জাতীয় সংসদে প্রস্তাবিত ২০২২-২৩ অর্থবছরের বাজেটের আকারটি প্রত্যাশিত এবং যথাযথই হয়েছে। বাজেটে যে ঘাটতি রয়েছে, তা-ও অযৌক্তিক নয়। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, বাজেটে আয়ের সংস্থান কিভাবে হবে? বাজেটে ব্যয়ের খাত ও বরাদ্দগুলো যথেষ্ট ন্যায়সংগত হয়েছে কি না তা নিয়েও অনেক প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
মোটাদাগে আমি বাজেট বাস্তবায়নের দিকটিতেই বেশি আলোকপাত করতে চাই।
বাস্তবায়নই আমাদের বাজেটের সবচেয়ে দুর্বল দিক। প্রকল্প বাস্তবায়ন কিংবা যেকোনো প্রসারিত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের কথাই বলি না কেন, বরাবরই বাজেট বাস্তবায়ন একটি দুরূহ ব্যাপার। বাজেটে বিষয়টি বিশেষভাবে সুনির্দিষ্ট করার দরকার ছিল। বাজেট যারা বাস্তবায়ন করবে, সরকারের বিভিন্ন নিয়ন্ত্রক সংস্থা, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা, সরকারি ও আধাসরকারি কর্মচারী—যাদের ওপর বাস্তবায়নের দায়িত্ব বর্তায়, তাদের কর্মদক্ষতা, তাদের উদ্যোগ এবং তাদের জবাবদিহি নিশ্চিত করার বিষয়গুলো সুনির্দিষ্ট করা দরকার ছিল। কারণ বাজেট বাস্তবায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিদের ভূমিকা নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে। ইদানীং এই প্রশ্নগুলো আরো বেশি দেখা দিচ্ছে।
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য খাতের উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। অর্থমন্ত্রী এবার স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়িয়েছেন। কিন্তু কভিডের সময় স্বাস্থ্য খাতে যে দুর্বলতা ও দুর্নীতির ভয়াবহ চিত্র এবং জবাবদিহির অভাব দেখা গেছে, সেগুলো কিভাবে দূর করা যাবে—এই প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ। অর্থমন্ত্রী বাজেটের শিরোনামে কভিড উত্তরণের কথা বলছেন। কিন্তু কভিডের উত্তরণ কিভাবে হবে? কভিডের উত্তরণ পুরোপুরি শেষ হয়নি। আবার যদি সমস্যা শুরু হয় এবং স্বাস্থ্য খাতে যদি ভরাডুবি ঘটে, তাহলে এ রকম দিকনির্দেশনাহীন বাজেট দিয়ে কিছু করা সম্ভব হবে না।
অর্থমন্ত্রী শিক্ষা ও মানবসম্পদ উন্নয়নের কথা বলেছেন। কিন্তু মানবসম্পদ উন্নয়নে সুনির্দিষ্টভাবে কী করা হবে তা বলা নেই। আমাদের শিক্ষার মান সম্পর্কে প্রচুর কথা হচ্ছে ইদানীং। সে প্রসঙ্গে না-ই গেলাম। কিন্তু আপনি যদি মানবসম্পদ উন্নয়নে প্রশিক্ষণ ও যথাযথ সুযোগ-সুবিধা দিয়ে লোকজনকে সৃজনশীলতায় উৎসাহিত করতে চান, তাহলে সে ব্যবস্থাটা কোথায়? বিশেষ করে কর্মহীন অনেক লোক দক্ষতা না থাকার কারণে চাকরি পাচ্ছে না। তাই তাদের দক্ষতার ঘাটতিগুলো মেটানো দরকার। যারা বিদেশে কাজের জন্য যাবে, তাদের প্রায় সবাই অর্ধশিক্ষিত বা অল্প শিক্ষিত এবং তাদের বেতনও কম হয়। আরো বেশি পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের জন্য তাদের কিভাবে কর্ম ও ভাষাগত দক্ষতা বাড়িয়ে বিদেশে পাঠানো যায়, সে বিষয়ে বাজেটে নির্দেশনা