উৎসব, ঘরে ফেরা ও বিড়ম্বনা

চিররঞ্জন সরকার

ঈদযাত্রা
ঈদযাত্রা। ফাইল ছবি

উৎসবে-অনুষ্ঠানে, ঈদে কিংবা পূজায় বাড়ি ফেরাটা আমাদের অভ্যাস। পরিবারের সবার সঙ্গে মিলিত হওয়ার একটা দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা আমাদের মধ্যে কাজ করে। এর জন্য যারপরনাই দুর্ভোগ পোহাতে হয়। পোহাতে হয় বেহাল সড়কে পথে পথে চরম ভোগান্তিও। সৃষ্টি হয় দীর্ঘ যানজট। বাস-ট্রেনের শিডিউলেও বিপর্যয় ঘটে। এতসব দুঃখ-দুর্দশা-দুর্ভোগ উপেক্ষা করে মানুষ ঈদ-উৎসবের জন্য নাড়ির টানে বাড়ি ফেরে। বসে, দাঁড়িয়ে, প্রয়োজন হলে হেঁটে আপনজনের কাছে পৌঁছাতেই হবে। উৎসবে যারা রাজধানী বা বিভিন্ন শহর থেকে গ্রামে ফিরতে চান, তাদের সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হয় আগাম টিকিট সংগ্রহ করতে গিয়ে। ফিরতেও একই বিড়ম্বনা। যানজটের কারণে দীর্ঘ সময় ধরে আসা-যাওয়ায় সীমাহীন দুর্ভোগের সঙ্গে যোগ হয় বাস খাদে পড়া, নানা ধরনের দুর্ঘটনা কিংবা লঞ্চডুবিতে সলিলসমাধি অথবা অজ্ঞান-মলম পার্টির খপ্পরে পড়ার আশঙ্কা।

তবু মানুষ উৎসবে ঘরে ফিরতে চায়। ঘরে ফেরে। এসব উৎসবে-অনুষ্ঠানে আমরা অনেক আনন্দ করতে চাই। ভালো খেয়ে-পরে পরিবারের সবাই মিলে একত্রে কাটাতে চাই। তাই তো উৎসব ঘিরে আমাদের কত পরিকল্পনা। কত স্বপ্ন, অপেক্ষা। যদিও অনেকের জীবনে উৎসব-অনুষ্ঠান সীমাহীন বিড়ম্বনা, টাকার শ্রাদ্ধ, অতৃপ্তি আর অবসাদ ছাড়া নগদ তেমন কিছুই দিতে পারে না। কোনো কোনো মধ্যবিত্তের কাছে উৎসব-অনুষ্ঠান এক আপদ ও আতঙ্কের নাম। এর অবশ্য অনেক কারণ আছে।

উৎসবের আনন্দ উপভোগ করতে হলে আরো অনেক কিছু যোগ করতে হয়। সবার আগে আসে টাকার প্রশ্ন। উৎসবে সবাই চায় একটু ভালো পরতে, ভালো খেতে। কিন্তু সীমাবদ্ধ আয়ের মধ্যবিত্তকে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই আয়ের সঙ্গে ব্যয়ের সামঞ্জস্য বিধান করতে গিয়ে ভীষণরকম সমস্যায় পড়তে হয়। সন্তানরা যে-যেমনটি চায়, তেমনটি বাজেট স্বল্পতার কারণে দেওয়া সম্ভব হয় না। তার পরও কথা থেকে যায়। নিজের বাবা-মা, ভাইবোনকে সন্তুষ্ট করা গেল তো শ্বশুরবাড়ির লোকজনকে নাখোশ করতে হয়। আবার শ্বশুরপক্ষীয় আত্মীয়দের মন জোগাতে গেলে অন্যরা বেজার হয়। খাওয়া-পরার ব্যাপারটা কোনোরকমে সামাল দেওয়া গেলেও বেড়ানোর ব্যাপারটা এখন কিছুতেই ম্যানেজ করা যায় না। এখন মধ্যবিত্তরা ভ্রমণপিপাসু হয়ে উঠেছে। উৎসবে-অনুষ্ঠানে শুধু জামা-কাপড়-জুতা আর খাওয়াদাওয়াতেই সীমাবদ্ধ নেই। এখন ঘুরতে বা বেড়াতে যাওয়াটাও অনিবার্য অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেকেই এখন ঈদের ছুটিতে দেশের বাইরে বেড়াতে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। এখানেও সমস্যা, কোথায় যাবেন, কীভাবে যাবেন। এ ব্যাপারে বাবা-মার সঙ্গে সন্তানদের মতের মিল হয় খুব সামান্য ক্ষেত্রেই। অনেক পরিবারে আবার সন্তানরা বাবা-মার সঙ্গে ঘুরতে যেতে চায় না। বন্ধুবান্ধবরা মিলে নিজেদের মতো করে ঘুরতে চায়। বাবা-মা সায় না দিলে রীতিমতো বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার হুমকি আসে। এই বিগড়ানো সন্তানদের বশে রাখাটাই তখন অভিভাবকদের প্রধান দায় হয়ে পড়ে! উৎসব এলে এখন অনেকে তাই বিপন্ন হয়ে পড়েন। কী করবেন, কোথায় যাবেন, সন্তানদের কীভাবে ম্যানেজ করবেন, আত্মীয়স্বজনদেরই-বা কীভাবে বুঝ দেবেন, বাড়তি টাকার জোগাড় কীভাবে হবে, এসব নিয়ে অতিরিক্ত টেনশন সৃষ্টি হয়। তার পরও উৎসবে যারা গ্রামে যান, তাদের অভিজ্ঞতাও অত্যন্ত করুণ। কারণ রাস্তাঘাটের বেহাল দশা।

