রাজধানীর তেঁতুলতলা মাঠ রক্ষার আন্দোলনের কারণে একজন মাকে তাঁর সন্তানসহ তুলে নিয়ে হাজতে রাখার ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মানবাধিকারকর্মী, পরিবেশ রক্ষা আন্দোলনকর্মী ও বিভিন্ন নাগরিক সংগঠনের নেতা–কর্মীরা। তাঁদের মতে, পুলিশের এ আচরণ ধৃষ্টতা নয়, দুবৃর্ত্তায়ন।
সোমবার বিকেল সাড়ে তিনটায় রাজধানীর কলাবাগানে তেঁতুলতলা মাঠে মাঠটি রক্ষায় আয়োজিত নাগরিক সমাবেশে তাঁরা এ ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
‘তেতুঁলতলা মাঠে থানা নয়, এলাকাবাসীকে হয়রানি ও আটকের প্রতিবাদ’ ব্যানারে অনুষ্ঠিত নাগরিক সমাবেশ আয়োজন করে এএলআরবি, বাপা, বেলা, আসক, ব্লাস্ট, গ্রিন ভয়েজ, নিজেরা করি, নাগরিক উদ্যোগ, নারীপক্ষ, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী, হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটি ও টিআইবি।
মানবাধিকারকর্মী খুশী কবীর বলেন, এই মাঠ উন্মুক্ত রাখতে হবে। কোনো থানা তো নয়ই, কোনো ক্লাব বা ব্যক্তিমালিকানায় দেওয়া যাবে না। এই মাঠ এলাকার সবার।
আগামীকালের মধ্যে থানার ভবন নির্মাণের সামগ্রী সরিয়ে ফেলার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা হাত দেব না। তবে কালকের মধ্যে পুলিশ যদি এগুলো না সরায়, তাহলে আমার সবাই মিলে এগুলো সরিয়ে দেব।
খুশী কবির বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য জনগণের টাকায় পুলিশের বেতন হয়, প্রশিক্ষণ হয়, আইন অনুযায়ী কী করতে পারবে, কী করতে পারবে না, সেগুলো তাদের শেখানো হয়। তারপরও আমরা দেখি, গতকালের ঘটনা তো বটেই, এর আগেও পুলিশ এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছে, যার জন্য তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিতে হয়েছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, আমাদের আন্দোলন কোনো বাহিনী বা থানার বিরুদ্ধে লড়াই নয়। এটি পরিবেশ রক্ষা, নাগরিক অধিকার ও বাক্স্বাধীনতার লড়াই। আগামীকালের মধ্যে এই মাঠের ব্যবস্থাপনা এলাকাবাসীর হাতে ছেড়ে দেবেন এবং সব স্থাপনা পুলিশকে খুলে উন্মুক্ত করে দিতে হবে।
চার দফা দাবি তুলে ধরে তিনি বলেন, এই মাঠ সবার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। থানা করতে হবে এটা যৌক্তিক, তবে শিশুদের খেলার মাঠ দখল করে নয়, প্রয়োজনে থানার জন্য বিকল্প জায়গা খুঁজে দেওয়া হবে। আসন্ন ঈদের জামাত এখানে অনুষ্ঠিত হবে। বেআইনিভাবে রত্না ও তাঁর ছেলেকে হয়রানি করা যাবে না, তাঁর পরিবারকে নিরাপত্তা দিতে হবে। এভাবে আর কাউকে হযরানি করা যাবে না।
মুচলেকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, মাঠ রক্ষায় আর আন্দোলন করা যাবে না, এটা কী ধরনের মুচলেকা। মা-ছেলেকে আটক করে থানায় নিয়ে হেনস্তার ঘটনায় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত করে দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনুরোধ জানান তিনি।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্ম সম্পাদক ইকবাল হাবিব বলেন, মাঠ রক্ষার জন্য যখন একজন মা প্রতিবাদে দাঁড়িয়ে যান, সেই মায়ের জাতকে যখন পুলিশ গারদে ভরার সাহস দেখায়, তখন সেটা ধৃষ্টতা নয়, দুর্বৃত্তায়ন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, কোনো এলাকায় উন্মুক্ত স্থান ও খেলার মাঠ দখলকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। যদি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কতিপয় সদস্যদের মনে দুর্বৃত্তায়নের মনোভাব তৈরি হয়ে থাকে, তারা জেনে নিন, রত্না সেখানে গিয়েছিলেন শেখ হাসিনার নির্দেশনা পালন করার জন্য।
পুলিশ বাহিনীর উদ্দেশে তিনি বলেন, আইজিপি প্রায়ই বলে থাকেন, আমরা মানবিক পুলিশ বাহিনী গড়ে তুলতে চাই। এই কি মানবিক পুলিশ বাহিনীর পরিচয়? যেখানে আইনকানুন বলছে কোনো উন্মুক্ত স্থান ও খেলার মাঠ দখল করা যাবে না, সেখানে পুলিশ শিশুদের খেলার মাঠ দখল করে থানা ভবন নির্মাণ করার পাঁয়তারা করছে।
উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সাধারণ সম্পাদক জামশেদ আনোয়ার তপন বলেন, এই মাঠ আমরা ছাড়ব না। এই মাঠ এলাকাবাসী ও শিশুদের খেলার জন্য উন্মুক্ত থাকবে। এই মাঠ দখলের জন্য যদি কোনো চক্রান্ত করা হয়, তবে আমরা দেশবাসীকে সঙ্গে নিয়ে তা প্রতিহত করব।
বাংলাদেশ স্থপতি ইনস্টিটিউটের সাবেক সভাপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, আমি একজন স্থপতি হিসেবে বলতে চাই, ডাম্পিংসহ যে ধরনের সুযোগ–সুবিধা একটি থানার থাকা প্রয়োজন, তার কোনোটি এখানে নেই। আর যদি জোর করে এখানে থানা নির্মাণ করা হয়, তবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এটি থানা নয়, শত্রু ভবন হিসেবে পরিচিত হবে। পুলিশ জনগণের বন্ধু, বন্ধু হয়ে কীভাবে বন্ধুর সঙ্গে এমন আচরণ করে।’ পুলিশকে জনগণের বন্ধু হয়ে মাঠ রক্ষায় এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
মোবাশ্বের হোসেন বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশনার পরও যাঁরা বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নির্মাণকাজ চালিয়েছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে জামিল হোসেন জানান, এই মাঠে আমাদের অনেক স্মৃতি রয়েছে। কলাবাগান এলাকার একমাত্র মাঠ এই তেঁতুলবাগান। এখানে থানা হলে শিশুরা খেলার জায়গা হারাবে। তাই এখানে থানা ভবন না নির্মাণ করে অন্যত্র করার দাবি জানাই।