থাকা উচিত। দক্ষতা বৃদ্ধির মতো বিষয়গুলো উল্লেখ না থাকলে শুধু কথার কথা হিসেবে মানবসম্পদ উন্নয়নের কথা বললে কাজ হবে না। উচিত হচ্ছে বেসরকারি খাত বা শ্রমবাজারের চাহিদা অনুযায়ী যে যে দক্ষতা প্রয়োজন হয়, মানবসম্পদ উন্নয়নে সেসব বিষয়ে জোর দেওয়া। এ ক্ষেত্রেও বাজেট বাস্তবায়ন অনেক বড় চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়বে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখাকে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে উল্লেখ করেছেন অর্থমন্ত্রী। কর্মসংস্থান বৃদ্ধিসহ আরো অনেক খাত নিয়ে কথা বলেছেন তিনি। কিন্তু সেগুলো কিভাবে অর্জিত হবে তার কোনো নির্দেশনা নেই। বাজেটে অর্থনৈতিক সাফল্যের ধারাবাহিকতার কথা বলা হয়েছে। তার মানে প্রবৃদ্ধিই বেশি গুরুত্ব পাবে, এটা স্পষ্ট। প্রবৃদ্ধি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু শুধু প্রবৃদ্ধির দিকে নজর দিয়ে, নানা রকম প্রচার প্রকাশনার মাধ্যমে ভাবমূর্তি বৃদ্ধি করাই যথেষ্ট হবে না। সমাজে বৈষম্য কমিয়ে আনার দিকেও নজর দিতে হবে।
বাজেটে শিল্পের বিকাশের বিষয়টিও আলোচনার দাবি রাখে। বাংলাদেশে শিল্প বলতে শুধু বিরাট বিরাট শিল্পকে বোঝায়। কিন্তু আমাদের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পগুলো তেমন উন্নতি লাভ করতে পারে না এবং বাজেটেও তাদের তেমন সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয় না। অথচ এর সঙ্গে কর্মসংস্থানের ব্যাপারটি ব্যাপকভাবে জড়িত। অর্থমন্ত্রী কর্মসংস্থান বাড়াতে চান। কিন্তু কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা কোথায় করবেন? কর্মসংস্থান করতে হলে যেখানে কর্মসংস্থান বেশি হবে—সিএসএমই তথা ক্ষুদ্র, কুটির ও মাঝারি এন্টারপ্রাইজ—সেখানে বিশেষ অর্থায়ন করতে হবে। কিন্তু তাদের জন্য তেমন কিছু নেই। যেখানে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে এবং প্রবৃদ্ধিতে বড় অবদান রাখবে, সেখানে বিনিয়োগ বাড়ানোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।
অনানুষ্ঠানিক খাতে অনেক মানুষের কর্মসংস্থান হয়। কিন্তু বাজেটে এ খাতে সুস্পষ্ট প্রণোদনার কোনো উল্লেখ নেই। প্রণোদনা আছে পোশাক খাতে। করপোরেট কমানো হয়েছে। এগুলো ইতিবাচক। কিন্তু সবই বড় বড় শিল্পকেন্দ্রিক হয়ে গেছে। ফলে সিএসএমই খাতের জন্য তেমন কিছু নেই। যারা অর্থায়ন থেকে বঞ্চিত, যারা কর্মসংস্থান সৃষ্টি থেকে বঞ্চিত তাদের ব্যাপারে সুস্পষ্ট কিছু উল্লেখ নেই। অতএব বাজেটটা মোটাদাগে হলো বড় ব্যবসাবান্ধব। ছোট ব্যবসা বা সাধারণ ব্যবসায়ের জন্য এই বাজেটে তেমন বিশেষ কিছু নেই। এটা এই বাজেটের একটি দুর্বল দিক।
