ভোজ্যতেলের আন্তর্জাতিক বাজারে দীর্ঘদিন ধরে রাজত্ব করে আসছে ইন্দোনেশিয়া। দেশটি বৈশ্বিক চাহিদার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ভোজ্যতেল সরবরাহ করে। তবে তাদের ‘অননুমেয়’ রপ্তানি নীতির কারণে প্রায়ই সমস্যায় পড়তে হয় আমদানিকারকদের। এর সবশেষ উদাহরণ, হুট করে পাম অয়েল রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়া। ইন্দোনেশীয় সরকারের এমন একক সিদ্ধান্তের প্রভাবে এরই মধ্যে বিশ্বব্যাপী বেড়ে গেছে ভোজ্যতেলের দাম, চাহিদা মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানের মতো দেশগুলোকে।
তবে পাম অয়েল রপ্তানি নিষিদ্ধ করে ইন্দোনেশিয়াও খুব একটা স্বস্তিতে নেই। একদিকে রপ্তানি আয়ের বিশাল একটি অংশ অচল হয়ে পড়েছে, প্রতিদিন লাখ লাখ ডলার বৈদেশিক মুদ্রা হারাতে হচ্ছে তাদের। অন্যদিকে, বন্ধুত্ব তো বটেই, ভোজ্যতেলের বাজারও হারাচ্ছে দেশটি। ইন্দোনেশিয়ার অনুপস্থিতির সুযোগে বৈশ্বিক ভোজ্যতেলের বাজারে তাদের অংশ ধীরে ধীরে দখল করে নিচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বী মালয়েশিয়া।
বিশ্বের বৃহত্তম পাম অয়েল উৎপাদক ইন্দোনেশিয়া। স্থানীয় বাজারে মূল্য নিয়ন্ত্রণের কথা বলে গত ২৮ এপ্রিল থেকে পাম অয়েল রপ্তানি নিষিদ্ধ করে দেশটি। এরপর থেকেই ভোজ্যতেল আমদানিকারক দেশগুলো মালয়েশিয়ার দিকে আরও বেশি ঝুঁকতে শুরু করে। ইন্দোনেশিয়ার উৎপাদনের অর্ধেক হলেও বিশ্বের মধ্যে পাম অয়েল উৎপাদনে মালয়েশিয়ার অবস্থান দ্বিতীয়।
শুধু ইন্দোনেশিয়ার অনুপস্থিতির সুযোগই নয়, রপ্তানি শুল্ক কমানোর মাধ্যমেও বিশ্ববাজারে নিজেদের অবস্থান আরও সুসংহত করার পরিকল্পনা করছে মালয়েশিয়া। গত মঙ্গলবার মালয়েশীয় ভোগ্যপণ্য মন্ত্রী জুরাইদা কামরুদ্দিন বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছিলেন, পাম অয়েলে রপ্তানি শুল্ক প্রায় অর্ধেক কমানোর জন্য দেশটির অর্থ মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রস্তাব করা হয়েছে। এরই মধ্যে বিষয়টি পর্যালোচনায় একটি কমিটিও করা হয়েছে।
ইন্দোনেশিয়ার নিষেধাজ্ঞা আর মালয়েশিয়ার শুল্কছাড়ের কারণে চলতি বিপণনবর্ষে ভারতে ইন্দোনেশীয় পাম অয়েল আমদানির পরিমাণ ৩৫ শতাংশে নেমে যেতে পারে। অথচ এক দশক আগেও পাম অয়েল আমদানিতে ইন্দোনেশিয়ার ওপর ভারতের নির্ভরশীলতা ছিল ৭৫ শতাংশের বেশি। ভারতের ভোজ্যতেল শিল্পের প্রধান সংগঠন সলভেন্ট এক্সট্র্যাক্টরস অ্যাসোসিয়েশন (এসইএ) বলছে এসব কথা।
মুম্বাইভিত্তিক সংগঠনটির নির্বাহী পরিচালক বি ভি মেহতার ভাষ্যমতে, ইন্দোনেশিয়ার অপ্রত্যাশিত নীতির কারণে সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে মালয়েশিয়া। ইন্দোনেশিয়া বাজারে না থাকায় মালয়েশিয়া বেশি বেশি বিক্রি করছে, তা-ও প্রায় রেকর্ড মূল্যে।
এসইএ’র তথ্যমতে, ২০২১-২২ বিপণনবর্ষের প্রথম পাঁচ মাসে মালয়েশিয়া থেকে ১৪ লাখ ৭০ হাজার টন পাম অয়েল আমদানি করেছে ভারত, বিপরীতে ইন্দোনেশিয়া থেকে করেছে ৯ লাখ ৮২ হাজার টন।
