নর্থ সাউথের ৪ ট্রাস্টিকে হেফাজতে পাঠানোর আরজি রাষ্ট্রপক্ষ ও দুদকের

নিজস্ব প্রতিবেদক

হাইকোর্ট
ফাইল ছবি

অর্থ আত্মসাতের অভিযোগের মামলায় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের চার ট্রাস্টির আগাম জামিনের আবেদন সরাসরি খারিজ করে তাঁদের হেফাজতে (কাস্টডিতে) পাঠানোর আরজি জানিয়েছে রাষ্ট্রপক্ষ ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

বুধবার (১৮ মে) বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দের বেঞ্চে চার আসামির আগাম জামিনের শুনানিতে এ আরজি জানানো হয়।

universel cardiac hospital

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের জমি কেনা বাবদ অতিরিক্ত ৩০৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা ব্যয় দেখিয়ে তা আত্মসাতের অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়টির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে গত ৫ মে মামলা করেন দুদকের উপপরিচালক মো. ফরিদ আহমেদ পাটোয়ারী।

আসামিরা হলেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বোর্ড অব ট্রাস্টিজের চেয়ারম্যান আজিম উদ্দিন আহমেদ, বোর্ড অব ট্রাস্টিজের সদস্য এম এ কাশেম, বেনজীর আহমেদ, রেহানা রহমান, মোহাম্মদ শাহজাহান এবং আশালয় হাউজিং ও ডেভেলপারস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমিন মো. হিলালী। তাঁদের মধ্যে রেহানা রহমান, এম এ কাশেম, মোহাম্মদ শাহজাহান ও বেনজীর আহমেদ হাইকোর্টে আগাম জামিন চেয়ে আবেদন করেন, যা বুধবার শুনানির জন্য ওঠে।

আদালতে আসামি রেহানা রহমান ও এম এ কাশেমের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি, মোহাম্মদ শাহজাহানের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী ফিদা এম কামাল। আর বেনজীর আহমেদের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী এ এফ হাসান আরিফ। তাঁদের সহযোগিতা করেন আইনজীবী মিজান সাঈদ।

রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। সঙ্গে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ দেবনাথ ও এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক। আর দুদকের পক্ষে শুনানি করেন মো. খুরশীদ আলম খান।

জামিন শুনানিতে আসামিদের আইনজীবীদের ভাষ্য, অনুমানের ভিত্তিতে জামিন আবেদনকারীদের (আসামিদের) বিরুদ্ধে এ মামলা করেছে দুদক। তাঁদের কারো বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্টভাবে অর্থ আত্মসাতের স্পষ্ট কোনো অভিযোগ নেই। তা ছাড়া এ বিষয়টি নিয়ে উচ্চ আদালতে একটি দেওয়ানি মামলায় রায় হয়েছে। সেই রায়েই বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়েছে। সেই রায়ে উল্লেখ করা মূল্যমান ধরেই জমি কেনা হয়েছে।

তাঁরা আরও বলেন, জামিন আবেদনকারী প্রত্যেকেই সামাজিক উচ্চ মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তি। হয়রানির আশঙ্কা থেকে উচ্চ আদালতে আগাম জামিন চেয়ে আবেদন করেছেন।

আবেদনকারী পক্ষের শুনানির জবাবে প্রথমে শুনানি করেন দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান। তিনি বলেন, ‘অর্থপাচার প্রতিরোধ আইন অনুসারে অর্থপাচারের চেষ্টা করাও অপরাধ। সুতরাং অনুমানের ভিত্তিতে মামলা হওয়াটাই যৌক্তিক। দুদকের নিজস্ব অনুসন্ধানের পরেই এ মামলা হয়েছে। এখন তদন্তে আরও বেশি অর্থ আত্মসাতের প্রমাণ মিলতে পারে। তা ছাড়া জামিন আবেদনকারী আসামিরা সংঘবদ্ধভাবে অর্থনৈতিক অপরাধ করেছেন। তাঁরা একটি চক্র তৈরি করে এ অপরাধ সংঘটিত করেছেন। এ মামলায় প্রত্যেক আসামির অপরাধকে বিচ্ছিন্ন বা ব্যক্তিগতভাবে দেখার সুযোগ নেই।’

আসামিদের সামাজিক মর্যাদা বিবেচনা করে জামিন না দেওয়ার আরজি জানিয়ে এ আইনজীবী আরও বলেন, এ দেশে সাবেক প্রধানমন্ত্রী, সাবেক সেনাপ্রধান, প্রধান বিচারপতির বিচার হয়েছে। সামাজিক মর্যাদায় জামিন আবেদনকারী এই আসামিরা কি আইনের ঊর্ধ্বে?

‘হয়রানির আশঙ্কা’ নিয়ে তিনি বলেন, ‘আসামিপক্ষ এখানে পুলিশি হয়রানির কথা বলেছেন। দুদকের মামলায় তাঁরা পুলিশ পেল কোথায়? দুদকের মামলায় পুলিশ-ম্যাজিস্ট্রেট বলতে কিছু নেই। দুদকের যে কর্মকর্তা মামলা করেছেন, তিনি কি আসামিদের বাসায় অভিযান চালিয়েছেন কখনো? কখনো হুমকি দিয়েছেন? করেননি। তাহলে হয়রানির আশঙ্কা কেন করছেন?’

