রাজধানী ঢাকার নিউমার্কেট এলাকায় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সংঘর্ষের সময় হেলমেট পরে নাহিদ হাসানকে হত্যার সঙ্গে জড়িতদের কাউকে এখনো গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। তবে পুলিশ দাবি করছে, এখন পর্যন্ত হেলমেট পরা ১৭ অস্ত্রধারীকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
নিউমার্কেট থানার একটি সূত্র দাবি করেছে, ঘটনাস্থলের আশপাশের শতাধিক সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে এখন পর্যন্ত হেলমেট পরা ১৭ জনকে চিহ্নিত করেছে পুলিশ, যাদের হাতে ধারালো অস্ত্র, হকিস্টিক ও লাঠি-রড ছিল। এরাই ঘটনাস্থলে অন্তত ১৫টি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল।
ডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, তদন্তে কিছু অগ্রগতি থাকলেও সেটি এখনো বলার মতো পর্যায়ে আসেনি। ভিডিও ফুটেজে হেলমেট পরা সবাই অপরাধী নয়। প্রকৃত অপরাধীদের শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করা হবে।
কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মী নাহিদ হাসানের হত্যাকারী শনাক্ত হয়েছে কি না জানতে চাইলে তদন্তসংশ্লিষ্ট এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, নাহিদকে যিনি ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়েছিলেন, তিনি হেলমেট পরা ছিলেন। ভিডিও ফুটেজে তাঁকে চিহ্নিত করা গেছে। তিনি কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী কি না, তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
পুলিশ সূত্র জানায়, নিউমার্কেট এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনায় পুলিশের দুটিসহ এ পর্যন্ত ৪টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে নাহিদ ও মোরসালিন নিহত হওয়ার ঘটনায় দুটি হত্যা মামলা হয়েছে। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশ জানতে পেরেছে, মোরসালিন ঘটনাস্থলে ইটের আঘাতে মারা গেছেন। অন্য কোনো কিছুর আঘাতে তাঁর মৃত্যু হয়েছে কি না তারও তদন্ত চলছে। নিউমার্কেট থানা ছাড়াও ডিএমপির নিজস্ব গোয়েন্দা ইউনিট, মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি), অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি), স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি) ও একাধিক সাইবার টিম সংঘর্ষের ঘটনা তদন্তে কাজ করছে।
গত সোমবার সন্ধ্যায় শুরু হওয়া ওই সংঘর্ষের ঘটনা মধ্যরাতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর উপস্থিতিতে ব্যবসায়ী ও শিক্ষকরা মিটিয়ে ফেলেছিলেন। পরদিন কিভাবে রামদাসহ দেশি অস্ত্র, হকিস্টিক, লাঠি-রড নিয়ে কারা, কেন হামলা চালাল, সেসব বিষয় নিয়ে কাজ করছে গোয়েন্দা সংস্থা।
তদন্তে যা পাওয়া গেছে
তদন্তসংশ্লিষ্ট এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, গত সোমবার রাতের সংঘর্ষের ঘটনা অনেকটা হুজুগে ঘটেছে। কিন্তু পরদিন মঙ্গলবারের ঘটনা ছিল পরিকল্পিত। হামলাকারীরা কয়েকটি ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে হামলা চালায়। তারা রোগীবাহী অ্যাম্বুল্যান্সকেও ছাড়েনি। জ্বালাও-পোড়াওয়ের পাশাপাশি কেউ কেউ কয়েকটি দোকানের ক্যাশবাক্স লুট ও নিউ মার্কেট এলাকার কয়েকটি স্পটে আগুন দেয়।
তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, সংঘর্ষের ঘটনায় অনেকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের পাশাপাশি ছাত্রলীগকে দোষারোপ করছেন। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে ঢাকা কলেজে ছাত্রলীগের কোনো কমিটি নেই। করোনার কারণে ক্যাম্পাসে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডও নেই।
