিভিন্ন পণ্য আমদানি-রপ্তানি, বিদেশে শ্রমিক পাঠানো, চাকরির দেওয়ার প্রলোভন ইত্যাদি নানা কায়দায় টাকা আত্মসাৎ করেছেন জিয়া।
এই প্রতারণার পথে জিয়ার নানা কৌশলের মধ্যে কিছু ছিল শাহেদের মতো। নিজেকে সরকারি দলের বড় বড় নেতার ঘনিষ্ঠ বলে পরিচয় দিতেন জিয়া। তাদের সঙ্গে তোলা ছবি প্রচার করতেন নানা মাধ্যমে। প্রতিষ্ঠানের নামে গড়ে তোলা ওয়েবসাইটে ব্যবসায়িক বিভিন্ন কর্মকাণ্ড তুলে ধরেন, বাস্তবে যার নেই কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ঠিকানা।
বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জে জন্ম নেওয়া জিয়া দেশে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি চীনেও তার প্রতিষ্ঠান আছে বলে প্রচার করতেন। এসব প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়িক পার্টনার চেয়ে দিতেন বিজ্ঞাপন। আগ্রহী অনেকে তার প্রতারণায় ফাঁদে পড়ে হারিয়েছেন কোটি কোটি টাকা।
জিয়ার কাছে প্রতারিত বেশির ভাগই বড় বড় ব্যবসায়ী। প্রতারণার শিকার অনেকে আদালতে ও থানায় মামলা করেছেন। কিন্তু সব সময়ই নিজেকে ধরাছোঁয়ার বাইরে রেখেছেন জিয়া। একেকবার প্রতারণার পর অফিস ও নিজের মোবাইল ফোন নম্বর পরিবর্তন করে আত্মগোপনে চলে যেতেন এই বহুরূপী।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, জোট সরকারের আমলে জামায়াতের তৎকালীন এমপি আব্দুস সাত্তারের কথিত পিএস ছিলেন জিয়া উদ্দিন জামান। ২০০৯ সালে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে তিনি পাড়ি জমান ওমানে। সেখান থেকে চলে যান চীনে। পরে দেশে এসে ভোল পাল্টে হয়ে যান সরকারদলীয় সমর্থক ও বড় ব্যবসায়ী।
সরকারি দলের বিভিন্ন নেতার সঙ্গে ছবি তুলে পরে সময় বুঝে এসব ছবির অপব্যবহার শুরু করেন জিয়া। আবার তার কথিত প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে ও ফেসবুকে ছড়িয়ে দিতেন সেসব ছবি। জিয়ার এসব কর্মকাণ্ডের কারণে সহজেই তাকে বিশ্বাস করতেন সবাই। একসময় ব্যাংক ঋণের টাকা আত্মসাৎ, ওভার ইন-ভয়েসিং ও কনসোর্টিয়াম ঋণের টাকা পাচার, করবহির্ভূত সম্পদ ও বিনিয়োগ অর্জনসহ ধোঁকা দিয়ে বিভিন্ন মানুষের টাকা আত্মসাৎ তার প্রধান কাজ হয়ে ওঠে।
জিয়ার যত প্রতিষ্ঠান দেশের প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি বা শিল্পপতিদের প্রতারণার উদ্দেশ্যে নিজের নামে বা বেনামে বেশ কয়েকটি নামসর্বস্ব কাগুজে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন এই জিয়া। তাছাড়া চীন, দুবাই ও ওমানে তার একাধিক সিরামিক শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে বলে জাহির করতেন। অভিযোগ আছে, বিভিন্ন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের কাছে নিজেকে এসব প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান বা ব্যবস্থাপনা পরিচালক পরিচয় দিয়ে প্রতারণা করে আসছেন তিনি।
জিয়া নিজেকে নিউ জং ইউয়ান সিরামিক কোম্পানি (বিডি) লি.-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক, ফোসান গ্রুপের চেয়ারম্যান, ফোসান সিরামিক কোম্পানি লি.-এর চেয়ারম্যান পরিচয় দিতেন। এ ছাড়া মেজর চায়না লি., চায়না কনস্ট্রাকশন লি., এস কর্পোরেশন, জিয়া অটো ব্রিকস, কাশফুল টয়লেট্রিজ কোম্পানি লি, গ্রীন বায়োটেক লি., মেজর সফটটেক, ফোসান ফুডস অ্যান্ড বেভারেজ ইন্ডাজট্রিজ লি., ডাইনিং মাসকাট, হাই-টেক সিরামিক ইন্ডাজট্রিজ লি.-এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসাবে পরিচয় দিয়ে আসছিলেন।