অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও আসন্ন বাজেট

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ

বাজেট
ফাইল ছবি

কভিড-উত্তর সময়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত হচ্ছে। গতি কিছুটা মন্থর হলেও বিভিন্ন খাতে অর্থনীতির পুনর্জাগরণ আমরা প্রত্যক্ষ করছি। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটকেও বিবেচনায় নেওয়া দরকার। কারণ বিশ্ব অর্থনীতিতে কভিড সম্পর্কিত নেতিবাচক প্রভাবগুলো এখনো কাটেনি এবং দ্রুতই কাটবে না।

এর মধ্যে ইউক্রেন যুদ্ধ বিশ্ব অর্থনীতিতে বড় একটি প্রভাব ফেলেছে। এর প্রভাব পরোক্ষভাবে অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশের ওপরও পড়ছে। এই যুদ্ধ আন্তর্জাতিক রাজনীতি ও বহির্বাণিজ্যে মেরুকরণ তৈরি করেছে। ফলে বহির্বাণিজ্যে লেনদেনের বিষয়ে আমাদের লক্ষ রাখতে হচ্ছে। ঠিক এমন একটা পটভূমিতে আগামী মাসে জাতীয় বাজেট ঘোষণা করা হচ্ছে বলে সরকারকে কিছু বিষয়ে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।

universel cardiac hospital

বোঝাই যাচ্ছে যে এবারের বাজেট প্রণয়নে সরকারকে একদিকে অভ্যন্তরীণ চ্যালেঞ্জ, অন্যদিকে বৈশ্বিক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হচ্ছে। এ অবস্থায় বাজেটে প্রথমেই বহির্বিশ্বের চ্যালেঞ্জের বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে। এ জন্য আমাদের রপ্তানি বাণিজ্যের বহুমুখীকরণের প্রচেষ্টার গতি-প্রকৃতি পর্যালোচনা করা জরুরি হয়ে পড়েছে। আমরা সম্প্রতি তৈরি পোশাক রপ্তানিতে কিছুটা অগ্রগতি দেখতে পাচ্ছি। এর বিপরীতে অন্য খাতগুলো বিবেচনায় নিতে হবে। আমাদের একটা পণ্যের ওপর নির্ভরশীলতা চলতে থাকলে বিপদ আসতে পারে।

দ্বিতীয়ত, আমদানি বেড়ে যাওয়ায় চলতি হিসাবে বড় রকমের ঘাটতি দেখা দিয়েছে এবং তা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ তৈরি করেছে। রিজার্ভের সক্ষমতা ১১ মাসের আমদানি ব্যয়ের সক্ষমতা থেকে সাত মাসে নেমে এসেছে। বৈদেশিক দেনার দায়ও দিন দিন বেড়ে চলছে। এর থেকে উত্তরণের মূল উপায় হলো বৈদেশিক আয় বৃদ্ধির জন্য রপ্তানি বহুমুখীকরণ করা। বাজেটে প্রায়ই দেখা যায় ব্যবসায়ীদের যে প্রণোদনা দেওয়া হয় সেটা একপেশে এবং তা তৈরি পোশাক খাতই বেশি পেয়ে থাকে। এবার অন্যান্য রপ্তানিমুখী পণ্যেও প্রণোদনা বাড়ানো উচিত।

এর মধ্যেই সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক নগদ প্রণোদনা দেওয়ার ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ে ৩০ শতাংশ মূল্য সংযোজনের পরিবর্তে ২০ শতাংশ করেছে। তার মানে তৈরি পোশাক স্থানীয় পর্যায়ে ২০ শতাংশ মূল্য সংযোগ করলেই নগদ প্রণোদনা পাবে। অথচ এখন ২০ শতাংশ মূল্য সংযোজন খুব বেশি নয়, ফলে আমদানি করে কাপড়, সুতা, যন্ত্রপাতি, বোতাম ইত্যাদির মাধ্যমে জোড়াতালি দিয়ে আপনি ২০ শতাংশ মূল্য সংযোজন করবেন এবং বিনিময়ে প্রণোদনা আদায় করে নেবেন। অথচ এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দেশীয় শিল্পের সামর্থ্য বাড়ছে না। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে বারবার প্রণোদনা দিয়েই তৈরি পোশাক খাতকে জিইয়ে রাখা হচ্ছে এবং ধরে নিতে হচ্ছে যে এ খাত এখনো শিশুই রয়ে গেল।

