‘গণমাধ্যমের হাত-পা বেঁধে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বিকাশ হবে না। গণতন্ত্র আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম একটি চেতনা, একটি স্বপ্ন, একটি দাবি। তাই গণমাধ্যমের হাত-পা বেঁধে গণতন্ত্রকে ব্যাহত করা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে। আইনি জটিলতার মাধ্যমে গণমাধ্যমকে নিষ্পেষণের মাধ্যমে, সাংবাদিকদের ভয়ের পরিস্থিতিতে রেখে দেশে কোনোভাবেই সুষ্ঠু গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে না। এই ভয় থেকে মুক্তির জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার।’
শনিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে সম্পাদক পরিষদ আয়োজিত ‘বিশ্ব মুক্ত গণমাধ্যম দিবস: ডিজিটাল নজরদারিতে সাংবাদিকতা’ শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেন।
এসময় সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, সামগ্রিকভাবে আইনি কাঠামোর যে বিধি আমাদের সাংবাদিকতাকে ব্যাহত করছে তার একটি সার্বিক মূল্যায়ন করবো। ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নারী সাংবাদিকদের যে হেনস্তা করা হয় তাদের সুরক্ষার্থে আমরা উদ্যোগ নেবো। বিশেষ করে নারী সাংবাদিকদের কাজের পরিবেশ আরও ভালো করার জন্য আমরা কাজ করবো। সাংবাদিক ইউনিয়ন ও মালিকদের সঙ্গে নিয়ে সম্পাদক পরিষদ আলোচনা করবে।
সাংবাদিকতা ও সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে এত আইন কেন প্রশ্ন তুলে মাহফুজ আনাম বলেন, ডিফরমেশন ল’, অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট, কন্টেন্ট অফ কোড ল’, কনটেন্ট অফ কোড ল’ স্বাধীন সাংবাদিকতাকে বাধাগ্রস্ত করে। ডিফরমেশন ল’এর অপপ্রয়োগের মাধ্যমে সাংবাদিকদের হেনস্তা করার বিরাট সুযোগ থাকে এবং করা হয়। নতুন করে আইসিটি অ্যাক্ট, ডিজিটাল অ্যাক্ট, গণমাধ্যমকর্মী আইন, ডাটা প্রটেকশন ল করা হয়েছে। আইনগুলোর নাম ভিন্ন কিন্তু সবগুলোই প্রয়োগ করার ক্ষেত্রে ঘুরে-ফিরে স্বাধীন মত প্রকাশের বিরুদ্ধে, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে প্রয়োগ করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। যারা সৃজনশীল কাজে নিয়োজিত সেগুলোতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির জন্য প্রয়োগ করা হয়।
তিনি বলেন, স্বাধীন মত প্রকাশের বিরুদ্ধে এত আইন কেন? যেসব আইন সরাসরি তাদের (সাংবাদিকদের) কাজে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে তাদের বিরুদ্ধে এত আইন কেন? আমরা কী করি যার জন্য এত আইন দিয়ে আমাদের হাত-পা বেঁধে দিতে হবে? একটা বিষয়ে সাধুবাদ জানাই, আমরা সবাই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলাম। প্রত্যেক সাংবাদিককে আহ্বান করবো, আপনারা এই আইনটি বিস্তৃতভাবে, খুব গভীরভাবে পর্যালোচনা করেন। এই আইনের প্রয়োগের মাধ্যমে আপনাদের পেশা বিকশিত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এখানে ২০টি জায়গায় আপনাদের আটকে দেওয়ার সুযোগ আছে। এর মধ্যে ১৪টি অজামিনযোগ্য। সাংবাদিক হিসেবে আপনি কী অপরাধে অপরাধী যে আপনাকে জামিন দেওয়া যাবে না? মামলা হলে বিচার তো পরের কথা, তার আগে আপনি জেলের মধ্যেই পড়ে রইলেন।
