চা রপ্তানি : শ্রীলঙ্কা-ভারতের ‘দুঃসময়ে’ সুবর্ণ সুযোগ বাংলাদেশের

মত ও পথ ডেস্ক

চা বাগান
ফাইল ছবি

স্বাধীনতা-উত্তর শ্রীলঙ্কায় চলছে ইতিহাসের ভয়াবহতম অর্থনৈতিক সংকট। বিদেশি ঋণের ভারে জর্জরিত দ্বীপরাষ্ট্রটি এরই মধ্যে নিজেকে দেউলিয়া ঘোষণা করেছে। বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে খাদ্য, ওষুধ, জ্বালানির মতো অতিজরুরি পণ্যগুলো প্রয়োজনমতো আমদানি করতে পারছে না তারা। এমন সংকটময় মুহূর্তে যে চা শিল্পে ভর করে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছিল লঙ্কানরা, তা ভেঙে দিয়ে উল্টো মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছে ক্রেতারা, তাতে কমে গেছে রপ্তানি। শ্রীলঙ্কার চা শিল্পের এমন দুরবস্থার সুযোগে বৈশ্বিক বাজারে নিজেদের অবস্থান আরও পাকাপোক্ত করার আশা করছে প্রতিবেশী ভারত। কিন্তু সম্প্রতি ভারতীয় চায়ে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক পাওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ায় রপ্তানিতে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। ফলে দক্ষিণ এশিয়ার দুই বৃহৎ চা রপ্তানিকারকের এমন নড়বড়ে অবস্থানে বৈশ্বিক বাজারে নিজেদের অংশ বাড়িয়ে নেওয়ার দারুণ সুযোগ তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের সামনে।

শ্রীলঙ্কার সংকট

universel cardiac hospital

বার্তা সংস্থা রয়টার্সের খবর অনুসারে, শ্রীলঙ্কার প্রধান রপ্তানিপণ্য চা। বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট শুরুর আগে প্রতি বছর চা রপ্তানি করে বছরে ১৩০ কোটি ডলারের বেশি আয় করতো তারা। তবে এতে বাঁধ সাধে রাসায়নিক সারের ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা। এর পেছনে শতভাগ জৈব সার ব্যবহারকারী হওয়ার উদ্দেশ্যটা ভালো থাকলেও তার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে উৎপাদনে।

পরে সমালোচনার মুখে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হলেও ততদিনে শুরু হয়ে গেছে ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতালাভের পর থেকে লঙ্কানদের সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট। বৈদেশিক মুদ্রার মারাত্মক ঘাটতির কারণে বিদেশ থেকে পর্যাপ্ত সার আমদানি করতে ব্যর্থ হয় দেশটি। যার ফলে ২০২১ সালের নভেম্বর থেকে ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি- এ চার মাসে এক বছর আগের তুলনায় চা উৎপাদন কমে যায় প্রায় ১৮ শতাংশ।

কাস্টমসের তথ্য বলছে, ২০২০ সালের প্রথম প্রান্তিকে শ্রীলঙ্কার চা রপ্তানি কমে ৬ কোটি ৩৭ লাখ কেজিতে দাঁড়িয়েছে, যেখানে এর আগের বছর জানুয়ারি থেকে মার্চে তাদের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৬ কোটি ৯৮ লাখ কেজি। ১৯৯৯ সালের পর প্রথম প্রান্তিকে এটিই শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে কম চা রপ্তানির রেকর্ড। ওই বছর দেশটি ৬ কোটি ৩ লাখ কেজি চা রপ্তানি করেছিল।

চা রপ্তানি কমার ফলে চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে এই খাত থেকে শ্রীলঙ্কার আয়ও কমেছে ব্যাপকভাবে। গত বছর এ সময়ে দেশটি চা রপ্তানি করে ৩৩ কোটি ৮০ লাখ ডলার আয় করলেও এ বছর পেয়েছে মাত্র ২৮ কোটি ৭০ লাখ ডলার।