এখন সময় হয়েছে অন্যান্য খাতে প্রণোদনা দেওয়া। এর মধ্য চামড়া, সিরামিক, ইলেকট্রনিক পণ্য, পাটজাতদ্রব্যসহ কুটির শিল্পে উৎপাদিত আরো অনেক পণ্য রয়েছে। সেগুলোকে প্রণোদনা দিতে হবে। বাজেটে সেটা লক্ষ রাখতে হবে।

তৃতীয়ত, দেশে আমদানি প্রবৃদ্ধি ৪০ শতাংশের বেশি হয়েছে, যা বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ খেয়ে ফেলছে। এর মধ্যে যন্ত্রপাতি ও মধ্যবর্তী পণ্য বা কাঁচামাল আমদানি বেড়েছে। এর সঙ্গে কম প্রয়োজনীয় জিনিসও আমদানি হচ্ছে। এ জন্য আমাদের আমদানির ওপর কড়া নজর দিতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি কিছু কড়াকড়ি আরোপ করেছে। এটা একটা নীতি এবং তাতে অটল থাকতে হবে। দেখা গেল বাংলাদেশ ব্যাংক আবার নীতিটি উঠিয়ে নিল, সেটা ঠিক হবে না। আমাদের এখন রপ্তানি বহুমুখীকরণের পাশাপাশি আমদানি বিকল্প প্রতিস্থাপন করাও জরুরি। আমাদের যেন আমদানি কম করতে হয় সেদিকে নজর দিতে হবে।

বাংলাদেশ দিন দিন আমদানিনির্ভর দেশ হয়ে যাচ্ছে। তাই দেখতে পাচ্ছি জিডিপিতে বড় বড় শিল্পের অবদান বাড়ছে এবং দেশীয় শিল্প ও ছোট শিল্পের অবদান কমছে। এমনকি কৃষির অবদানও কমে যাচ্ছে। এটা মোটেও স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশের পরিচায়ক নয়। দেশীয় শিল্পের প্রতি নজর, দেশীয় উদ্যোক্তাদের উৎসাহ দেওয়া এবং এর সঙ্গে কর্মসংস্থানের একটি গভীর যোগাযোগ রয়েছে। কারণ এসব শিল্প অধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে। বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এটা আমাদের করতে হবে।

চতুর্থত, অভ্যন্তরীণ বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে এবারের বাজেটে যত্নসহকারে বিশেষ কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে এবং সেগুলো শাসনকাজের সঙ্গে সম্পর্কিত। এখন আমাদের চ্যালেঞ্জ অনেক। আমরা দেখেছি সঠিক সময়ে সমস্যার সমাধান না করলে বা আমলে না নিলে বড় বিপদের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই শুধু প্রবৃদ্ধির আত্মতুষ্টিতে ভুগলে চলে না। প্রবৃদ্ধি ৭.২ শতাংশ হবে, এটা সরকারি হিসাবে বলা হচ্ছে। আমাদের প্রবৃদ্ধি এবং মাথাপিছু আয় বেড়েছে। কিন্তু এসব অর্জন কিভাবে টেকসই করতে পারব সেটা নিয়ে দুশ্চিন্তা দূর করতে হবে।

বহির্বিশ্বে যেসব দেশ সমস্যায় পড়েছে তাদের সবার অর্থনীতিই আমাদের চেয়ে উন্নত ছিল। শ্রীলঙ্কাই এর বড় উদাহরণ। তাদের মাথাপিছু আয় আমাদের চেয়ে অনেক বেশি। তাদের প্রবৃদ্ধি আমাদের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। তাদের মানবসম্পদের মানও অনেক ভালো। কিন্তু পতন ঠেকাতে এসব ভূমিকা রাখতে পারেনি। কারণ তাদের ভ্রান্ত নীতি, নীতির অপপ্রয়োগ, দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা, প্রাধিকার নির্ধারণে ব্যর্থতা, সুশাসনের ঘাটতি এবং সর্বোপরি জাতিগত অনৈক্য ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

মূলত অর্থনীতির বিষয়ের সঙ্গে রাজনৈতিক বিষয়ের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক রয়েছে। রাজনীতি, সুশাসন অর্থনীতির জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। এগুলো যখন খারাপ হয়ে পড়ে তখন অর্থনীতির জন্য বিরাট আঘাত আসে। সে আঘাত সহজে কাটিয়ে ওঠা যায় না। এ জন্য আমাদের যেসব বিষয়ে নজর দিতে হবে, তার মধ্যে আমাদের সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সুশাসন, জবাবদিহি বাড়াতে হবে।

