অর্থনীতিবিদ ও সিপিডির সম্মানিত ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য জানিয়েছেন, রাজস্ব কার্যক্রম সম্প্রসারণ করা বাজেটের সময়োচিত সিদ্ধান্ত।
বৃহস্পতিবার (৯ জুন) ২০২২-২৩ অর্থবছরের ঘোষিত বাজেট প্রতিক্রিয়া জানাতে গিয়ে তিনি এ মন্তব্য করেন। তবে প্রবৃদ্ধি ও মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ নিয়ে সরকার যে আশাবাদ ব্যক্ত করেছে, তাতে দ্বিমত পোষণ করেন এই বিশ্লেষক।
ড. দেবপ্রিয় বলেন, প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ যে এখন রাজনৈতিক সূচকে পরিণত হয়েছে, তার প্রমাণ হচ্ছে এই বাজেট। মধ্যমেয়াদি বিভিন্ন প্রাক্কলন সংযত করে নিচের দিকে নামানো হয়েছে। এবার বিনিয়োগের হার নির্ধারণ করা হয়েছে ৩১ দশমিক ৫ শতাংশ, যা গত বছরের চেয়ে কম। এমনকি সরকারি ব্যয়েও বিনিয়োগ গত বছরের চেয়ে কম। এবার সরকারি বিনিয়োগ নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ, যা গত বছর ছিল ৭ দশমিক ৬ শতাংশ।
‘গত বছর যদি ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয় তাহলে এবার ৭ দশমিক ৫ শতাংশ হবে কীভাবে! কম প্রবৃদ্ধিতে বেশি বিনিয়োগ হতে হলে বড় ধরনের প্রযুক্তিগত রূপান্তর ও উৎপাদনশীলতা বাড়ার কথা। এক বছরের মধ্যেই এমন রূপান্তর সম্ভব!’
এ প্রসঙ্গে তিনি আরও বলেন, প্রতি একক পুঁজিতে যে পরিমাণ উৎপাদন হয়, সেখানেও তো বড় ধরনের কোনো পরিবর্তন দেখতে পাইনি। এ কারণেই প্রবৃদ্ধিকে অপরিবর্তিত ও জাতীয় অনুপ্রেরণার সূচক হিসেবে দেখা যায় বলে আমি মনে করি। এটি একটি রাজনৈতিক হাতিয়ারও বটে।
‘করোনা মহামারির মধ্যেও কিন্তু সরকারঘোষিত প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়েছে, অন্তত সরকার তাই দাবি করছে…’ এর জবাবে ড. দেবপ্রিয় বলেন, কোভিডের সময় সরকার প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রার অর্জন নিয়ে যে সূচক দেখিয়েছে, আমরা তাতে সম্পূর্ণরূপে স্বস্তিবোধ করি না। গতবারের অর্জিত মানের ওপর আরও বর্ধিত কী হলো সেটাই দেখার বিষয়। এখানে সমন্বয়ের ঘাটতি আছে। বিনিয়োগ না বাড়ালে প্রবৃদ্ধি বাড়বে না। বিনিয়োগ বাড়াতে হবে, নতুবা কর্মের উৎপাদশীলতা বাড়াতে হবে। বিনিয়োগ না বাড়লেও প্রবৃদ্ধি বাড়বে, এটি যৌক্তিক নয়।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ প্রসঙ্গে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, কিছু বিলাসদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করার কথা বলছে সরকার। এটি ভালো উদ্যোগ। কিন্তু এই উদ্যোগ কোনো অবস্থায়ই বাজারের ওপর যথেষ্ট প্রভাব ফেলবে না। বাজারে মূলত রাসায়নিক সার, জ্বালানি এবং খাদ্যশস্য মূল্যস্ফীতিকে ধাবিত করে। সরকার তো এই তিনটি পণ্য কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। সুতরাং, কিছু বিলাষীপণ্যের আমদানির ওপর করারোপ করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ খুবই সীমিত। সরকার সংযত আচরণের মাধ্যমে ব্যয় কমানোর চেষ্টা করছে। এটিও ভালো দিক। তবে সেটা বাস্তবতার তুলনায় একেবারেই অপ্রতুল।
‘আপনাকে মনে রাখতে হবে এবছর সরকারকে ভর্তুকির জন্য বড় ধরনের অর্থের জোগান আনতে হবে। ভর্তুকি তো ভালোও হয়, খারাপও হয়। যেমন- ভালো ভর্তুকি হচ্ছে একেবারেই সাধারণ মানুষের জন্য প্রত্যক্ষ খাদ্যসহায়তা বা অর্থসহায়তা। আর খারাপ ভর্তুকি হলো রেন্টাল-কুইক রেন্টালে ভর্তুকি দেওয়া।’
ঘোষিত বাজেটের ভালো দিক তুলে ধরে বলেন, বাজেটের বেশ কিছু ভালো দিক আছে। যেমন- রাজস্ব কার্যক্রম সম্প্রাসরণ করা বাজেটের সময়োচিত সিদ্ধান্ত। কর আওতার বাইরে অনেক খাত করের আওতায় আনা হচ্ছে। করের খাতগুলো ব্যাংকভিত্তিক করা হয়েছে। করের হারকে যৌক্তিকীকরণ, ব্যবসা, উৎপাদনের মধ্যে সমন্বয় করা হচ্ছে, যা খুবই ভালো দিক এবারের বাজেটে। এই সিদ্ধান্তগুলোকে আমি সমর্থন করি। প্রতিবন্ধীদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার মতো সিদ্ধান্তকে এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
বাজেটের মন্দ দিক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, রাজনৈতিকভাবে হটকারী সিদ্ধান্ত হলো, পাচার হওয়া টাকা বিনা প্রশ্নে এবং সুবিধাজনক করের হারে ফেরত আনার সুযোগ দিচ্ছে। এটি একটি অকার্যকর প্রস্তাব এবং এর মাধ্যমে লক্ষ্যমাত্রা কখনই অর্জিত হবে না। এর মাধ্যমে শাসক দল কেবল কালিমায় লিপ্ত হবে।