বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির চেয়ারম্যান এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এমপি বলেছেন, ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিলে শপথ গ্রহণকারী মুজিবনগর সরকার সর্বাত্মক যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিল। সেই সরকারের নেতৃত্বদানকারী সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীন আহমেদ, মনসুর আলী, কামরুজ্জামানের ভূমিকাকে যদি কেউ খাটো করে দেখতে চাই; জাতীয় চার নেতা বলে যারা শেষ করে দিতে চাই, আমি তাদের সাথে একমত নই। কেননা তাঁরা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর চার সুযোগ্য সহচর এবং বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে এই যুদ্ধের দায়িত্ব পেয়েছিলেন তাঁরা।
সোমবার (১৮ এপ্রিল) ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস উপলক্ষে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসন কর্তৃক আয়োজিত ‘ঐতিহাসিক মুজিবনগর দিবস এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
মোকতাদির চৌধুরী বলেন, ২৬ মার্চ থেকে সারাদেশে যুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল কিন্তু এই যুদ্ধের কোনো সংগঠিত রুপ ছিল না। এটিকে একটি ইউনিফায়েড কমান্ডে আনার খুবই প্রয়োজন ছিল। যে প্রয়োজন আমি আপনি না বুঝতে পারলেও ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ঠিকই বুঝেছিলেন; তাই মুজিবনগর সরকার গঠনের আগে তাজউদ্দীন সাহেব যখন তাঁর (ইন্দিরা গান্ধী) সঙ্গে দেখা করতে গেলেন তখন তিনি (ইন্দিরা গান্ধী) তাঁকে বলেছিলেন, সরকার গঠন করছো বোধহয়। তিনি (ইন্দিরা গান্ধী) জানতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কোথায়, তারপরও তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন শেখ মুজিব কোথায়? তাজউদ্দীন সাহেব অত্যন্ত বুদ্ধিমান ছিলেন, তিনি তাঁর উত্তরে বললেন, হ্যাঁ, আমরা সরকার গঠন করছি, সেখানে বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপ-রাষ্ট্রপতি এবং আমাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে রাখা হয়েছে।
সাবেক ছাত্রনেতা মোকতাদির চৌধুরী বলেন, মুজিবনগর সরকারে শুধু বেসামরিক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদেরকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি, এখানে সামরিক বাহিনী থেকে আসা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদেরকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। এরমধ্যেই ছিলেন কর্ণেল আতাউল গনি ওসমানী এবং তাঁর ডেপুটি হিসেবে ছিলেন কর্ণেল রব।
যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা মোকতাদির চৌধুরী আরও বলেন, অনেকেই বলার চেষ্টা করেন- গ্রেফতার হওয়ার পূর্বে বঙ্গবন্ধু কোনো নির্দেশনা দিয়ে যাননি, তাদের কাছে আমার প্রশ্ন হলো বঙ্গবন্ধু যদি কোনো নির্দেশনা দিয়ে না যেতেন তাহলে সামরিক ও বেসামরিক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব যারা ছিলেন তাঁরা হঠাৎ করে ইন্ডিয়াতে গেলেন কেন? তাঁরা তো বার্মাতেও যেতে পারতেন।
তিনি বলেন, আপনারা যারা সামরিক বাহিনীর ও পুলিশের কর্মকর্তারা আছেন, তারা সকলেই জানেন একটি বুলেটও যদি সরকারের অনুমোদন ব্যাতিরেখে আপনি খরচ করেন, তাহলে সেটির জন্য আপনাকে জবাবদিহি করতে হবে। কিন্তু ২৬ মার্চ সকাল থেকে হাজার হাজার বুলেট বিএসএফের পক্ষ থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের সরবরাহ করা হয়েছে। এটি কীভাবে সম্ভব হয়েছে?
প্রবীণ এই আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, ঐ সময়ে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের সাপেনেউলে সম্পর্ক ছিল, অথচ মেজর জিয়া, মেজর রফিক, মেজর খালেদ মোশাররফ, মেজর কেএম শফিউল্লাহ তাঁরা সবাই ভারতে যাচ্ছেন, ভারতের সেনাবাহিনী তাঁদেরকে সাদরে গ্রহণও করছে; এটা কী বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা ছাড়াই হয়েছে? শেখ মুজিবের ভূমিকা না থাকলে মিসেস গান্ধী সরকার এমনিতেই কী তাদেরকে ভারতের ভিতরে ঢুকিয়ে ছিল?
