বিজ্ঞানীরা দীর্ঘদিন ধরে সতর্ক করে আসছেন, জলবায়ু পরিবর্তন মানুষের কার্যকলাপের ফল, যা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটাতে পারে। করোনা মহামারি ও ইউক্রেন সংকটের মধ্যে আরও একটি দুঃসংবাদ পেল বিশ্ব। জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত জাতিসংঘের আন্তঃসরকার প্যানেল (আইপিসিসি) তাদের সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলেছে, বৈশ্বিক উষ্ণায়ন এখনই কমানো না গেলে খুব শিগ্গির বিশ্ববাসীকে গুরুতর পরিণতি ভোগ করতে হবে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, অবিলম্বে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নিলে বিশ্বে খরা, বন্যা ও তাপপ্রবাহের মতো বিপর্যয় বাড়তেই থাকবে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এখন ব্যাপকভাবে অনুভূত হচ্ছে। মানুষ এবং প্রকৃতিকে ২০ বছর আগের তুলনায় আরও চরম আবহাওয়া মোকাবিলা করতে হচ্ছে। তাপমাত্রার পরিবর্তন বা ভারি বৃষ্টিপাতের মতো ঘটনাগুলো প্রায়ই ঘটছে। পশুপাখি, কৃষি ও মানুষের মধ্যে ক্রমেই প্রাণঘাতী রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। জাতিসংঘ বলছে, এ ধরনের প্রবণতা রোধ করতে একটি সুস্থ বাস্তুতন্ত্র এবং সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য নিশ্চিত করতে হবে।
এটি সম্ভব হলে জনগণের কল্যাণ ও জীবনযাত্রার পথ টেকসই হবে। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, এ বছরটিই সম্ভবত এ শতাব্দীর সবচেয়ে শীতলতম একটি বছর হবে। কারণ, আমাদের গ্রহ ক্রমাগত উত্তপ্ত হচ্ছে। আইপিসিসি বলছে, বিশ্বের সরকারগুলো জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তিতে প্রতিশ্রুত বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমাবদ্ধ করবে না। বিপরীতে বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ বাড়ছে। এমনকি কয়েক দশকের গড় নির্গমন সর্বকালের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে।
এ অবস্থায় আগামী কয়েক দশকে বিশ্বে তাপমাত্রা তিন ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বৃদ্ধির দিকে যাচ্ছে। এ হারে ক্রমবর্ধমান তাপমাত্রা বিশ্বকে এতটাই উত্তপ্ত করবে, এতে স্বাভাবিক কাজকর্ম করা যাবে না। ফসলের চাষাবাদ ও জীবনযাপন অসহনীয় হয়ে ওঠবে। বরফের পাহাড়গুলো অদৃশ্য হয়ে যাবে এবং বড় শহরগুলো ডুবে যাবে। কিন্তু সরকারগুলো এখনো তাদের স্বার্থ ত্যাগ করতে দ্বিধাগ্রস্ত; পরিবর্তে তারা জীবাশ্ম জ্বালানিতে তাদের করা বিনিয়োগ রক্ষার দিকে বেশি মনোনিবেশ করে আসছে।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস উল্লেখ করেছেন, এ ব্যবস্থা চলতে পারে না। তিনি যথার্থই বলেছেন, পৃথিবী দ্রুত জলবায়ু বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বিশ্বের দেশ এবং করপোরেশনগুলো শুধু একটি গ্রহগত বিপর্যয় দেখার ভান করছে না, আগুনের লেলিহান শিখায় ইন্ধনও দিচ্ছে। বিপরীতে প্রয়োজনীয় পরিবেশবান্ধব জীবনধারা গ্রহণ এবং সস্তা এবং পুনঃবিকরণযোগ্য বিকল্পের প্রচারের জন্য গৃহীত নীতিগুলো বাস্তবায়নের জন্য খুব কম সময় রয়েছে। ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য বিশ্বকে ২০৩০ সালের মধ্যে তার বার্ষিক কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গমন প্রায় ৫০ শতাংশ কমাতে হবে এবং ২০৫০ সালের মধ্যে নিট শূন্যে পৌঁছাতে হবে। এর জন্য জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার দ্রুত কমাতে হবে।