গোয়েন্দা রমনা বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) আজিমুল হক গণমাধ্যমকে বলেন, ঘটনাস্থল থেকে সংগৃহীত সিসিটিভি ফুটেজ যাচাই-বাছাই করে আসামিদের শনাক্ত ও হামলাকারীদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, মার্কেটের ৪ নম্বর গেটের ওয়েলকাম ফাস্ট ফুডের কর্মচারী বাপ্পী ও ক্যাপিটাল ফাস্ট ফুডের কর্মচারী কাওসারের মধ্যে সন্ধ্যায় কথা-কাটাকাটি থেকেই সংঘর্ষের সূত্রপাত। দুটি দোকানের মালিক আপন চাচাতো ভাই। সংঘর্ষের ঘটনায় জড়িতদের বেশির ভাগই দোকান কর্মচারী ও ফুটপাতের হকার। এর বাইরে কিছু বহিরাগত ছিল, যাদের হাতে দেশীয় অস্ত্র ও মাথায় হেলমেট ছিল। তারা কেন এই সংঘর্ষে জড়াল, কেউ উসকানি দিল কি না, সে বিষয়েও তদন্ত চলছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর তথ্যও যাচাই-বাছাই চলছে। এ ঘটনায় কতটুকু রাজনৈতিক ইন্ধন কাজ করেছে তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।
তদন্তসংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, দুই দোকান কর্মচারীর মধ্যে ঘটনার শুরু। এরপর ঢাকা কলেজের কয়েকজন ছাত্র ওই ঘটনায় জড়িয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু তাঁদের কাউকে এখন খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাঁদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। তাঁদের ধরতে পারলে অনেক কিছু জানা যাবে।
সিসিটিভি ফুটেজ দেখে বেশ কয়েকজন হকারকে শনাক্ত করা হয়েছে জানিয়ে এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, একাধিক ফুটেজে ঘুরেফিরে তাঁদের চেহারা দেখা গেছে। বিশেষ করে সাংবাদিকদের ওপর ও অ্যাম্বুল্যান্সে হামলাসহ বেশ কয়েকজন সাধারণ মানুষ ও পথচারীকে লাঠি দিয়ে পিটিয়েছেন এমন কয়েকজনের নাম-পরিচয় পাওয়া গেছে। এর মধ্যে নানা বয়সী অনেক লোক হেলমেট পরে ঘটনাস্থলে অবস্থান করেছিল। তাদের পরিচয় নিয়ে ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে।
বিএনপি নেতা মকবুল রিমান্ডে
পুলিশের মামলায় গ্রেপ্তার বিএনপি নেতা মকবুল হোসেনকে গতকাল তিন দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আদেশ দিয়েছেন আদালত। তাঁকে হেফাজতে রেখে জিজ্ঞাসাবাদ করবে পুলিশ।
এর আগে গত শুক্রবার মকবুলকে ধানমণ্ডি থেকে গ্রেপ্তার করে ডিবি। গতকাল তাঁকে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করে সাত দিনের জন্য হেফাজতে রাখার আবেদন করেন নিউমার্কেট থানার পুলিশ পরিদর্শক (অপারেশন) হালদার অর্পিত ঠাকুর। শুনানি শেষে ঢাকার মহানগর হাকিম মো. মামুনুর রশিদ তিন দিন রিমান্ডের আদেশ দেন।
তদন্ত কমিটি করবে বিএনপি
সংঘর্ষের প্রকৃত ঘটনার তদন্তে দলের তিন সদস্যের কমিটি করা হবে বলে জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
তিনি বলেন, নিউমার্কেটের সংঘর্ষের ঘটনা প্রমাণ করেছে, দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি কতটা নাজুক। পুলিশের উপস্থিতির মধ্যেই ভয়াবহ হামলা-পাল্টাহামলা, মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে হেলমেট পরিহিত সন্ত্রাসীরা পিটিয়ে মানুষ মারছে। অথচ পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা জনগণের মধ্যে সন্দেহের সৃষ্টি করেছে।
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, স্থায়ী কমিটির বৈঠকে নিউমার্কেটের ঘটনায় নাহিদ ও মোরসালিনের নিহত হওয়ায় শোক প্রকাশ করা হয়। একই সঙ্গে ওই ঘটনায় আহত সাংবাদিকসহ অন্য ব্যক্তিদের আশু সুস্থতা কামনা করা হয়েছে।