কৃষির উন্নয়নের কথা অর্থমন্ত্রী বলেছেন। এটা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। কিন্তু কৃষিপণ্যের বাজারের ব্যবস্থাপনা, কৃষিপণ্য সরবরাহ সুনিশ্চিত করার বিষয়ে কিছু নেই। কৃষির সম্প্রসারণ এবং এ খাতে গবেষণা বাড়ানো অপরিহার্য হলেও এ বিষয়ে বাজেটে তেমন কিছু নেই। বাজেটে খাদ্য নিরাপত্তার ব্যাপারে কিছু ইতিবাচক বিষয় আছে। ৫০ লাখ লোককে ১৫ টাকা দরে ৩০ কেজি করে চাল দেওয়া হবে। এটা ভালো উদ্যোগ। কিন্তু এর চ্যালেঞ্জটাও মনে রাখতে হবে। যদি ৫০ লাখ লোককে ৩০ কেজি করে চাল দেন, তাহলে আমাদের খাদ্য মজুদ অধিকাংশে শেষ হয়ে যাবে। এ ক্ষেত্রে সরকারের বাফার স্টক যদি না থাকে, তাহলে এর সুযোগ নেবেন ব্যবসায়ীরা। সুতরাং বরাদ্দ দেওয়াটাই শেষ কথা নয়, বরং সংস্থান করার বিষয়টি ভাবাও জরুরি।
কর ব্যবস্থাপনায় আলোকপাত করা যেতে পারে। এনবিআর তিন লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করবে। এটা বিরাট একটা ব্যাপার। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, এনবিআরকে ডিজিটাইজ করা হবে, এর জন্য দ্রুত কর ও ভ্যাট আদায়ের ব্যবস্থা করা হবে। প্রতিবছরই এসব বলা হয়। কিন্তু বিশেষ কোনো নজর দেওয়া হচ্ছে না সেখানে। কর সংগ্রহের বেলায় করহার না বাড়িয়ে করজাল বিস্তৃত করা দরকার। অনেক দিন থেকেই শুনছি এ বিষয়ে জরিপ চালানো হবে। বিষয়টি বাজেটে আনা দরকার ছিল। দেশে বহু মানুষের টিন আছে। মাত্র ৩৫ লাখ লোক কর দেয়, বাকিরা কর দেয় না। তাই করজাল বিস্তৃত করা দরকার এবং এর সুযোগ আছে।
বাজেটে ঘাটতি পূরণে অর্থ সংস্থান হিসাবে সরকার ব্যাংক থেকে ঋণ নেবে এক লাখ ছয় হাজার কোটি টাকা। কিন্তু ব্যাংক থেকে ঋণ নেওয়ার নেতিবাচক দিকও আছে। সরকার যদি ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়, তাহলে বেসরকারি খাত ব্যাংকঋণ নিতে গিয়ে অসুবিধায় পড়বে। আর ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তারা তো ঋণই পাবে না। এর চেয়ে বরং ঘাটতি মোকাবেলায় সম্পদের অপচয় বন্ধ করা ভালো কাজ হবে। সম্পদের ব্যবহার সুনিশ্চিত করতে পারলে দেখা যাবে ঘাটতি অনেকটা কমে আসবে। ব্যয় কমে আসবে। এ ছাড়া প্রয়োজন হলে ন্যাশনাল সেভিংসে সার্টিফিকেট বা সঞ্চয়পত্র নেওয়া ঋণের লক্ষ্যমাত্রা বাড়ানো যেতে পারে। আমি মনে করি, সঞ্চয়পত্রে সুদের হার বাড়িয়ে নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য বিশেষ সুবিধা দেওয়া যেতে পারে। এ ছাড়া বৈদেশিক উৎস থেকে ঋণ আনার ক্ষেত্রে বহুপক্ষীয় সংস্থা থেকে সহজ শর্তে ঋণ আনা হবে মঙ্গলজনক। দ্বিপক্ষীয় সংস্থা থেকে ঋণ গ্রহণের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। এবার বিনিয়োগ-জিডিপি অনুপাতের লক্ষ্যমাত্রা কমিয়ে ৩০ থেকে ৩১ শতাংশ ধরা হয়েছে। এটা যদি কমানো হয়, তাহলে ৭.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন কিভাবে সম্ভব তা স্পষ্ট নয়। বিনিয়োগ-জিডিপি অনুপাত কমপক্ষে ৩৪ শতাংশ করা উচিত ছিল।