আন্তোনিও গুতেরেস এক টুইট বার্তায় উল্লেখ করেছেন, তিনি জলবায়ু পরিবর্তনের অনেক প্রতিবেদন দেখেছেন। কিন্তু আইপিসিসির সর্বশেষ প্রতিবেদনে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় নেতৃত্বের ব্যর্থতা তুলে ধরার মতো ভয়াবহ চিত্র তিনি আগে কখনো দেখেননি। তার মতে, সারা বিশ্বের মানুষ চিন্তিত ও ক্ষুব্ধ। তিনি জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে জনগণকে অত্যন্ত কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করার আহ্বান জানিয়েছেন। মুষ্টিমেয় কিছু দেশ এবং বড় করপোরেশন কীভাবে বাকি বিশ্বের অধিকার খর্ব করছে, সে বিষয়েও তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সরকারগুলো তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে, যাকে তিনি অপরাধ বলে মনে করেন।
বৈশ্বিক তাপমাত্রা এখন প্যারিস চুক্তিতে প্রতিশ্রুত ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এ সীমা অতিক্রম করা মানে এটি একটি মৃত প্রবাল প্রাচীরের মতো একই প্রভাব ফেলতে পারে। এ পরিস্থিতিতে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের বর্তমান মহামারি থেকে দূরে সরে যাওয়ার জন্য দ্রুত পরিবর্তনের একটি দুর্দান্ত সুযোগ ছিল। বিশ্বের বেশির ভাগ সরকার সেই সুযোগটি হারিয়েছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে হাইড্রোকার্বনের ওপর নির্ভরশীল উদ্বিগ্ন দেশগুলোর জন্য এখন আরেকটি সুযোগ এসেছে।
বাংলাদেশ ১৭ কোটি জনসংখ্যার দেশ। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব যেমন বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, খরা, জলোচ্ছ্বাস, টর্নেডো, ভূমিকম্প, নদীভাঙন এবং জলাবদ্ধতা, মাটির লবণাক্ততা প্রভৃতির কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর অন্যতম। এ জলবায়ু পরিবর্তন দেশের কৃষি, অবকাঠামো ও জীবনযাত্রার ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। ইতোমধ্যেই আমরা সিলেট ও সুনামগঞ্জ অঞ্চলে অকাল বন্যা হতে দেখেছি, যাতে হাওড়াঞ্চলের ফসল, বিশেষ করে ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। অস্বাভাবিক তাপমাত্রার কারণে এ বছর কলেরার প্রার্দুভাব দেখা দিয়েছে। ডেঙ্গিসহ বিভিন্ন সংক্রামক রোগ বেড়েছে।
ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেও বাংলাদেশ প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। বাংলাদেশ সমতল ও নিচু ভূমি এলাকা নিয়ে গঠিত। জলবায়ু পরিবর্তন বাংলাদেশের নাগরিক এবং সরকারের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠছে। দেশের ৮০ শতাংশেরও বেশি জমি বন্যাপ্রবণ। বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কৃষিকাজে নিয়োজিত; তাই জলবায়ু পরিবর্তন কৃষকদের খারাপভাবে প্রভাবিত করবে। বিশ্বব্যাংক সতর্ক করেছে, বাংলাদেশ ২১০০ সালের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার হবে। প্রতিবেদনে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা তিন ফুট বাড়বে বলে অনুমান করা হয়েছে। এতে দেশে ব্যাপক বন্যা হবে এবং ফসলহানি ঘটবে। এ কারণে দারিদ্র্য ও মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে বলেও উল্লেখ করা হয়েছে।
জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি-১৩) জলবায়ু পরিবর্তন এবং এর প্রভাব মোকাবিলায় জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলেছে। এসডিজি-১৩-এর টার্গেটগুলো ছিল-১. সব দেশে জলবায়ু সম্পর্কিত বিপদ ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের স্থিতিস্থাপকতা এবং অভিযোজন ক্ষমতা জোরদার করা, ২. জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যবস্থাগুলোকে জাতীয় নীতি, কৌশল ও পরিকল্পনায় একীভূত করা, ৩. শিক্ষার উন্নতি, সচেতনতা বৃদ্ধি, মানবিক ও জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমন, অভিযোজন, প্রভাব হ্রাস এবং প্রারম্ভিক