খাল কাটা কর্মসূচির জন্য অযথা কৃতিত্ব দেওয়া হয় জিয়াকে: বিনায়ক সেন

নিজস্ব প্রতিবেদক

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সচেতনভাবে একটি দর্শনের জন্ম দিয়েছিলেন। তাঁর বিভিন্ন ভাষণ ও গ্রন্থ প্রকাশ হওয়ার পর তা দৃষ্টিগোচর হচ্ছে। তিনি মাঠে–ঘাটে ঘুরে, মানুষের সঙ্গে মিশে তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে নিজে ছয় দফা রচনা করেছেন। স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে গ্রামীণ অবকাঠামো গড়ে তুলতে ১৯৭২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পাবনায় এক ভাষণে তিনি জনগণকে খাল কাটতে বলেছিলেন।

‘খাল কাটা’ কর্মসূচির জন্য অযথা কৃতিত্ব দেওয়া হয় সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে। বিশেষ প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু আপৎকালীন কর্মসূচি হিসেবে বাকশাল প্রতিষ্ঠা করেন।

universel cardiac hospital

‘বঙ্গবন্ধুর অর্থনৈতিক দর্শন: সাম্প্রতিক বিতর্ক’ শিরোনামে বক্তৃতা দেওয়ার সময় এসব কথা বলেন বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক বিনায়ক সেন। শনিবার বিকেলে রাজধানীর ধানমন্ডিতে উইমেন্স ভলান্টারি অ্যাসোসিয়েশন (ডব্লিউভিএ) মিলনায়তনে স্মারক বক্তৃতার আয়োজন করে ‘১৯৭১: গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর’।

গণহত্যাকে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করে এবং গণহত্যার ইতিহাস সংরক্ষণ ও গবেষণা করার লক্ষ্যে ২০১৪ সালের ১৭ মে গণহত্যা জাদুঘর যাত্রা শুরু করে। এ বছর অষ্টম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে জাদুঘর নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। এর মধ্যে একটি হচ্ছে শহিদ স্মৃতি স্মারক বক্তৃতা।

বিআইডিএসের মহাপরিচালক বিনায়ক সেন তাঁর বক্তৃতায় বলেন, বঙ্গবন্ধু কেমব্রিজ, অক্সফোর্ড, হার্ভার্ড বা ভারতের প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়েননি। প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়া যাদের নিয়ে দেশ ও পরিবার গৌরবান্বিত হয়, তিনি তেমন ছিলেন না। বুদ্ধিজীবী মহলে এমন একটি ধারণা চলে এসেছে, তিনি তত্ত্বীয় বা দর্শনগত ধারণা জন্ম দিতে পারেন না।

তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী, নয়াচীন ভ্রমণের স্মৃতিচারণা, তাঁর নেতৃত্বে প্রণীত বাহাত্তরের সংবিধানের ধারা–উপধারা, স্বাধীনতার আগে ও পরের বিভিন্ন ভাষণের সংগ্রহ প্রকাশের পর তাঁর চিন্তাশীল মনের প্রতিকৃতি ফুটে উঠল সবার সামনে। যা আগে ততটা দৃষ্টিগোচর হয়নি। বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রের জনক হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত মানুষ, চিন্তক হিসেবে দেখতে অভ্যস্ত নন।

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অতীতে ও সাম্প্রতিক সময়ের কিছু বিতর্কের বিষয়ে বিনায়ক সেন বলেন, বঙ্গবন্ধু ছয় দফা রচনা করে লাহোরে উপস্থাপন করেছেন, জেলও খেটেছেন। এই ছয় দফা কে রচনা করেছেন এই প্রশ্ন তুলে তাঁকে কৃতিত্ব দিতে চান না অনেকে। অথচ বাকশাল কী পরিস্থিতিতে হয়েছে, সেটি না খুঁজে এর দায়িত্ব এককভাবে বঙ্গবন্ধুর ওপর চাপিয়ে দিতে চান।

তিনি বলেন, ১৯৭৩ সালে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ, দুর্ভিক্ষ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও ক্রম অবনতিশীল রাজনীতির কারণে বঙ্গবন্ধু আপৎকালীন কর্মসূচি হিসেবে বাকশাল করেন। তিনি লাইনচ্যুত রেলগাড়িকে লাইনে তোলার জন্য তিন বছরের জন্য এ ব্যবস্থা নিয়েছিলেন।

বঙ্গবন্ধুর চিন্তাভাবনা ও দর্শনের কথা তুলে ধরতে গিয়ে বিনায়ক সেন বলেন, অনেক বুদ্ধিজীবী সংবিধানে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের প্রভাবের কথা বলেন। ভারতের সংবিধানে ১৯৭৬ সালে সংশোধনের মাধ্যমে সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও অখণ্ডতা শব্দ তিনটি যুক্ত হয়। এর আগে ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের সংবিধানে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার কথা এসেছে।

তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার চার মূলনীতির কথা বলেছিলেন। সেটির ওপর ভিত্তি করে ১৯৭২ সালে সংবিধান রচিত হয়েছে। তিনি সব ধর্মের সমান অধিকারের কথা বলেছিলেন। সেই ধর্মনিরপেক্ষতাকে ভুল ব্যাখ্যা করা হয়েছিল ‘ধর্মহীনতা’ নামে। তিনি সমাজতন্ত্র বলতে সোভিয়েত ইউনিয়নের সমাজতন্ত্রের কথা বলেননি। এ দেশের জন্য প্রযোজ্য মিশ্র মালিকানা বুঝিয়েছেন, যেখানে রাষ্ট্রায়ত্ত, সমবায় ও ব্যক্তি খাতের ভূমিকা থাকবে।

সভাপতির বক্তব্যে গণহত্যা জাদুঘরের সভাপতি অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, বঙ্গবন্ধু যেভাবে দেশকে নিয়ে চিন্তা করেছেন, তা ৫০ বছর পর এসে মানুষ বুঝতে পারছে। তখন বুঝতে পারলে তাঁর হত্যাকাণ্ডের পর পর সবাই রুখে দাঁড়াতেন। তিনি ছিলেন সৃজনশীল রাজনীতিক। তাঁর প্রতি অনেক বুদ্ধিজীবীর শ্রদ্ধা নেই। দেশে ৫০ বছরেও বঙ্গবন্ধুর ওপর কোনো থিসিস হয়নি।

তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের বুদ্ধিজীবী শিক্ষকদের মধ্যে অনেকে বাধ্য হয়ে বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ পড়েছেন। যদি ওই বই থেকে তাঁদের কাছে কিছু জানতে চাওয়া হয়, সেই চিন্তা থেকে। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে, বঙ্গবন্ধুর চিন্তাভাবনা সম্পর্কে তাঁদের জ্ঞানই নেই। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন গণহত্যা জাদুঘরের ট্রাস্টি সম্পাদক চৌধুরী শহীদ কাদের।

শেয়ার করুন