গত ১৪ এপ্রিল বৃহস্পতিবার শেষ বেলায় রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় নিশ্চিত করে- কৃষ্ণসাগরে রুশ যুদ্ধজাহাজ মস্কভা ডুবে গেছে। তাদের ভাষ্য অনুসারে, মস্কভা ডুবেছে অজ্ঞাত এক কারণে সৃষ্ট অগ্নিকাণ্ডের ফলে। ইউক্রেন দাবি করেছে, তাদের ছোড়া নেপচুন ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে মস্কভা ডুবেছে। তবে কোনো স্বাধীন সূত্র মস্কোর খুব গর্বের এ যুদ্দজাহাজটি ঠিক কী কারণে ডুবেছে, তা পরিস্কার করেনি।
এদিকে এ ঘটনার পরপরই যুক্তরাষ্ট্র এটা নিশ্চিত করেছে যে, তারা কিয়েভকে প্রতিশ্রুত ৮০০ মিলিয়ন ডলারের সামরিক সরঞ্জামের প্যাকেজটি পাঠাচ্ছে, যেখানে অনেক ভারী অস্ত্রশস্ত্রও থাকবে। এর পাশাপাশি ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক প্রধান জোসেফ বরেল সম্প্রতি যা বলেছেন, তা-ও স্মরণ করা যায়। তিনি সম্প্রতি ‘যুদ্ধজয়ে’ ইউক্রেনকে সক্ষম করে তোলার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন আগে যেসব সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, তা পুনর্ব্যক্ত করেছেন। সব মিলিয়ে এটা এখন অত্যন্ত পরিস্কার, একদিকে মস্কো ইউক্রেনের দোনবাস অঞ্চল তার দখলে নিতে নতুন করে আক্রমণের প্রস্তুতি নিচ্ছে; অন্যদিকে পশ্চিমা শক্তিগুলো সংঘাত কমিয়ে ওই অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে তা আরও বাড়াতে চাচ্ছে এবং এ সংঘাতকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে তাদের পূর্ণমাত্রার এক ছদ্মযুদ্ধে (প্রক্সি ওয়ার) রূপ দিতে চাচ্ছে। অর্থাৎ পশ্চিমারা ইউক্রেনের ঘাড়ে বন্দুক রেখে রাশিয়াকে ঘায়েল করার পরিকল্পনা এঁটেছে।
যুক্তরাষ্ট্র যখন তার কোনো প্রতিপক্ষকে শায়েস্তা করতে চায় তখন সে শুধু ওই দেশটিতে আগ্রাসন চালায় না; বোমাবর্ষণ কিংবা ক্যু সংঘটিত করে শাসক পাল্টানোর মতো অপকৌশল প্রয়োগ করে না; কখনও কখনও দেশটির বিরুদ্ধে ছদ্মযুদ্ধেও অবতীর্ণ হয়। এ অপকৌশলের অংশ হিসেবে সে তার প্রতিপক্ষ দেশটির বিরুদ্ধে সরাসরি সামরিক যুদ্ধে না নেমে ওই দেশের কোনো বিদ্রোহী গোষ্ঠী বা অন্য কোনো দেশকে লেলিয়ে দেয়।
স্নায়ুযুদ্ধের ইতিহাস ঘাঁটলে এর সপক্ষে অসংখ্য উদাহরণ পাওয়া যাবে। আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে আমেরিকা মুজাহিদীনদের লেলিয়ে দিয়েছিল- এটা এখন মার্কিনিরাই স্বীকার করে। ইরান-ইরাক যুদ্ধের নামে সাদ্দাম হোসেনকে যুক্তরাষ্ট্র কীভাবে ইরানের বিরুদ্ধে লাগিয়ে দিয়েছিল, তার কথাও বলা যায়।
অতি সম্প্রতি সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করতে যুক্তরাষ্ট্র কী করেছিল, তা-ও কেউ ভুলে যায়নি। যুক্তরাষ্ট্র আসাদের বিরোধীদের যেভাবে উস্কে দিয়েছিল; যে যুদ্ধ দেশটাকে শুধু ছারখার করেনি, সেখানকার জনগণকে এখনও ভুগিয়ে চলেছে- তা ওই ছদ্মযুদ্ধেরই নামান্তর মাত্র। ছদ্মযুদ্ধটা যুক্তরাষ্ট্র খুব পছন্দ করে। কারণ এর মাধ্যমে সে খুব কম ক্ষতির বিনিময়ে নিজের উদ্দেশ্য সফল করতে পারে। বলা