ব্যবসায়ীদের ধারণা, চলতি মাসে মালয়েশিয়া থেকে ভারতের পাম অয়েল আমদানি ৫ লাখ ৭০ হাজার টন ও ইন্দোনেশিয়া থেকে মাত্র ২ লাখ ৪০ হাজার টন দাঁড়াবে। তবে ইন্দোনেশিয়ার নিষেধাজ্ঞা যদি আরও দু’সপ্তাহ থাকে, তাহলে আগামী জুন মাসে ভারতের পাম অয়েল আমদানি দাঁড়াতে পারে সাড়ে তিন লাখ টনে, যার সিংহভাগই যাবে মালয়েশিয়া থেকে।
মুম্বাই-ভিত্তিক এক পরিশোধক বলেন, আপনি শুধু ইন্দোনেশিয়ার ওপর নির্ভর করে ব্যবসা চালাতে পারবেন না। ইন্দোনেশিয়া যদি মালয়েশিয়ার চেয়ে বেশি ছাড়ও দেয়, তবু তাদের অপ্রত্যাশিত নীতির ক্ষতি এড়াতে মালয়েশিয়া থেকে সরবরাহ নিশ্চিত রাখতে হবে।
বড় ক্ষতি ইন্দোনেশিয়ার
ইন্দোনেশিয়ার পাম অয়েল রপ্তানি নিষেধাজ্ঞায় ক্ষতি শুধু ক্রেতাদেরই হচ্ছে না, বড় মূল্য চুকাতে হচ্ছে ইন্দোনেশীয় সরকারকেও। স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোতে এ নিয়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা।
ইন্দোনেশিয়ান পাম অয়েল অ্যাসোসিয়েশনের তথ্যমতে, ২০২০ সালে দেশটি ৩ কোটি ৪০ লাখ টন পাম অয়েল রপ্তানি করে ১ হাজার ৫০০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছিল। কিন্তু এ বছর সেই আয়ে ধস নামার আশঙ্কা রয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গেলে দেশটির সার্বিক অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে সতর্ক করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
ইন্দোনেশিয়ার রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ব্যাংক মান্দিরির অর্থনীতিবিদ আন্দ্রিয়ান বাগুস সান্তোসো জাকার্তা পোস্টকে বলেন, পাম অয়েল রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা এক মাস থাকলে ১৪০ কোটি মার্কিন ডলার রাজস্ব হারাবে দেশ। এক্ষেত্রে প্রতি টন পরিশোধিত, ব্লিচড ও ডিওডোরাইজড (আরবিডি) পাম অয়েলের দাম ১ হাজার ৩০০ ডলার ও দৈনিক রপ্তানি ১০ লাখ ৬ হাজার টন ধরে এই হিসাব বের করা হয়েছে।
অনেকটা একই কথা বলেছেন ব্যাংক পারমাটার প্রধান অর্থনীতিবিদ জোসুয়া পারদেদেও। তার মতে, পাম অয়েল রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা এক মাস টিকলে তাতে ইন্দোনেশিয়ার আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৭০ কোটি থেকে ১২০ কোটি ডলার দাঁড়াতে পারে।
এর আগে গ্রিনপিস ইন্দোনেশিয়ার প্রচারক এরি রোম্পাস কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরাকে বলেছিলেন, নিষেধাজ্ঞার প্রভাব পুরোপুরি অনুমান করা কঠিন। কারণ এতে কতটা কাজ হবে এবং তা কতদিন স্থায়ী হবে তা অস্পষ্ট। এরই মধ্যে ইন্দোনেশিয়ায় অপরিশোধিত পাম অয়েল মজুতের সক্ষমতা পূর্ণ হয়ে যাওয়ার লক্ষণ দেখা দিয়েছে। তাই সম্ভবত খুব শিগগির নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হবে।
তবে নামপ্রকাশে অনিচ্ছুক ভারতীয় এক ক্রেতা রয়টার্সকে বলেছেন, ইন্দোনেশিয়া চলতি মাসের যেকোনো সময় রপ্তানি নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে পারে। কিন্তু তারা যে আবার রপ্তানি নিষিদ্ধ করবে না, এর কোনো নিশ্চয়তা নেই। ওদের চেয়ে মালয়েশিয়ার রপ্তানি নীতি অনেক বেশি স্থিতিশীল এবং আমরা সেটাই চাই।