‘আইডিয়াল কলেজ’র অধ্যক্ষসহ ৩ শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত

নিজস্ব প্রতিবেদক

ছবি : সংগৃহীত

নানা অনিয়মের অভিযোগে ধানমন্ডির আইডিয়াল কলেজের অধ্যক্ষ জসিম উদ্দীন আহম্মেদসহ তিন শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করেছে কলেজের পরিচালনা পর্ষদ। অপর দুই শিক্ষক হলেন পরিচালনা কমিটির সদ্য সাবেক শিক্ষক প্রতিনিধি তৌফিক আজিজ চৌধুরী ও তরুণ কুমার গাঙ্গুলি।

শনিবার (৪ জুন) সন্ধ্যায় কলেজের পরিচালনা পর্ষদের সভায় এ সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে বৈঠকে উপস্থিত একজন সদস্য জানিয়েছেন। এর আগে শিক্ষকেরা ওই তিনজনের শাস্তি দাবি করে আজ শিক্ষা কার্যক্রম বর্জন করেছিলেন।

universel cardiac hospital

অধ্যক্ষ জসিম উদ্দীন আহম্মেদসহ একাধিক শিক্ষকের পিএইচডি ডিগ্রি নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। এ ছাড়া ইউনিফর্ম দেওয়ার নামে রসিদ ছাড়াই শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেওয়া হয়েছে বাড়তি টাকা। বিধি ভেঙে বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের (এনটিআরসিএ) নিবন্ধন সনদ ছাড়াই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে ১১ শিক্ষককে।

দুই বছরে ভাঙা হয়েছে ১১ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র। এ রকম অনেক অনিয়মের অভিযোগ ওঠে আইডিয়াল কলেজ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে।

তদন্তে নেমে প্রাথমিকভাবে এসব অভিযোগের সত্যতাও পায় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি) তদন্ত কমিটি। তদন্ত কমিটির পর্যবেক্ষণ ও মতামতের বিষয়ে কলেজের পরিচালনা কমিটির সভাপতি, অধ্যক্ষসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে জবাব চাওয়ার পর কলেজের অধ্যক্ষ জসিম উদ্দীন আহম্মেদ মাউশির কাছে জবাবও দিয়েছেন।

জসিম উদ্দীন ২০১৭ সালের মার্চে অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ পান। নিয়োগপ্রক্রিয়ার প্রথম পর্যায়ে ২০১৬ সালে নিয়োগ পরীক্ষায় তিনি অকৃতকার্য হয়েছিলেন। তৎকালীন কর্তৃপক্ষ যোগ্যতাসম্পন্ন অধ্যক্ষ না পাওয়ার অজুহাতে তখন নিয়োগপ্রক্রিয়াই বাতিল করে। এরপর পুনরায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলে জসিম উদ্দীন আবেদন করে অধ্যক্ষ হন। অভিযোগ, তৎকালীন পরিচালনা কমিটির একাধিক সদস্যের সহযোগিতায় তিনি নিয়োগ পান।

অভিযোগ ওঠে, অধ্যক্ষ জসিম উদ্দীন, পরিচালনা কমিটির সদ্য সাবেক শিক্ষক প্রতিনিধি তৌফিক আজিজ চৌধুরী ও তরুণ কুমার গাঙ্গুলি একই সঙ্গে কলেজ থেকে কোনো শিক্ষাছুটি বা কোনো অনুমতি ছাড়াই ‘অনলাইন বা অন্য কোনো উপায়ে’ পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করে তা কলেজে জমা দিয়ে আর্থিক সুবিধা গ্রহণ ও উচ্চতর পদোন্নতি পান। এর মধ্যে একজনের চাকরির অভিজ্ঞতার সনদ নিয়েও অভিযোগ আছে। এ বিষয়ে মাউশির তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন সম্পর্কে অধ্যক্ষ ও অপর দুই শিক্ষক প্রশ্নের উত্তর দেননি; প্রমাণও সরবরাহ করেননি।