যেতে পারে, কম বিনিয়োগে অধিক মুনাফা। ছদ্মযুদ্ধে তার ক্ষয়ক্ষতি কম হয়। কারণ এ ধরনের যুদ্ধে তার হয়ে অন্য কেউ অকাতরে জীবন দেয়। ছদ্মযুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিদ্বন্দ্বী রাষ্ট্রকে কোণঠাসা করে ভূরাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধিও সহজ হয়। এ অপকৌশল একই সঙ্গে সমরাস্ত্র বিক্রির মাধ্যমে মার্কিন সমর শিল্পের জন্য সর্বোচ্চ মুনাফা অর্জনের পথও খুলে দেয়।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা এক মাস কাটিয়েছে যুদ্ধ বন্ধের জন্য রাশিয়ার প্রতি আহ্বান জানিয়ে। এটা এখন অনেকটাই স্পষ্ট- তারা আর শুধু ওই আহ্বান জানানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই; তারা ইউক্রেনকে সমরাস্ত্র সরবরাহ বৃদ্ধির পাশাপাশি প্রশিক্ষণ ও গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে চলমান যুদ্ধে মস্কোর ক্ষতি যতটা সম্ভব বাড়ানোর চেষ্টায় নেমেছে। বলা হতে পারে, মস্কোই তো এ যুদ্ধের সূত্রপাত ঘটিয়েছে। কথাটা ঠিক। তবে এটাও মানতে হবে যে, যুক্তরাষ্ট্র বরাবরই রুশ-ইউক্রেন সংঘাত চরমে পৌঁছাক, তা চেয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র সব সময় চেয়েছে রাশিয়ার সঙ্গে ইউক্রেনের কোনো সমঝোতা না হোক। তার এ ইচ্ছা পূরণে সে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে শুরু থেকেই উস্কানি দিয়ে যাচ্ছে। আর আমেরিকার কাছ থেকে উৎসাহ পেয়ে জেলেনস্কিও অতি আত্মবিশ্বাসী হয়ে সমঝোতার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সে পথে এগোননি। যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থান এখনও একই রকম। সে চায় এ যুদ্ধের মাধ্যমে যত পারা যায় রাশিয়ার ক্ষতি করতে। তাই কিছুদিন আগেও ইউক্রেন রাশিয়ার মূল দাবিগুলো মেনে নিয়ে যুদ্ধ বন্ধ করতে চাইলে যুক্তরাষ্ট্র তাতে সায় দেয়নি। ফলে, এ কথা বলা মোটেও অতিরঞ্জন হবে না যে, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধটা কিছুদিন আগে থেমে যাওয়ার ইঙ্গিত দেওয়ার পরও এখন যে নতুনভাবে তীব্র হচ্ছে, তার পেছনে আছে মূলত মার্কিন স্বার্থ।
প্রশ্ন হতে পারে- যুক্তরাষ্ট্র কেন এ রকমটা চাইছে? এর উত্তরে বলা যায়- প্রথমত, সম্প্রতি রাশিয়া কৌশলগত কারণে উত্তর ইউক্রেন থেকে নিজেকে সরিয়ে এনে দোনবাস অঞ্চলের প্রতি পূর্ণ মনোযোগ দিতে চেয়েছিল। এর ফলে পশ্চিমাদের ধারণা হয়েছে যে, তারা চাইলে চলমান যুদ্ধে পুতিনের মূল লক্ষ্য অর্জনের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে। দ্বিতীয়ত, রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত তীব্র হলে তা যতদিন চলবে ততদিন পশ্চিমারা মস্কোর ওপর একের পর এক অবরোধ-নিষেধাজ্ঞা দিতে পারবে এবং এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের ইতোপূর্বে দুর্বল হয়ে পড়া ঐক্য আরও শক্তিশালী করা যাবে।