মোকতাদির চৌধুরী বলেন, খালেদ মোশাররফ, জিয়াউর রহমান, কে এম শফিউল্লাহ বন্দুক নিয়ে কয়েকটি ফুটফাট করলেন, আর আমরা কয়েকটি ফুটফাট করলাম, এটি কিন্তু যুদ্ধ নয়। ১৭ এপ্রিলের পর থেকেই মূলতঃ সারাদেশে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়। আজকে অনেকে অনেক বিতর্ক করতে পারেন, সেদিনও অনেকে অনেক বিতর্ক করেছে। কিন্তু আলটিমেটলি মুজিবনগর সরকারের ওপরই সকল স্বাধীনতা প্রেমী মানুষের আনুগত্য ছিল। এমনকি যেসমস্ত ফোর্সেস, মুজিবনগর সরকারের ফোর্সের বাহিরে থেকে কাজ করেছে, যেমন মান্নান ভূঁইয়ার নেতৃত্বে একটা ফোর্স, কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে যে ফোর্স ছিল তাদেরও মুজিবনগর সরকারের ওপর পূর্ণ আনুগত্য ছিল। তাছাড়া আমরা যারা মুজিব বাহিনীতে ছিলাম, আমরা কিন্তু মুজিবনগর সরকারের অংশ নয়; তবে আমরা এ সরকারের প্রতি অনুগত ছিলাম।
জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বলেন, সেসময় মুজিবনগর সরকারের প্রতি বিপুলসংখ্যক বাঙালি কূটনীতিক আনুগত্য প্রকাশ করেছিল। জাস্টিস আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে লন্ডনে বিশাল বাঙালি গোষ্ঠী স্বাধীনতার পক্ষে আন্দোলন গড়ে তুলেছিল এবং আবু সাঈদ চৌধুরীকে একসময় জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে প্রেরণ করা হয়। সেখানে কিন্তু মোস্তাক যেতে পারেননি, কেন যেতে পারেননি মোস্তাক? কারণ মোস্তাক ছিলেন মন্ত্রিসভার ভেতরে পঞ্চম বাহিনী। তার (মোস্তাক) চক্রান্তের বিষয়টি সেসময় বাঙালি ও ইন্ডিয়ান ইন্টেলিজেন্টদের কাছে ধরা পড়ে যায় এবং তারা জানতে পারেন, মার্কিনীদের মাধ্যমে পাকিস্তানের সাথে একটা সমঝোতা করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে সে।
তিনি বলেন, মুজিবনগর সরকার সশস্ত্র যুদ্ধের পাশাপাশি কূটনৈতিক ও প্রোপাগাণ্ডা যুদ্ধও চালিয়েছিলো। কূটনৈতিক যুদ্ধের অগ্রভাগে ছিলেন আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কৃতিসন্তান দেওয়ান মাহবুব আলী। তিনি সেসময় বিশ্ব শান্তি পরিষদের এক্সিকিউটিভ কমিটিতে বক্তৃতা দিতে গিয়ে হার্টফেল করে মৃত্যুবরণ করেছিলেন, আমি তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।
মোকতাদির চৌধুরী বলেন, পঁচাত্তরের পরে যারা বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করেনি, তারা এখন সামনে এসে শুধু বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করে এবং তারাই মুজিবনগর সরকারকে বাইপাস করতে চাই।
তিনি বলেন, সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীন আহমেদ, মনসুর আলী এবং কামরুজ্জামানের নেতৃত্বাধীন যে মুজিবনগর সরকার বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা অনুসারে নয় মাস যুদ্ধ চালিয়েছিল, সেই মুজিবনগর সরকার ইতিহাসে অত্যন্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ সরকার। ১৭ এপ্রিল ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন, এই দিনটিকে খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই। আমি আশা করব, জননেত্রী শেখ হাসিনা এই দিনটিকে ভবিষ্যতে যথাযথ গুরুত্ব দিবেন, যাতে আমরা আরও জাঁকজমকপূর্ণভাবে এই দিবসটি উদযাপন করতে পারি। আমাদের প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে সবাই যেন মুজিবনগর সরকাররের গুরুত্ব অনুধাবন করে এবং স্বাধীনতার গুরুত্ব অনুভব করে সেটার জন্য আমি বঙ্গবন্ধু কন্যাকে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার অনুরোধ জানাব।