ষাটের দশকের বিখ্যাত বাংলা সিনেমা ‘সপ্তপদী’তে উৎতম-সুচিত্রা জুটি আঁকাবাঁকা মসৃণ পথে মোটরবাইকে চেপে ‘এই পথ যদি না শেষ হয়, তবে কেমন হতো তুমি বলো তো’ গেয়ে মধ্যবিত্ত বাঙালির মনে এক চমত্কার রোমান্টিক আবেগ জাগিয়েছিলেন। সড়ক, মহাসড়ক বা পথে নামলে তখন মন উতলা হতো, সুদূরের আহ্বানে ছুটে বেড়াতে চাইত মন। হারিয়ে যাওয়া, ছুটে চলার আকাঙ্ক্ষায় চিত্ত ব্যাকুল হয়ে উঠত। পথে নামলে তখন কেবলই মনে হতো এই পথ যদি না শেষ হয় তবে কেমন হতো। কালের বিবর্তনে এখন পথ আর আমাদের টানে না, বরং পথ এখন আতঙ্কের নাম। বেঁচে থাকার তাগিদে আমাদের পথে নামতেই হয়, এখানে-ওখানে যেতেই হয়। কিন্তু এই আসা-যাওয়ার কাজটা আমাদের জীবনে সীমাহীন বিড়ম্বনা, দুর্ভোগ আর আতঙ্ক নিয়ে এসেছে। পথে নামতে হলে, কোথাও যেতে হলে গায় জ্বর আসে। কেবলই মনে হয়, হায়, ওখানে পৌঁছাতে পারব তো? অক্ষত ফিরতে পারব তো?

সারা দেশেই সড়ক-মহাসড়কের বেহাল অবস্থা। আমাদের দেশে মহাসড়কগুলোতে সারা বছরই সংস্কারকাজ চলে। নতুন নতুন সেতু নির্মাণ, ফ্লাইওভার, সংযোগ সড়ক, নতুন নতুন লেন তৈরি, পুরোনো সড়কের কার্পেটিংয়ের কাজ ইত্যাদি নানা কাজ চলতেই থাকে। সড়কগুলোতে কখনই নির্বিঘ্নে গাড়ি চলাচল করতে পারে না। আন্তঃজেলা পর্যায়ের সড়কগুলোর অবস্থা আরো করুণ। খানাখন্দে ভরা সড়কগুলো সংস্কারের উদ্যোগ নেই। ঝুঁকি নিয়েই চলছে যানবাহন। বাড়ছে দুর্ঘটনা। কোথাও কোথাও চলতে গিয়ে সৃষ্টি হচ্ছে তীব্র যানজট। চার ঘণ্টার পথ পাড়ি দিতে লাগছে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা।

এখন সড়ক কর্তৃপক্ষ যদি দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের ভার গ্রহণ করে সেটা ভিন্ন কথা। তা নাহলে তাদের তো নড়েচড়ে বসা প্রয়োজন! সড়কপথে যারা আসা-যাওয়া করেন তারা যে ‘মরতে চান’, তা তো নয়, অনেকে তো বাঁচতেও চান। যারা বাঁচতে চান তাদের জোর করে মেরে ফেলার ব্যবস্থা করাটা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দায়িত্ব কি না, সেটাও ভেবে দেখা দরকার!

আমাদের দেশের সড়কমন্ত্রী খুবই সরব। তার পরও আমাদের সড়কের দশা যে লাউ সেই কদু। এখানে যেনতেনভাবে নির্মাণকাজ শেষ করা হয়। সড়ক সংস্কারের নামে যে টাকা ব্যয় করা হয়, তারও কোনো মা-বাপ নেই। কাজের মানও যাচ্ছেতাই। সর্বোচ্চ ১৫ দিন টেকসই হয় এসব সড়ক। প্রয়োজনমতো বিটুমিন ও অন্যান্য উপকরণ না দিয়েই শুধু পিচ ব্যবহার করে সড়কের রং করা হয়। ফলে একবার বৃষ্টি হলে বা দু-চারটি গাড়ি চললে আবার আগের পরিস্থিতিতেই ফিরে যায়। এগুলো সবাই জানে। পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখাও হয়। কিন্তু আমাদের এই স্বাধীন দেশে এসব কে কেয়ার করে?