প্রতিবছর একাদশ শ্রেণির ছাত্রছাত্রীদের ভর্তির সময় বাধ্যতামূলকভাবে কলেজের ইউনিফর্মের কাপড় ও জুতা বাবদ প্রত্যেক ছাত্রের কাছ থেকে তিন হাজার ৮০০ টাকা ও প্রত্যেক ছাত্রীর কাছ থেকে তিন হাজার ৩০০ টাকা নেওয়া হয়। অভিযোগ আছে, নিম্নমানের কাপড় ও জুতা দেওয়া হয়। এসব নিতে শিক্ষার্থীদের বাধ্য করা হয়। এ খাতে লাভের টাকা কয়েকজনের পকেটে যায়। এ বিষয়ে প্রাথমিক সত্যতা পাওয়ার কথা জানিয়েছে মাউশির তদন্ত কমিটি।

একসময় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিচালনা কমিটি ইচ্ছেমতো শিক্ষক নিয়োগ দিতে পারত। এখন এনটিআরসিএর মাধ্যমে কেন্দ্রীয়ভাবে পরীক্ষা নিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়। বিষয়টি বাধ্যতামূলক জেনেও ‘অনার্স বিষয়ে পাঠদানের জন্য’ নিবন্ধন ছাড়াই শিক্ষক দিয়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষ। মাউশির তদন্ত প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে, অধ্যক্ষ ২০১৭ সালে যোগদানের পর ১১ জন শিক্ষককে নিবন্ধন সনদ ছাড়াই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। বিষয়টি অধ্যক্ষ ও শিক্ষকেরা মৌখিকভাবে স্বীকার করেছেন।

এ ছাড়া করোনার আগে বিশেষ কোচিং ও মডেল টেস্টের নামে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত টাকা আদায়, ছাত্রাবাসের টাকা কলেজের ব্যাংক হিসাবে না দিয়ে নগদ আদায়, এই কলেজ কেন্দ্রে এইচএসসি পরীক্ষা দিতে আসা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে অনৈতিকভাবে টাকা আদায়, করোনার সময় ব্যবহারিক পরীক্ষা না হলেও এ খাতে টাকা আদায়সহ আরও অনেক অভিযোগ ওঠে কলেজটির বর্তমান কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। এসব অভিযোগ করেছেন কলেজের শিক্ষকেরাই।

কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীরা ২০১৯ ও ২০২০ সালে কোনো বৈশাখী ভাতা ও ঈদের সময় উৎসব ভাতা কলেজ থেকে পাননি। কিন্তু কলেজের শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা ও উৎসব ভাতা দেওয়ার নামে সাত কোটি টাকা কলেজের একটি স্থায়ী আমানত ভাঙা হয়। মাউশির তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়, করোনার সময়ে দুই বছরে ১১ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র ভাঙানোর কথা অধ্যক্ষসহ সব শিক্ষক স্বীকার করেছেন।

কলেজের একাধিক শিক্ষক বলেছিলেন, গুটিকয় ব্যক্তির কারণে কলেজটি শেষ হয়ে যাচ্ছে। সরকারের পক্ষ থেকে এখনই পদক্ষেপ না নিলে কিছুদিনের মধ্যেই এই কলেজের অবস্থা হবে করুণ। এ রকম অবস্থায় অধ্যক্ষসহ তিন শিক্ষককে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে।

বর্তমানে কলেজটিতে প্রায় পাঁচ হাজার শিক্ষার্থী পড়াশোনা করে। তাদের অধিকাংশই উচ্চমাধ্যমিকের শিক্ষার্থী। আটটি বিষয়ে স্নাতক (সম্মান) পড়ানো হয়; যেখানে শিক্ষার্থী পাঁচ শতাধিক। কলেজের নানা অনিয়মের অভিযোগ সরকারের শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দপ্তরকে জানিয়েছেন কলেজের শিক্ষকেরা। তাতে বর্তমান অধ্যক্ষ জসিম উদ্দীন আহম্মেদের নিয়োগ নিয়েও অভিযোগ করা হয়।

শেয়ার করুন