পঞ্চমত, আমাদের কর্মসংস্থানের ওপর যথেষ্ট নজর দিতে হবে। সুষম বণ্টন নিশ্চিত করতে না পারলে প্রবৃদ্ধি নিয়ে স্বস্তি বজায় থাকে না। সাম্প্রতিক সময়ে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পাওয়ায় মানুষ কী পরিমাণে কষ্ট পাচ্ছে সেটা দেখে আমরা প্রবৃদ্ধির সুষম বণ্টনের অভাব দেখতে পাচ্ছি। দরিদ্র, নিম্নবিত্ত ও নিম্নমধ্যবিত্তের লোকজন অসম্ভব চাপে আছে। তাদের একদিকে আয় বাড়ছে না। আবার তাদের ভোগ করতে গিয়ে বাড়তি ভ্যাটের বোঝাও বাড়ছে। দুই দিকের চাপে পড়ে তারা মারাত্মক অবস্থার মধ্যে পড়ে গেছে। বাজেটে এ বিষয়টি দেখতে হবে।

ষষ্ঠত, দারিদ্র্য বিমোচনে আরো জোর দিতে হবে। বলা হচ্ছে, কভিড আসার পর দারিদ্র্য বেড়ে গেছে। দারিদ্র্য বাড়েনি বলেও অনেকে দাবি করছেন। কিন্তু মানুুষের ক্রয়ক্ষমতা ও তাদের জীবনযাত্রার মানও কমে গেছে—এটা সুস্পষ্টভাবে দেখতে পাচ্ছি।

সপ্তমত, আমাদের বাজেট প্রণয়ন, এর নীতিকৌশল ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াটাকে আরো সঠিকভাবে জনগণের কাছে তুলে ধরতে হবে এবং সঠিক কর্মপরিকল্পনা দিতে হবে। শুধু কতগুলো বরাদ্দ দেওয়া হবে এবং মন্ত্রণালয়গুলো রুটিন কাজ করবে, এভাবে গতানুগতিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনে পারফরম্যান্সভিত্তিক বাজেট বরাদ্দ দিতে। কোন কোন খাত ভালো সাফল্য অর্জন করেছে, কোন কোন খাত মানুষের জীবিকা, জীবন-মানের উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান এবং মানুষের সার্বিক উন্নতির জন্য অবদান রেখেছে, সেগুলোর ওপর নজর দিতে হবে, সেগুলোকেই প্রাধান্য দিতে হবে।

অষ্টমত, আমাদের দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পগুলো পর্যালোচনা করতে হবে। সম্প্রতি প্রায় ছয় হাজার কোটি টাকার ১১টি প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। সমস্যা হচ্ছে, প্রকল্পগুলো সময়মতো শেষ হয় না এবং পরে এগুলোর মেয়াদ ও ব্যয় বৃদ্ধি ঘটে। প্রশ্ন হচ্ছে, একটি প্রকল্পে যদি ১০ হাজার কোটি টাকা থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হয়, তাহলে এর সুবিধা কি তিন গুণ হয়? সুতরাং এ ধরনের প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন পর্যালোচনা করা দরকার। আবার ১১টা প্রকল্প মানেই ১১টি কাজ নয়। এর অধীনে আরো অনেক প্রকল্প আছে। যেমন—একটি প্রকল্পের অধীনে ৪০টি কার্যক্রম আছে। তার মানে ১১টা প্রকল্পের অধীনে হাজারখানেক সুনির্দিষ্ট কাজ সম্পন্ন করতে হবে।

এ ছাড়া যেসব অবকাঠামো উন্নয়নের কাজ চলছে, সেগুলো শেষ করা এখন সময়ের দাবি। একই সঙ্গে অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণেও মনোযোগ দিতে হবে। রাস্তাঘাট ও কালভার্ট মেরামত প্রয়োজন। ঢাকা শহরেই এর প্রয়োজনীয়তা অনুভব করা যায়। রাস্তাঘাট ঠিকঠাক রাখা অর্থনীতির গতি বাড়ানোর জন্য অপরিহার্য। বাংলাদেশে পরিবহন খরচ সবচেয়ে বেশি। এগুলো কেন হচ্ছে তার বিচার-বিশ্লেষণ দরকার।

সর্বোপরি বাজেটকে অনেক বেশি যৌক্তিক করতে হবে। ব্যয় যতটা সম্ভব কমাতে হবে। আমি আগে বাজেট ঘাটতির বিষয়ে কিছুটা নমনীয় ছিলাম। এখন বলব, ঘাটতি যতটা সম্ভব কম রাখা দরকার। আমাদের আয়ের সংস্থান দিন দিন সংকুচিত হচ্ছে। সেটা সম্প্রসারণ করতে হবে।

লেখক : সাবেক গভর্নর, বাংলাদেশ ব্যাংক ও অধ্যাপক, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়

শেয়ার করুন