মাহফুজ আনাম বলেন, গত চার বছরে আমরা সুস্পষ্টভাবে দেখেছি কীভাবে এর অপপ্রয়োগ হয়েছে। কেউ করেছে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে, সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আমাদের সাংবাদিকতায়, আমাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতায়, আমাদের পেশায় বিকশিত হওয়ার সাংঘাতিক অন্তরায়ের একটি আইন।
তিনি বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের একটি ধারায় পরিবর্তন আনলেই হয় যে সংবাদপত্র ও গণমাধ্যমের ওপর প্রয়োগ হবে না, এটা ডিজিটাল ক্রাইম যারা করে তাদের ওপর প্রয়োগ করা হোক। একটি উদ্ধৃতি থাকলেই কিন্তু আমাদের এখান থেকে বেরিয়ে আসা যায়। অথচ আমাদের দাবির ফলেও এটা গ্রহণ করা হয়নি। বরং এই আইনের যে ভয়াবহতা আমরা রন্ধ্রে রন্ধ্রে তা উপলব্ধি করছি। এই আইনের সুষ্ঠু সংশোধন যদি না হয় তাহলে তা বাতিলের দাবির দিকে যেতে হবে আমাদের।
সম্পাদক পরিষদের কোষাধ্যক্ষ ও মানবজমিনের সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী বলেন, এরশাদ, খালেদা জিয়ার আমলে জেলে গিয়েছিলাম। এই সরকারের আমলেও ৮ মাস জেলে থেকেছি। মালিকদের মধ্যে সমস্যা নেই, আমাদের মধ্যেই সমস্যা। কোনো লেখা আসলে সাংবাদিকরাই বলেন, এই লেখাটা না দিলে কেমন হয়? মন্দের ভালো আজ এরকম একটা অনুষ্ঠান। আমরা দেখছি দেখছি না, বলছি বলছি না, শুনছি শুনিছি না। আমরা দেখি-শুনি কিন্ত কার্যকর করি না। প্রতিদিন আমি ভয় পাই, কিন্তু বলতেও পারি না, লিখতেও পারি না। এই যে ভয়, এটা থেকে মুক্তির জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টা দরকার।
সম্পাদক পরিষদের সহ-সভাপতি ও ভোরের কাগজের সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেন, সাংবাদিক নেতাদের দুইজনের বক্তব্য ভিন্ন। এই ভিন্ন বক্তব্যের মধ্যেই আমাদের মূল সংকট লুকিয়ে আছে। ডিজিটাল নজরদারিতে কি সাংবাদিকতা করা যায়? এটাকে কি মুক্ত সাংবাদিকতা বলা যাবে? আমরা লিখতে পারি কিন্তু যেটা লিখতে চাই সেটা পারি কি না। ডিজিটাল অবরোধের যুগে সাংবাদিকতা যদি করতে চাই তাহলে আমাকে ঐকবদ্ধ থাকতে হবে। সাংবাদিকতার সঙ্গেই নাগরিক সমাজকে সম্পৃক্ত করতে হবে। আমাদের দুটি নাগরিক সমাজ রয়েছে। সাংবাদিক নির্যাতনের ক্ষেত্রে তাদের পাই না। সাংবাদিকতা করতে চাইলে সবাইকে এক হতে হবে। সাংবাদিকদের মধ্যে বিভাজন থাকা যাবে না।
সম্পাদক পরিষদের সহ-সভাপতি ও দৈনিক নিউএজ সম্পাদক নুরুল কবীর বলেন, আমরা যেটা নিয়ে আলোচনা করছি এটি একটি রাজনৈতিক সমস্যা। যদি সমাধান করতে চাই তাহলে আমাদের ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। সরকার যখন কর্তৃত্বপরায়ণ হয়ে ওঠে, তখন তারা প্রথম আঘাত হানে সংবাদপত্রের ওপর। আমাদের অসঙ্গবদ্ধতাই ভয়ের কারণ।