বিশেষজ্ঞরা বলেন, বাংলাদেশের মতো বৃষ্টিবহুল দেশে কংক্রিটের রাস্তা টেকসই। প্রাথমিক খরচ বেশি হলেও ১০ থেকে ১২ বছরের মধ্যে সেটাই ব্যয়-সাশ্রয়ী বলে প্রমাণিত। কিন্তু আমরা তা করি না। আমাদের সড়কে পানি জমে বিটুমিনের ৯০ শতাংশ নষ্ট হচ্ছে, বর্ষায় হাজার হাজার কিলোমিটার সড়ক নাজুক হয়ে যায়। তবু আমরা কংক্রিটের পথে হাঁটছি না। কারণ আমরা সমস্যার মধ্যে থাকতে পছন্দ করি, অন্যকে সমস্যার মধ্যে রাখতে পছন্দ করি। তাই তো যথাযথ পথ কখনো অনুসরণ করতে চাই না। একটা রাস্তা বানানোর সময় মাটি পরীক্ষা করতে হয়, খোয়া নাকি নুড়ি ব্যবহার করা হচ্ছে, তার আকার-প্রকার কী, কতটা পানি ব্যবহার করা হচ্ছে, কতটা চাপ প্রয়োগ করা হচ্ছে, কোন স্তর কত পুরু করা হচ্ছে, এর প্রতিটির হিসাব আছে, বৈজ্ঞানিক মাপ ও নিয়ম আছে। যথাযথভাবে বানালে বিটুমিনের রাস্তা ১২ বছরেও কিছু হওয়ার কথা নয়। কিন্তু আমরা তা করি না। আমরা নিজেরা টাকা মারতে চাই। অন্যকেও পাইয়ে দিতে সহযোগিতা করি। এই পাওয়া আর পাইয়ে দেওয়ার খেলায় আমরা উদার, সাম্যবাদী। ফলে প্রকল্প হয়, কাজ হয়, কিন্তু তা মানসম্মত হয় না। একটা প্রকল্প হতে হবে সম্ভাব্যতা যাচাই-বাছাই করে, তার পরিবেশগত অভিঘাত বিবেচনায় নিয়ে, তারপর ঐ প্রকল্পটা পাবে সবচেয়ে যোগ্য-দক্ষ-অভিজ্ঞ ব্যয়সাশ্রয়ী প্রতিষ্ঠান, গোপন টেন্ডারের মাধ্যমে, তারপর প্রতিটি স্তরে সেটার প্রকৌশল মান নিরীক্ষা করা হবে। আমরা জানি, বালু আর সিমেন্ট মেশাতে হয় ইট গাঁথার সময়, কিন্তু তাতে কতটা পানি দেওয়া হবে, সেটারও যে মাপ আছে, তা কি আমরা জানি? জানলেও তা কী আমরা মানি?

মানি না, কারণ মানার দরকার হয় না। আমরা অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করেছি। চুরিচামারির সব ব্যবস্থা পাকা করে ফেলেছি। তাই তো আমাদের সব খোঁড়াখুঁড়ি শুরু হয় বর্ষাকালে। কারণ জুন মাসে বাজেট পেশ করা হয়, আগের বছরে যা বরাদ্দ হয়েছিল জুন মাসের মধ্যে ব্যয় না করলে টাকা ফিরে যাবে, তাই জুন মাসে আমরা রাস্তা খুঁড়তে শুরু করি। পাকা রাস্তার বিশেষ করে পিচঢালা রাস্তার প্রধান শত্রু জমে থাকা পানি। আমাদের পথে পানি জমবেই। কারণ পানি নেমে যাওয়ার জায়গা নেই। রাখা হয় না। যারা এগুলো ফি বছর করেন, তারা যেন ইচ্ছে করেই এসব করেন। জনবহুল দেশে মানুষকে কষ্ট দিয়ে, দুর্ভোগের মুখে ঠেলে দিয়ে যেন তারা ধৈর্যের পরীক্ষা নেন। জীবনসংগ্রামে কষ্টসহিষ্ণু হিসেবে গড়ে ওঠার পাঠ দেন!

আমরাও সব মেনে নিতে শিখেছি। ধৈর্যশীল হতে শিখেছি। কারণ আমরা জানি, ধৈর্যই ধর্ম, যে সহে সে রহে! দেশের রাস্তাঘাট বা সড়কপথ আমাদের জাহান্নামের পথে নিয়ে গেলেও আমরা ধৈর্য হারাইনি। এখনো হারাচ্ছি না।

লেখক : রম্যরচয়িতা

শেয়ার করুন