ওয়াশিংটন হিসাব করে দেখেছে যে, এ যুদ্ধের মাধ্যমে এমন একটা ক্ষেত্র প্রস্তুত করা যায় যেখানে চীনকে আরও কোণঠাসা করা যাবে; বিশ্বের বিভিন্ন দেশকে একটা পক্ষভুক্ত হতে বাধ্য করা যাবে এবং সামরিক জোটগুলোকে আরও সম্প্রসারণ করার পথ তৈরি হবে। সম্প্রতি একটা খবর বেরিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র তাকে এবং যুক্তরাজ্য ও অস্ট্রেলিয়াকে নিয়ে তৈরি জোট অকাস (এইউকেইউএস)-এ যোগ দিতে জাপানকে বলেছে। এমনকি যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী জ্যানেট ইলেন চীনকে বলেছেন, তাকে ইউক্রেনে রাশিয়ার আক্রমণের বিরোধিতা করতে হবে। নইলে বিশ্বে এখন পর্যন্ত চীন যতটুকু অবস্থান তৈরি করেছে তা হারানোর জন্য তৈরি হতে হবে। অর্থাৎ এতে এখন আর কোনো রাখঢাক নেই যে, যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকে যতটা দীর্ঘ করতে পারবে, ততই সে তার ভূরাজনৈতিক স্বার্থ উদ্ধারে সফল হবে।
তবে এ যুদ্ধোন্মাদনা যত বাড়বে তত তা রাশিয়ার জন্য ঝুঁকি তৈরি করবে। কারণ এক পর্যায়ে এ যুদ্ধ একটা নতুন ধরনের ‘মহান দেশপ্রেমের যুদ্ধে’ পর্যবসিত হতে পারে। তার মানে, যুদ্ধের এক পর্যায়ে জাতির অস্তিত্বের সংকটবিষয়ক প্রশ্ন উঠতে পারে। এ রকমটা কেন ভাবা হচ্ছে? কারণ যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের এ বাসনা এখন আর গোপন নেই- যুদ্ধটা রাশিয়ার পরাজয়ের মধ্য দিয়ে শেষ হোক। তাদের কেউ কেউ এমনও চায় যে, পুতিনের সামরিক ব্যর্থতা তার ও তার সরকারের পতনের কারণ হোক। বাস্তবে এমন আকাঙ্ক্ষা তো যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ইতোমধ্যে প্রকাশও করেছেন, যদিও হোয়াইট হাউস কূটনৈতিক শিষ্টাচারের সঙ্গে অসংগতিপূর্ণ এ বক্তব্য ধামাচাপা দিতে গিয়ে বলেছে, প্রেসিডেন্ট আসলে পুতিনের বদলে রাশিয়ার ক্ষমতায় অন্য কেউ আসুক, তা চান না। কথাটা তিনি এমনি এমনি বলেছেন। তবে হোয়াইট হাউস যা-ই বলুক, ক্রেমলিন এখন নিশ্চিত- পশ্চিমাদের যে কোনো উপায়ে রাশিয়ার নাকের ডগা পর্যন্ত সামরিক জোট ন্যাটোকে সম্প্রসারণ বিষয়ে তারা যা ভেবেছিল, তা নিছক কল্পনা নয়।
শেষ কথা হিসেবে এটা বলা যায়, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আমাদের এক বিপজ্জনক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্ররা এটা নিয়ে আর কোনো লুকোচুরি করছে না যে, তারা কখনোই শান্তি বা সমঝোতার পক্ষে ছিল না; ইউক্রেন পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত করার মাধ্যমে তারা বিশ্বব্যাপী তাদের ভূরাজনৈতিক আধিপত্য জোরদার করতে চায়। আর এর লক্ষ্যবস্তু হতে পারে রাশিয়া, হতে পারে চীন কিংবা ভারত। তবে রাশিয়ানদের জন্য এ যুদ্ধটা হয়ে গেছে ক্রমবর্ধমান এক সংগ্রাম, যার লক্ষ্য হলো তাদের দেশের ওপর পশ্চিমাদের আধিপত্য কায়েমের চেষ্টা ঠেকানো। তাদেরকে পশ্চিমারা যে জোর করে নিজেদের অধীন করতে চায়, তা ঠেকানো। বলা বাহুল্য, রাশিয়া আর পশ্চিমাদের এ টানাপোড়েনে বলির পাঁঠা হচ্ছে ইউক্রেন।
তিমুর ফোমেনকু : রাজনৈতিক বিশ্নেষক
(রুশ টিভি অনলাইন ইংরেজি পোর্টাল আরটি ডট কম থেকে ভাষান্তরিত)