ভারতে মান নিয়ে প্রশ্ন

শ্রীলঙ্কার চা শিল্পের দুর্দশা আশীর্বাদ হতে পারে প্রতিবেশী ভারতের জন্য। ভারতীয় চা ব্যবসায়ীরা আশা করছেন, শ্রীলঙ্কার সংকট তাদের সামনে চা রপ্তানিতে নতুন সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেবে।

সতীশ মিত্রুকা নামে শিলিগুড়ির এক চা বাগানের মালিক ও ব্যবসায়ী টাইমস অব ইন্ডিয়াকে বলেন, শ্রীলঙ্কা প্রচলিত চায়ের প্রধান উৎপাদক। দেশটি প্রতি বছর প্রায় ৩০ লাখ কেজি চা উৎপাদন করে, যার বেশিরভাগ অংশ রপ্তানি হয় ইউরোপ-আমেরিকায়। কিন্তু বর্তমান অর্থনৈতিক সংকটের কারণে ক্রেতারা শ্রীলঙ্কা থেকে চা কিনতে দ্বিধা করবে এবং তার বদলে ভারতের দিকে ঝুঁকবে। এটি ভারতের রুগ্ন চা শিল্পের জন্য আশীর্বাদ হতে পারে।

শিলিগুড়ি চা নিলাম কমিটির চেয়ারম্যান কমল কুমার তিওয়ারি বলেন, চলমান সংকটের কারণে শ্রীলঙ্কার যেসব ক্রেতা চা পাচ্ছেন না, তারা ভারতের ওপর নির্ভর করবে। আর শ্রীলঙ্কায় যদি এই অবস্থা চলতে থাকে, তাহলে ভারতীয় বাজার ফুলেফেঁপে উঠবে। ভারতে ভালো মানের চা উৎপাদন হয়। তাই যারা ভালো মানের চা খুঁজছেন, তাদের সেটি দিতে পারবে ভারত।

মিথ্যা বলেননি কমল ও সতীশ। ভালো মানের চায়ের জন্য ভারতের সুখ্যাতি রয়েছে। তবে তাদের সেই খ্যাতি হঠাৎই প্রশ্নের মুখের পড়েছে। সম্প্রতি দেশটিতে বেশ কিছু চায়ে মাত্রাতিরিক্ত রাসায়নিক পাওয়া গেছে, যার জেরে অর্ডার দেওয়ার পরেও চালান গ্রহণ করেনি বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান।

২ জুন দ্য ইকোনমিক টাইমসের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফুড সেফটি অ্যান্ড স্ট্যান্ডার্ড অথোরিটি অব ইন্ডিয়ার (এফএসএসএআই) মানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ না হওয়ায় প্যাকেটজাত চা বাজারজাতকারীরা এপ্রিল থেকে মে মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত নিলামে কেনা প্রথম দফার চায়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছে।

ভারতের শীর্ষস্থানীয় প্যাকেটজাত চা বাজারজাতকারীদের সংগঠন ফেডারেশন অব অল ইন্ডিয়া টি ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন (এফএআইটিটিএ) সম্প্রতি ইউরোফিন্স অ্যানালিটিক্যাল সার্ভিসেস ইন্ডিয়া নামে একটি স্বাধীন সংস্থার মাধ্যমে চা পরীক্ষা করায়। ফলাফল বলছে, এসব চায়ে রাসায়নিক উপাদানের মাত্রা এফএসএসএআই নির্ধারিত পরিমাণের চেয়ে বেশি।

ভারতের টাটা গ্লোবাল বেভারেজ, হিন্দুস্তান ইউনিলিভারের মতো শীর্ষস্থানীয় প্যাকেটজাত চা বাজারজাতকারী সংস্থাগুলো এফএআইটিটিএ’র সদস্য।

খবরে বলা হয়েছে, মান পরীক্ষায় ব্যর্থ এসব চা ধ্বংস করে ফেলা হবে। কিন্তু এই খবর বিশ্ববাজারে পৌঁছে গেলে তা ভারতের চা রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।