নোয়াবের সভাপতি এ. কে আজাদ বলেন, সংবাদপত্র অনেকটা কঠিন হয়ে পড়েছে। সাংবাদিকদের ওপর নজরদারি করা হচ্ছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। নোয়াব এটার বিরুদ্ধে কথা বলছে প্রথম থেকেই। গণমাধ্যমের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। সংবাদপত্রের বিকাশে সাহসী নেতৃত্ব দরকার। তবে এখন সেটা কমে আসছে। পত্রিকার আয় বৃদ্ধি হওয়া প্রয়োজন। আয় না থাকলে সংবাদপত্রের বিকাশ হয় না। পাঠকের চাহিদা পূরণ হয় না। সরকারি বিজ্ঞাপনের ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা আমরা পাওনা আছি। আমরা নানাভাবে তার জন্য যাচ্ছি।
সাংবাদিক নেতা মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল বলেন, পৃথিবীর ৪৪টি দেশে ৫৭ ধরনের আইন করা হয়েছে। পুরোনো আইন সাংবাদিকদের ওপর প্রয়োগ করা হয়। নতুন আইনে ৫৭ ধারা প্রয়োগ করা হলো। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অজামিনযোগ্য ধারা রাখা হয়েছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দরকার কিন্তু সঠিকভাবে ব্যবহার করা হচ্ছে কি না সেটা দেখতে হবে। সাংবাদিকদের ওপর প্রয়োগ করা হচ্ছে। সাংবাদিকদের জন্য বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে বিপজ্জনক রাষ্ট্র। দেশে ৫০ বছরে একটি সাংবাদিক হত্যার বিচার হয়নি।
আজকের পত্রিকা সম্পাদক গোলাম রহমান বলেন, আমরা একটা বিষয় লক্ষ্য করি ডিজিটাল অবরোধে সাংবাদিক। আমরা গণতন্ত্রের কথা বলি কিন্তু সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথা বলি না, এটা পরস্পরবিরোধী হয়ে যাচ্ছে।
বিএফইউজের সভাপতি এম আব্দুল্লাহ বলেন, স্থানীয় সাংবাদিকরাও কোথায় যাচ্ছেন, কী করছেন, ইন্টারনেটের মাধ্যমে তার নজরদারি চলছে। বাংলাদেশে সেটাই এখন চলছে। অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা যারা করে তাদের ওপর নজরদারি রয়েছে। সাংবাদিকরা নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন।
বিএফইউজের সভাপতি ওমর ফারুক বলেন, সাংবাদিক সংগঠন করি, আবার দলের পদ নেই। যার ফলে আমাদের মধ্যে বিভাজন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে আমরা সরকারের সঙ্গে কথা বলেছিলাম, যেখানে সমস্যা ছিল সেগুলো সংশোধনের কথা বলেছিলাম, তা না করায় আমাদের মনে ক্ষোভ আছে।
ডিইউজের সভাপতি কাদের গণি চৌধুরী বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাকস্বাধীনতাকে রুদ্ধ করেছে। আইনটি বাতিল করার দাবি জানাচ্ছি। গণতন্ত্রের কথা বলবেন আর সমালোচনা সহ্য করবেন না তা হবে না। সাংবাদিকদের অসম্মান করে জাতি সম্মানিত হয় না। আমাদের সাংবাদিকদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। সাংবাদিকদের কোনো বন্ধু নাই।
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি নজরুল ইসলাম মিঠু বলেন, সাংবাদিকতা এখন মনিটরিংয়ের ওপরে চলছে। অনলাইনে বা অফলাইনে থাকলে মনিটরিং হয়। এটা আমাদের প্রাইভেসির জন্য ক্ষতিকর। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে সাংবাদিকদের বেশি ক্ষতি হয়েছে। এর মাধ্যমে সাংবাদিকতা অনেকটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
সম্পাদক পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও বণিক বার্তার সম্পাদক দেওয়ান হানিফ মাহমুদের সঞ্চালনায় আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য রাখেন ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আকতার হোসেনসহ বেশ কয়েকজন সাংবাদিক।