একবিংশ শতাব্দীর অন্যতম আলোচিত শব্দগুচ্ছ হলো- ‘ক্লাইমেট চেঞ্জ’ বা জলবায়ু পরিবর্তন। বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের নিদারুণ বাস্তবতায় পরিবেশের আলোচনা ও পাঠে এই শব্দগুচ্ছই প্রাধান্য পাচ্ছে ইদানীং। বিশ্বজুড়ে বনভূমিসহ জীববৈচিত্র্য সংশ্লিষ্ট উপাদানগুলো প্রতিনিয়ত ধ্বংসের ফলে ত্বরান্বিত হচ্ছে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার। এমন পরিস্থিতিতে জলবায়ুতে এসেছে আমূল পরিবর্তন। ফলে ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে মানুষের জীবন ও জীবীকা। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার নিয়ন্ত্রণ করা না গেলে আমাদের সুন্দর এই ধরিত্রী নিকট ভবিষ্যতে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠবে। কারণ, ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রার বৃদ্ধি বায়ুমণ্ডলের উচ্চ ও নিম্নস্তরে পানি ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করবে। আর তাই আর্দ্র অঞ্চল আর্দ্রতর ও শুষ্ক অঞ্চল শুষ্কতর হবে। ফলে মানুষের জীবনধারণ বা টিকে থাকাই হয়ে উঠবে দুরূহ। কাজেই প্রকৃতি, পরিবেশ এবং জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের মাধ্যমে ধরিত্রীকে টিকিয়ে রাখতে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
যদিও জলবায়ুর পরিবর্তন একটা বৈশ্বিক সমস্যা, তবু বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল অর্থনীতির দেশগুলোর ওপর এর প্রভাব হবে ভয়ংকর ও অসামঞ্জস্যহীন। কারণ, এসব দেশে পরিবর্তিত পরিবেশ ও পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর উপাদান, জ্ঞানবিজ্ঞান ও কলাকৌশলের তীব্র ঘাটতি রয়েছে।
গত দুই দশকে বজ্রপাত নতুন একটা দুর্যোগ হিসেবে বাংলাদেশে আবির্ভূত হয়েছে। ফলে সরকার ২০১৬ সালে একে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে ঘোষণা করে। গবেষণায় দেখা যায়, ২০১৩-২০ সাল পর্যন্ত দেশে বজ্রপাতে মৃতের সংখ্যা ১ হাজার ৮৭৮ এবং তাঁদের বেশির ভাগই (৭২ শতাংশ) কৃষক। বৈশ্বিক উষ্ণায়নের সঙ্গে বজ্রপাত–সম্পর্কিত গবেষণা বলছে, বিশ্বের সর্বত্র বজ্রপাত সমহারে বাড়ছে না, তবে আঞ্চলিক ক্ষেত্রে বজ্রপাতের ওপর উষ্ণায়নের প্রভাব সুস্পষ্ট। অর্থাৎ, বিশ্বব্যাপী না বাড়লে ও দক্ষিণ এশিয়া বা ক্রান্তীয় অঞ্চলের অনেক দেশে বজ্রপাতের সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়ছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে মানুষের হতাহতের সংখ্যা। তাই মৃত্যু কমাতে গণসচেতনতার পাশাপাশি অতিরিক্ত বজ্রপাতপ্রবণ এলাকাগুলোর মানচিত্রায়ণ অত্যাবশ্যক।
বাংলাদেশে টেকসই উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনবদ্য ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন। ডেলটা প্ল্যান-২১০০-এর পাশাপাশি হাতে নিয়েছেন ‘মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা’সহ বিভিন্ন পরিবেশবান্ধব উন্নয়ন প্রকল্প। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলার জন্য শুধু নিজ দেশেই নয়, তিনি বিশ্বব্যাপীও জনমত গঠনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। গত নভেম্বরে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলনে ১৯৭টি দেশের নেতা ও প্রতিনিধিরা অংশগ্রহণ করেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে এ সম্মেলনের গুরুত্বপূর্ণ পাঁচ জনের একজন হিসেবে আখ্যায়িত করে ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম বিবিসি। এছাড়া ‘জাতিসংঘ পরিবেশ উন্নয়ন কর্মসূচি’ দেশে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পরিবেশ ও টেকসই উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখায় লিডারশীপ ক্যাটাগরিতে তিনি জাতিসংঘের ‘চ্যাম্পিয়ন অব দ্য আর্থ-২০১৫’ পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তাঁর এই অর্জন জাতি হিসেবে আমাদেরকে গর্বিত করেছে।
সবশেষে, গত ৫০ বছরে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব বাংলাদেশে গভীরভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। যদিও ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তি মোতাবেক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে তাপমাত্রা রাখার ব্যাপারে চুক্তি হয়েছে। তবু গবেষণা বলছে, ভূপৃষ্ঠের তাপমাত্রা আরও নিচে রাখা না গেলে আবহাওয়ার বিভিন্ন উপাদানের (যেমন তাপমাত্রা, বৃষ্টিপাত ও বাতাসের গতি) অনিয়মিতকরণ ও অস্বাভাবিকতার কারণে বাংলাদেশকে নিত্যনতুন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে। কাজেই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে নতুন চ্যালেঞ্জসমূহ মোকাবিলায় ও সক্ষমতা তৈরিতে প্রয়োজন এ বিষয়ে আরও বিস্তর গবেষণা, সময়োপযোগী পদক্ষেপ ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ক্ষতি মোকাবিলায় উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা।