যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের ভুলে খাদ্যসংকটে বিশ্ব

আন্তর্জাতিক ডেস্ক

খাদ্যসংকট
ফাইল ছবি

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা ম্যাকসিম ওরেশকিন বলেছেন, বিশ্বব্যাপী খাদ্যের দাম আকাশচুম্বী হওয়ার ফলে যে খাদ্যসংকট তৈরি হয়েছে, সেটি যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) নীতিগত ভুলের ফল। খবর আরটি।

সংবাদমাধ্যমকে ওরেশকিন আরও বলেন, শুধু ইউক্রেনের সংঘাত এত বড় আকারে সংকট সৃষ্টি করতে পারে না। ইউক্রেন যুদ্ধের বহু আগে থেকেই বিশ্বব্যাপী খাদ্যের দাম বাড়তে শুরু করেছিল বলেও মত দেন তিনি।

universel cardiac hospital

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সবশেষ তথ্যানুযায়ী, ২০২০ সালের এপ্রিল থেকে ২০২২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী খাদ্যের দাম ৬০ শতাংশ বেড়েছে। এই মূল্যবৃদ্ধির অনেকটাই ঘটে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারির আগেই। যখন রাশিয়া ইউক্রেনে তাদের সামরিক অভিযান শুরু করে।

২০১৬ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে মূল্যবৃদ্ধির সূচকটি ছিল ৭ পয়েন্টেরও কম। ২০২০ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে মূল্যবৃদ্ধির এ সূচকটি ২৭ পয়েন্ট বৃদ্ধি পায়। ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযানের পর সূচকটি আরও ১৭ পয়েন্ট বেড়েছে। অর্থাৎ, যুদ্ধ শুরুর আগেই মূল্যবৃদ্ধির সূচক ঊর্ধ্বগতিতে ছিল।

বিশ্বব্যাপী মূল্যবৃদ্ধির জন্য শুধু একটি কারণকে দায়ী করলে চলবে না, এর সঙ্গে অনেকগুলো কারণের সংমিশ্রণ রয়েছে, বলেছেন ২০১৬ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত দায়িত্বে থাকা রাশিয়ার অর্থনৈতিক উন্নয়নমন্ত্রী ওরেশকিন। তিনি আরও বলেন, বিশ্বব্যাপী মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে কোভিড-১৯ মহামারির সময় যুক্তরাষ্ট্রের অত্যধিক প্রতিক্রিয়া একটি প্রধান কারণ।

ওরেশকিন বলেন, ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারির পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র অর্থের সরবরাহ প্রায় ৪০ শতাংশ বাড়িয়েছে। তারা প্রায় ৬ ট্রিলিয়ন বেশি মুদ্রা ছাপিয়েছে। ফলে বাজারে মুদ্রার তারল্য সৃষ্টি হয়েছে। এর ফলে বিশ্বব্যাপী খাদ্য ও নিত্যপণ্যের দাম খুব দ্রুতই বাড়তে শুরু করে।

তিনি এর সঙ্গে আরও কিছু সমস্যা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ইউরোপের দেশগুলো নবায়নযোগ্য শক্তির ওপর বেশি নির্ভরশীল, যা খাদ্য উৎপাদন থেকে তাদের দূরে সরিয়ে দেয় এবং তাদের স্বল্পমেয়াদি গ্যাস চুক্তির ফলে ২০২১ সালের শেষের দিক থেকে গ্যাসের দাম অনেকাংশে বৃদ্ধি পায়।

মে মাসের প্রথম দিকে, জার্মান অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়নমন্ত্রী সভেনজা শুলজে বলেছিলেন, সবুজ শক্তির ওপর কিছু দেশের ফোকাস খাদ্য ঘাটতিতে অবদান রেখেছে। শুলজের মতে, জার্মানিতে জৈব জ্বালানির ৪ শতাংশ পর্যন্ত খাদ্য এবং পশুর খাদ্য থেকে তৈরি হয়। এটি শূন্যে নামিয়ে আনা দরকার এবং কেবল জার্মানিতে নয় বিশ্বব্যাপী এটা করা দরকার।

ওরেশকিন বলেন, এর ফলে সার উৎপাদন কমে গিয়েছে। ফলস্বরূপ ফসলের ক্ষতি হয়েছে এবং খাদ্যের দাম বেড়ে গেছে। ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তার মিত্রদের দ্বারা মস্কোর ওপর যে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছিল, তা উল্লেখযোগ্যভাবে সংকটকে আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

রাশিয়ায় বেলারুশের বিভিন্ন সার উৎপাদকের ওপর অনেক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। এর ফলে জাহাজের ওপর নিষেধাজ্ঞাসহ অর্থ প্রদানের ওপর নিষেধাজ্ঞার কারণে বাণিজ্য বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তিনি বলেন, রাশিয়া ও বেলারুশ উভয়ই চায় আরও বেশি খাদ্য রফতনি করতে। আরও সার উৎপাদন করতে। কিন্তু নিষেধাজ্ঞাগুলো বিশ্ববাজারে তাদের পণ্য পরিবহনে বাধা দিচ্ছে এবং এর ফলে সরবরাহ কমে গিয়েছে।

ওরেশকিনের মতে, ইউক্রেনে প্রায় ২০ মিলিয়ন টন গম নিষেধাজ্ঞার কবলে রয়েছে। তারা এই গম রপ্তানি করতে পারছে না, যা ইতোমধ্যে বিশ্ব রাজনীতিবিদ এবং মিডিয়ার মধ্যে একটি আলোচিত বিষয় হয়ে উঠেছে। কেননা, যে পরিমাণ গম আটকে আছে, তা বিশ্বব্যাপী গম উৎপাদনের ২.৫ শতাংশ।

তিনি আরও বলেন, রাশিয়া ইউক্রেনীয় গমের সম্ভাব্য ক্ষতি আংশিকভাবে পূরণ করতে প্রস্তুত। এর জন্য রাশিয়া ২০২১ সালের তুলনায় ১৩ মিলিয়ন টন বেশি গম রফতানি করতে চায়।

ওরেশকিন বৈশ্বিক খাদ্যবৈষম্যকে মূল কারণ হিসেবেও উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বাস্তবে এই গ্রহে পর্যাপ্ত খাদ্য রয়েছে; কিন্তু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো উন্নত দেশগুলো কেবল অন্যদের তুলনায় অনেক বেশি খাবার গ্রহণ করছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ গড়ে প্রতিদিন ৫০ শতাংশের বেশি ক্যালরি গ্রহণ করে, যা অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেকটাই বেশি। তারা ডলার মুদ্রণ করছে, তারা সমস্ত খাবার নিচ্ছে এবং অবশ্যই তারা তাদের কাছ থেকে খাবার নিচ্ছে, যারা এটি বহন করতে পারে না।

তিনি আরও বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলো যদি কম খরচ করে, তবে সবার জন্য পর্যাপ্ত খাবার থাকবে।

১৮ মে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেন, যুদ্ধ পরিস্থিতিতে ক্রমবর্ধমান দাম বৃদ্ধির কারণে দরিদ্র দেশগুলো খাদ্যসংকটে পড়তে পারে। যুদ্ধ-পূর্ব সময়ের মতো যদি ইউক্রেন তাদের পণ্য রফতানি পুনরায় শুরু করতে না পারে, তাহলে বিশ্বজুড়ে দুর্ভিক্ষ নেমে আসতে পারে, যা বছরের পর বছর স্থায়ী হতে পারে। এই সংঘাত লাখ লাখ মানুষকে অপুষ্টি, অনাহার ও দুর্ভিক্ষের দিকে ঠেলে দিতে পারে।

মহাসচিব সতর্ক করে আরও বলেন, ইউক্রেনের খাদ্য উৎপাদনের পাশাপাশি রাশিয়া ও বেলারুশের উৎপাদিত সারকে বৈশ্বিক বাজারে প্রবেশ করাতে না পারলে এ সংকটের কোনো সমাধান নেই।

খাদ্য রফতানি স্বাভাবিক রাখতে রাশিয়া ও ইউক্রেনের পাশাপাশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইইউর সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে বলেও জানান গুতেরেস।

জাতিসংঘ বলছে, বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্য সরবরাহ কমেছে। ফলে বিকল্প জায়গা থেকে পণ্য সংগ্রহ করতে গিয়ে দাম বাড়ছে। বিশ্বব্যাপী খাদ্যের দাম গত বছরের একই সময়ের তুলনায় বর্তমানে প্রায় ৩০ শতাংশ বেশি।

শেয়ার করুন