এফএআইটিটিএর চেয়ারম্যান বীরেন শাহ বলেন, বেশিরভাগ ক্রেতার অভ্যন্তরীণ টেস্ট ল্যাবরেটরি রয়েছে, তবে সেগুলো এনএবিএল (ন্যাশনাল অ্যাক্রিডেশন বোর্ড ফর টেস্টিং অ্যান্ড ক্যালিব্রেশন ল্যাবরেটরিজ) স্বীকৃত নয়। তাই আমরা একটি স্বাধীন সংস্থার মাধ্যমে চা পরীক্ষা করেছি। ফলাফলে দেখা গেছে, কিছু রাসায়নিক নির্ধারিত সীমার বাইরে চলে গেছে। বিষয়টি আমরা চা বোর্ডকেও জানিয়েছি। এফএসএসএআই মানের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এমন চা আমরা কিনবো না।

সুযোগ বাংলাদেশের

শ্রীলঙ্কার ওপর ক্রেতাদের ভরসা কমে যাওয়া এবং ভারতে মান নিয়ে প্রশ্ন ওঠায় বিশ্ববাজারে চা রপ্তানি বাড়ানোর অভাবনীয় সুযোগ তৈরি হয়েছে বাংলাদেশের সামনে।

২০২১ সালে দেশে চা উৎপাদিত হয়েছে মোট ৯৬ দশমিক ৫১ মিলিয়ন কেজি। এর মধ্যে উত্তরাঞ্চলে রেকর্ড ১ কোটি ৪৫ লাখ ৫০ হাজার কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। দেশে এখন বৃহৎ চা বাগানের সংখ্যা ১৬৭টি ও ক্ষুদ্র চা বাগানের সংখ্যা আট হাজারেরও বেশি।

বৃহস্পতিবার (২ জুন) এক সংবাদ সম্মেলনে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, দেশে চা উৎপাদনের বিপুল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। চায়ের নতুন ও উন্নত জাত উদ্ভাবনে গবেষণা বাড়ানো হয়েছে। কৃষকদের চা চাষে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে। প্রয়োজনীয় সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। এত দিন শুধু দেশের পাহাড়ি অঞ্চল অর্থাৎ চট্টগ্রাম, মৌলভীবাজার ও সিলেটে চা উৎপাদিত হতো। এখন দেশের উত্তরাঞ্চল পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও ও লালমনিহাটের সমতল ভূমিতেও চা উৎপাদিত হচ্ছে। এতে অন্য ফসল চাষে অনুপযোগী জমিগুলোতে চা উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে ও দেশে চা শিল্পের বিপুল সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এ ধারা অব্যাহত থাকলে আমরা দেশের অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে বিপুল পরিমাণ চা রপ্তানি করতে পারবো।

বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্য অনুসারে, ২০২১ সালে দেশের ১৬৭টি চা বাগানে রেকর্ড ৯ কোটি ৫ লাখ ৬ হাজার কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। এসব চায়ের বেশিরভাগই অভ্যন্তরীণ বাজারে বিক্রি হয়। ২০২১ সালে রপ্তানি হয়েছে মাত্র ৩ লাখ ১৩ হাজার কেজি চা। সবচেয়ে বেশি রপ্তানি হয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাতে, ১ লাখ ৮০ হাজার কেজি চা। এরপরে বেশি রপ্তানি হয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও পাকিস্তানে।

গত দুই দশকের মধ্যে চা রপ্তানিতে সবচেয়ে বেশি আয় হয়েছে ২০০৮ সালে। ওই বছর ৮৪ লাখ কেজি চা রপ্তানি করে ৯৭ কোটি টাকা আয় করেছিল বাংলাদেশ।

তথ্যসূত্র: রয়টার্স, এএফপি, টাইমস অব ইন্ডিয়া, দ্য ইকোনমিক টাইমস

শেয়ার করুন