আগাম জামিনসংক্রান্ত আপিল বিভাগের নীতিমালা (গাইডলাইন) উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আপিল বিভাগের গাইডলাইন অনুসারে তাঁদের আগাম জামিনের আবেদনটিই গ্রহণযোগ্য (মেইনটেনেবল) না। তাই তাঁদের আবেদনগুলো সরাসরি খারিজ করে হেফাজতে (কাস্টডিতে) পাঠানো হোক।’ এর পক্ষে খুরশীদ আলম খান ১৭৬ কোটি টাকা আত্মসাতের মামলায় এরশাদ ব্রাদার্স করপোরেশনের মালিক মো. এরশাদ আলীকে হেফাজতে পাঠানোর উদাহরণ টানেন। গত মঙ্গলবার এই আদালতেই এরশাদ আলী আগাম জামিন নিতে এসেছিলেন।

এরপর অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন শুনানিতে বলেন, ‘আসামিপক্ষ একটি দেওয়ানি মামলার কথা উল্লেখ করে বলেছেন, বিষয়টি নিষ্পত্তি হয়েছে। কিন্তু ওই মামলাটি হয়েছে ২০১৮ সালে। আর এ ট্রাস্টি বোর্ড জমি কেনা সম্পন্ন করেছেন ২০১৬ সালে। তার মানে, রায় হওয়ার আগেই বিশ্ববিদ্যালয়ের জমি কেনা হয়ে গেছে। রায়ে উল্লেখ করা মূল্যমান ধরে জমি কেনা হয়েছে, এ কথা ঠিক না। সুতরাং হাইকোর্টের ওই রায় আসামিদের জামিন আবেদনের পক্ষে কোনোভাবেই সংগত হতে পারে না। তা ছাড়া অন্য এক মামলায় জামিন আবেদনকারী এক আসামির (মোহাম্মদ শাহজাহান) বিদেশ যাত্রায় আদালতের নিষেধাজ্ঞা আছে।’

আর্থিক অপরাধের আসামিদের জামিন বিবেচনায় আপিল বিভাগের সিদ্ধান্ত তুলে ধরে রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা বলেন, ‘কোনো আসামি যদি আর্থিক অপরাধে জড়িত থাকেন কিংবা জড়িত থাকতে পারেন বলে মনে হয়, সেই আসামির জামিন বিবেচনা করার আগে আসামির আর্থিক অপরাধ গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। আপিল বিভাগ আর্থিক অপরাধকে গুরুত্ব দিয়ে দেখতে বলেছেন। তাই আবেদনকারী এই চার আসামির আগাম জামিনের আবেদন সরাসরি খারিজ করে হেফাজতে (কাস্টডিতে) পাঠানো উচিত বলে আমি মনে করি। এটাই আমার আরজি।’

এরপর আদালত উভয় পক্ষকে তাদের শুনানির সারসংক্ষেপ লিখিত আকারে জমা দিতে বলে শুনানি আজ বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মুলতবি করেন।

মামলার বিবরণ

এজাহারে বলা হয়েছে, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে পাশ কাটিয়ে ট্রাস্টি বোর্ডের কয়েকজন সদস্যের অনুমোদন বা সম্মতির মাধ্যমে ক্যাম্পাস উন্নয়নের নামে ৯০৯৬.৮৮ ডেসিমেল জমির দাম ৩০৩ কোটি ৮২ লাখ ১৩ হাজার ৪৯৭ টাকা বেশি দেখিয়ে তা আত্মসাৎ করা হয়।

আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলের টাকা আত্মসাতের হীন উদ্দেশ্যে কম দামে জমি কেনার পরও বেশি দাম দেখিয়ে তাঁরা প্রথমে বিক্রেতার নামে টাকা প্রদান করেন। পরে বিক্রেতার কাছ থেকে নিজেদের লোকের নামে নগদ চেকের মাধ্যমে টাকা উত্তোলন করে আবার নিজেদের নামে এফডিআর করে রাখেন। পরে নিজেরা এফডিআরের ওই অর্থ উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেন। অবৈধ ও অপরাধলব্ধ আয়ের অবস্থান গোপনের জন্য ওই অর্থ হস্তান্তর ও স্থানান্তরের মাধ্যমে অর্থপাচারের অপরাধও করেন।

মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধির ৪০৯/১০৯/৪২০/১৬১/১৬৫ক ধারা এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২) ধারা এবং অর্থপাচার প্রতিরোধ আইন-২০১২-এর ৪(২)(৩) ধারায় অভিযোগ আনা হয়েছে।

বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০ অনুযায়ী নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ বোর্ড অব ট্রাস্টিজ। বিশ্ববিদ্যালয়ের মেমোরেন্ডাম অব অ্যাসোসিয়েশন অ্যান্ড আর্টিকলস (রুলস অ্যান্ড রেগুলেশনস) অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় একটি দাতব্য, কল্যাণমুখী, অবাণিজ্যিক ও অলাভজনক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান।

শেয়ার করুন