ব্যয়ের দিকটায় নজর দিই। বাজেটে পরিচালন খাতে ব্যয় চলে যাচ্ছে চার লাখ কোটি টাকার বেশি। দেখা যাচ্ছে, দক্ষতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত না করে শুধু পরিচালন ব্যয় বাড়িয়ে যাচ্ছে সরকার। এ ক্ষেত্রে আমার মনে হয় কিছুটা কৃচ্ছ্রসাধন করা দরকার। দ্বিতীয়ত, সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বিরাট ব্যয় ধরা হয়েছে। কিন্তু এর বেশির ভাগই পেনশন, ঋণের সুদ ও সঞ্চয়ের সুদের জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। তাহলে সাধারণ মানুষ কী পাবে? ৫০ লাখ লোককে সামাজিক নিরাপত্তা খাতের আওতায় আনা হবে। তার মানে বৃদ্ধ ও প্রতিবন্ধীদের আরো বেশি পরিমাণে এ সুবিধার আওতায় আনা হবে। কিন্তু টাকার অঙ্কের ব্যাপারে কিছু বলা হয়নি। এখন ৫০০ টাকা দেওয়া হয় বয়স্ক ভাতা, প্রতিবন্ধী পায় ৭৫০ টাকা। এই অর্থ খুবই সামান্য। এটা বাড়ানো উচিত। সামাজিক নিরাপত্তা খাতে আরেকটি ইতিবাচক দিক হচ্ছে সর্বজনীন বীমা। এটা ভালো উদ্যোগ। কিন্তু এ ক্ষেত্রে সরকারি বীমার সঙ্গে বেসরকারি বীমার সমন্বয় কিভাবে হবে এবং এর অগ্রগতি কতটুকু তা বাজেটে স্পষ্ট নয়।
বাজেটে কিছু সাংঘর্ষিক ব্যাপার আছে। অর্থমন্ত্রী মূল্যস্ফীতি কমিয়ে ৫.৫ শতাংশে আনতে চান। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়ছে বলে এখানে মূল্যস্ফীতি হচ্ছে, এটা কিছুটা সত্য। কিন্তু আমাদের দেশে প্রকৃতপক্ষে মূল্যস্ফীতির সমস্যাটি সরবরাহজনিত। পাইকারি বিক্রেতা, মধ্যস্বত্বভোগী, খুচরা বিক্রেতারা নানা রকম কারসাজি করে দাম বাড়িয়ে নেয়। এ বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ না নিয়ে অর্থমন্ত্রী কিভাবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখবেন—সেটি একটি প্রশ্ন। আমাদের এখানে পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধিকে মূল্যস্ফীতির জন্য দায়ী করা হয়। কিন্তু পরিবহন খাতে চাঁদাবাজ এবং নানা রকম মধ্যস্বত্বভোগী সদর্পে তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং বাজার ব্যবস্থাপনা ঠিক না করে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে রাখা সম্ভব নয়।
মূল্যস্ফীতি ৫.৬ শতাংশে নামিয়ে আনা খুবই কঠিন হবে। এর সঙ্গে একটি সাংঘর্ষিক বিষয় হলো মূল্যস্ফীতি ৫.৬ শতাংশ নামিয়ে আনলে প্রবৃদ্ধি ৭.৬ শতাংশ অর্জন করা কঠিন কাজ। মূল্যস্ফীতি কমিয়ে আনতে হলে সরকারকে খরচ কমাতে হবে, অর্থ সরবরাহ কমাতে হবে। সে ক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি বাড়ানো চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে। এ ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষার ব্যাপার আছে।
বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা তিন লাখ টাকার বেশি বাড়ানো হয়নি। মূল্যস্ফীতির সময়ে লোকজনের আয় বেড়েছে বলেছেন অর্থমন্ত্রী, তাহলে করজাল না বাড়িয়ে করসীমা তিন লাখ টাকা কিভাবে ধার্য করা হয়? এনবিআরের যুক্তি হচ্ছে, তিন লাখ টাকার বেশি হলে অনেক লোক করের আওতার বাইরে চলে যাবে। কিন্তু আমার কথা হলো, যারা করের বাইরে আছে তাদের করের ভেতরে আনার ব্যবস্থা করুন। তারপর দেখুন, কী পরিমাণ লোক করের আওতার বাইরে যায়। এ ক্ষেত্রে করমুক্ত আয়সীমা আরো ৫০ হাজার টাকা বাড়ানো হলে সমস্যা হতো না।
লেখক : বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক