ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ (সদর ও বিজয়নগর) আসনের সংসদ সদস্য, যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপির ৮ বছরের নিরলস প্রচেষ্টায় অবশেষে বীর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেলেন একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে অনন্য ভূমিকায় অবতীর্ণ বিজয়নগর উপজেলার সেজামুড়া গ্রামের সাহসী কিশোরী ছায়েরা বেগম।
জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল ২০০২ (২০০২ সনের ৮ নং আইন) এর ৭ (ঝ) ধারা অনুযায়ী প্রকৃত বীর মুক্তিযোদ্ধা তালিকা, সরকার এতদ্বারা Rules of Business 1996 এর Schedule-1 (Allocation of Business) এর তালিকা ৪১ এর ৫নং ক্রমিকে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের ৭৮তম সভার আলোচ্য সূচি ০৯ নং সুপারিশ মোতাবেক গত ১১ এপ্রিল ছায়েরা বেগমের নাম বেসামরিক গেজেট আকারে প্রকাশ করেছে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের গেজেট অধিশাখা। তাঁর গেজেট নম্বর ৭১২৪।
এরআগে ছায়েরাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত করতে দীর্ঘ ৮ বছর মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীলদের সঙ্গে অনেক সংগ্রাম চালাতে হয়েছে যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপিকে। তাঁকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্ত করতে তিনি সর্বপ্রথম ২০১৩ সালের ২৯ জানুয়ারি তৎকালীন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ক্যাপ্টেন এবি তাজুল ইসলামকে ডিও লেটার দেন।
সেখানে তিনি লেখেন- সায়েরা বেগম একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। কিন্তু বারবার আবেদন নিবেদন করেও অদ্যাবধি তিনি রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি লাভ করেননি। তাঁর রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির বিষয়ে সেনাবাহিনীর প্রাক্তন প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার (পিএসও) মেজর জেনারেল সায়ীদ আহমেদ বীর প্রতীক(অবঃ) এর প্রত্যয়ন পত্রটিও দেখা যেতে পারে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে তাঁর বিষয়ে খোঁজখবর নিয়েছি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলের মুজিব বাহিনীর একজন লীডার (কমান্ডার) হিসেবেও আমি মোছাম্মৎ সায়েরা বেগমের মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছি।
এমতাবস্থায় তাঁকে পূর্ণাঙ্গ রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান পূর্বক সর্বপ্রকার সুযোগ-সুবিধা প্রদান করতে সবিনয় অনুরোধ করছি।
এই ডিও লেটার প্রদানের পরেও মোকতাদির চৌধুরী ব্যক্তিগতভাবে তৎকালীন প্রতিমন্ত্রীসহ জামুকার সদস্যদের সাথে ছায়েরাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত করতে বহুবার ফোনে কথা বলেন। কিন্তু অদৃশ্য কারণে তাঁকে গেজেটভুক্ত করা হয়নি।
তারপর ২০১৮ সালে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেতে বর্তমান মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের বরাবর পুনরায় আবদেন করেন ছায়েরা বেগম।
ছায়েরা বেগমের নতুন আবেদনের পর মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীসহ জামুকার সদস্যবৃন্দকে মোকতাদির চৌধুরী বহুবার ফোনে অনুরোধ করেন একাত্তরের সাহসী কিশোরী ছায়েরাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত করতে। সর্বশেষ ২০২১ সালের ১৪ জানুয়ারি তিনি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রীকে আরেকটি ডিও লেটার দেন।
সেখানে তিনি বলেন, সায়েরা বেগমকে গেজেটভুক্ত করে ভাতা প্রদানের জন্য আমি ২৯.০১.২০১৩ প্রথম পত্র প্রেরণ করি (অনুলিপি সংযুক্ত); (সাব-সেক্টর কমান্ডার, পরবর্তী PSO, মেজর জেনারেল সয়ীদ বিপি (অবঃ) এর প্রত্যয়ন পত্র সংযুক্ত)
সায়েরা বেগমের আবেদন পত্র সংযুক্ত এবং সায়েরা বেগমকে গেজটভুক্ত করতে যাচাই-বাছাই কমিটির সুপারিশ সংযুক্ত।
বর্তমানে তিনি খুবই দুস্থ আর্থিক কষ্টে দিনাতিপাত করছেন। ৭ বছর যাবৎ এই বিষয়টি নিয়ে মন্ত্রণালয়ের সাথে যোগাযোগ করে যাচ্ছি, যা অত্যন্ত দুঃখজনক। এতএব তাঁর বিষয়টি বিশেষ বিবেচনায় নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গেজেটভুক্ত করে তাঁর বন্ধ হয়ে যাওয়া ভাতা পুনঃ চালু করার জন্য সানুনয় অনুরোধ করা হলো। মোকতাদির চৌধুরী সর্বশেষ ডিও লেটার প্রদান করেও ছায়েরাকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত করতে মন্ত্রণালয়ের যোগাযোগ অব্যাহত রাখেন, তাঁর নিরলস প্রচেষ্টায় অবশেষে বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন একাত্তরের সাহসী কিশোরী ছায়েরা বেগম।
উল্লেখ্য, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার বিজয়নগর উপজেলার মুকুন্দপুরের সেজামোড়ার ছায়েরা বেগমের বাবা আবদুল আজিজ ছিলেন একজন চৌকিদার। অনিচ্ছা সত্ত্বেও হানাদারদের ক্যাম্পে যেতে হতো তাঁকে। বাঙ্কার খননসহ টুকটাক কাজ করে দিতেন আজিজ। একসময় ছায়েরার দিকেও নজর পড়ে নরপশুদের। তাকেও বাধ্য হয়ে ক্যাম্পে যেতে হয়। সহ্য করতে হয় অমানবিক নির্যাতন। সেই থেকেই ক্ষোভ জন্ম নেয় হানাদারদের প্রতি। ক্ষোভ থেকেই জাগ্রত হয় প্রতিশোধের প্রবল স্পৃহা। আর সেই স্পৃহার সফল বাস্তবায়নের জন্য ১৫-১৬ বছরের কিশোরী ছায়েরা বেগম কৌশলে সখ্য গড়ে তোলেন হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প কমান্ডারের সঙ্গে। গল্পের ছলে জেনে নিতেন মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে করা অপারেশনের দিনক্ষণ, জানিয়ে দিতেন মুক্তিযোদ্ধাদের।
তাঁর দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে একাত্তরের নভেম্বরের ১৮ ও ১৯ তারিখের যুদ্ধে মুকুন্দপুরকে মুক্ত করেন মুক্তিযোদ্ধারা। তুমুল যুদ্ধের পর হানাদারদের ২৯ জন বন্দি হয় মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে।
ছায়েরা বেগমের দুঃসাহসিক এ ভূমিকার কথা জানা যায় বীরযোদ্ধা মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়ার ‘জনযুদ্ধে গণযোদ্ধা’ গ্রন্থ থেকে। মুক্তিযুদ্ধের ৩ নম্বর সেক্টরের মুকুন্দপুর সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল সায়ীদ আহমেদ বিপি (অব.) কাছ থেকে।