সতর্কতা সংক্রান্ত প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, ৪. অর্থবহ প্রশমন কর্ম এবং বাস্তবায়নে স্বচ্ছতার পরিপ্রেক্ষিতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর চাহিদা মোকাবিলার জন্য ২০২০ সালের মধ্যে বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলার যৌথভাবে সংগ্রহ করার লক্ষ্যে UNFCCC-তে উন্নত দেশের পক্ষগুলোর গৃহীত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করা এবং সবুজ জলবায়ুকে যত দ্রুত সম্ভব সম্পূর্ণরূপে কার্যকর করা, ৫. স্বল্পোন্নত দেশগুলোয় কার্যকর জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনার জন্য সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য প্রক্রিয়াগুলো প্রচার করা এবং ক্ষুদ্র দ্বীপ উন্নয়নশীল রাষ্ট্র, নারী, যুবক এবং স্থানীয় ও প্রান্তিক সম্প্রদায়গুলোর ওপর ফোকাস করা এবং ৬. স্বীকার করা যে, জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনসংক্রান্ত ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন হলো জলবায়ু পরিবর্তনের বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া নিয়ে আলোচনার জন্য প্রাথমিক আন্তর্জাতিক, আন্তঃসরকারি ফোরাম। সুতরাং, সেই লক্ষ্যগুলো পূরণ করতে ব্যর্থ হলে দেশগুলোকে আরও জলবায়ু-প্ররোচিত প্রাকৃতিক দুর্যোগের দিকে নিয়ে যাবে।
২৭তম জলবায়ু সম্মেলন সামনে। পরিবেশ রক্ষায় সেখানে নতুন লক্ষ্য নির্ধারণ করা হবে। কিন্তু প্যারিস জলবায়ু বৈঠকে ১২০টি দেশ যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তা পূরণ হয়নি। জাতিসংঘের প্রতিবেদনে এটি স্পষ্ট। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চলতি শতাব্দীতে বিশ্বের তাপমাত্রায় দূষণের মাত্রা ২ দশমিক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস বাড়তে পারে। যদিও প্যারিস জলবায়ু সম্মেলনে সব পক্ষ একমত হয়েছিল, তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধির সীমার মধ্যে রাখতে হবে।
বলা হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি রোধ করতে হলে প্রতিবছর বিশ্বের কার্বন নিঃসরণ ২৬ গিগাটন কমাতে হবে; অর্থাৎ, প্রতিটি দেশকে তাদের বার্ষিক কার্বন নিঃসরণ ৩০ শতাংশ কমাতে হবে। এটি ২০২২ সাল। আর মাত্র আট বছর বাকি। সুতরাং, এখনই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন না করলে বিশ্বকে আরও ভয়াবহ অবস্থার সম্মুখীন হতে হবে।
প্যারিস জলবায়ু সম্মেলন প্রতিটি দেশকে কার্বন নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করার অনুমতি দিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু এখন এটা স্পষ্ট, কোনো উল্লেখযোগ্য লাভ হয়নি। এ কারণে তাপমাত্রা বেড়েছে ২.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সম্মেলনে কঠোর ব্যবস্থা না নিলে আগামী দিনে ভয়াবহ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ বছর বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। দাবানল, তাপপ্রবাহ ও বন্যায় প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আবহাওয়ার বিচিত্র রূপ দেখা যাচ্ছে সর্বত্র।
জলবায়ু পরিবর্তন এ মুহূর্তে মানুষ এবং অন্য সব জীবের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হলে আরও বিধ্বংসী প্রভাব পড়বে। প্রতিবছর হাজার হাজার মানুষ এবং অন্যান্য প্রাণীর মৃত্যু ইতোমধ্যে এর ভয়াবহতা প্রমাণ করেছে। সুতরাং, মানবজাতিসহ অন্যান্য প্রাণীর স্বার্থে আমাদের ভালোবাসার গ্রহকে রক্ষা করার জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে মোকাবিলা করা এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে।
লেখক : গবেষক ও উন্নয়নকর্মী