ইউক্রেন যুদ্ধকে কেন্দ্র করে কয়েক মাস ধরে ব্যাপক নিষেধাজ্ঞার খড়গে কাটা পড়েছে রাশিয়া। এবার ইউরোপকে পালটা আক্রমণ করার কৌশল নিয়ে এগোচ্ছে মস্কো। ইউরোপীয় ঐক্যে ফাটল ধরাতে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের এখন সবচেয়ে বড় হাতিয়ার ধ্রুপদী গ্যাস-রাজনীতি। নাৎসিবিরোধী এই রুশনেতার এবারের লক্ষ্য শক্তিশালী গ্যাস-অস্ত্র ব্যবহার করে ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল-ভাগ করো, শাসন করো।’
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, ‘পুতিনের গ্যাস-অস্ত্র মোকাবিলা ইউরোপীয় ঐক্যের জন্য এক অগ্নিপরীক্ষা। রাশিয়ার গ্যাস আমদানিকে কেন্দ্র করেই এবার ভাঙতে শুরু করবে বৃহত্তর ঐক্য ফোরাম ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। এ পরীক্ষায় হেরে গেলেই ভেঙে যাবে ইইউ।’ ডেইলি সাবাহর বিশ্লেষণ।
রাশিয়ার গ্যাস রপ্তানির বড় বাজার ইউরোপের অধিকাংশ দেশ। রাশিয়ার গ্যাসের ওপরই নির্ভর করছে এসব অনেক দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি। তাই ইউরোপকে কাবু করতে এই শক্তিশালী রপ্তানি অস্ত্রই ব্যবহার করতে শুরু করেছেন ভ্লাদিমির পুতিন। সম্প্রতি দুই ন্যাটো সদস্য পোল্যান্ড ও বুলগেরিয়াতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে তারই নমুনা দেখিয়েছেন পুতিন। বিভিন্ন নিষেধাজ্ঞার কুফল থেকে বাঁচতে দেশগুলোকে রাশিয়ান মুদ্রা রুবলে গ্যাস কিনতে বাধ্য করছে মস্কো। নয়তো গ্যাস বন্ধ।
এ সিদ্ধান্তকে ‘ব্ল্যাকমেইল’ হিসাবে নিন্দা জানালেও এর ফলেই মহাদেশটির দুর্বলতা ও বিভাজন প্রকাশ করবে বলে মনে করছেন বিশ্বরাজনীতির বিশেষজ্ঞরা। ব্রাসেলসের ব্রুগেল থিঙ্কট্যাঙ্কের সিনিয়র ফেলো সিমোন ট্যাগলিয়াপিত্রা বলেন, ‘এটি একটি ধ্রুপদী বিভাজন ও শাসনের কৌশল। এই সিদ্ধান্ত অভূতপূর্ব এবং ভূ-রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে চিহ্নিত হতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘রুবলে অর্থ প্রদানের রাশিয়ান সিদ্ধান্তের মূল লক্ষ্য, ইউরোপীয় দেশগুলোকে বিভক্ত করা। পরিস্থিতিটি ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য দেশগুলোকে রাশিয়ার প্রক্রিয়া ব্যবহার করলে নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করা হবে কিনা তা নিয়ে বিভক্তির সৃষ্টি হয়েছে। কারণ রাশিয়ার নতুন নিয়ম অনুযায়ী ক্রেতাদের গ্যাসের মূল্য ইউরো বা ডলারে জমা দেওয়ার জন্য রাশিয়ান গাজপ্রমব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে, যেখান থেকে তা রুবলে গ্যাসের মূল্য পরিশোধ করার জন্য উপযোগী হবে। এই লেনদেন রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংককে জড়িত করবে-যা ইইউ নিষেধাজ্ঞার অধীন। গত সপ্তাহে ইইউ কর্মকর্তারা ইঙ্গিত দিয়েছেন রাশিয়ার ওই ব্যাংকে হিসাব খোলা ইইউর নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করতে পারে। পোলিশ ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স (পিআইএসএম)-এর শক্তি নীতি বিশ্লেষক ম্যাকিয়েজ জানিউইচের মতে এটাই সবচেয়ে বড় প্রশ্ন যে, দেশগুলো কি ইউরো/ডলারে অর্থ প্রদানের নির্দেশনা মেনে চলবে-নাকি রুশ সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে নিজেদের পথ বেছে নেবে।’ তিনি বলেন, ‘ইইউ দেশগুলো রাশিয়ান গ্যাসের ওপর অনেক বেশি নির্ভরশীল।’
আগামী শীতকালটাই বড় সমস্যায় ফেলবে ইউরোপকে। আর এই ঋতুই পুতিনের সেরা মিত্র। কারণ এ সময় ইইউ দেশগুলোতে ঠাণ্ডা কাটাতে গ্যাসের চাহিদা বেড়ে যায়।
নতুন নিষেধাজ্ঞা নিয়ে দুভাগ ইইউ
ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার হামলা শুরু হওয়ার পর থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন মস্কোর ওপর মোট পাঁচ বার একগুচ্ছ কড়া নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছে। এবার ষষ্ঠ দফার নিষেধাজ্ঞার খসড়া প্রস্তুত করা হচ্ছে। এর আওতায় আগস্ট মাসের মধ্যেই রাশিয়া থেকে পেট্রোলিয়াম আমদানি পুরোপুরি বন্ধ করার তোড়জোড় করছে ইইউ কমিশন।
রাশিয়ার জ্বালানি খাতের ওপর এ অবরোধ নিয়ে বিভক্তি দেখা দিয়েছে খোদ ইইউর মধ্যেই। জ্বালানি খাতের ওপর নিষেধাজ্ঞার বিরোধিতা করেছে ইইউ সদস্য হাঙ্গেরি ও স্লোভাকিয়া। নিষেধাজ্ঞার প্রস্তাব পাশ হতে সংস্থার ২৭টি সদস্য রাষ্ট্রের অনুমোদন লাগবে। তবে বিশেষ বিবেচনায় হাঙ্গেরি কিংবা স্লোভাকিয়াকে সাময়িক সময়ের জন্য নিষেধাজ্ঞা থেকে অব্যাহতি দেওয়া হতে পারে বলে জানিয়েছে ইইউ সূত্র।