দেশের সিভিল সার্ভিসের লোকজন পক্ষপাতের বদনাম কিনে নিয়েছেন বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আকবর আলি খান। তিনি বলেছেন, দেশে নির্বাচন নিয়ে অনেক কথা আছে। বাংলাদেশে সিভিল সার্ভিসকে দুর্বল বানানো হয়েছে। কোনো রাজনৈতিক দল একজন ডিসিকেও বিশ্বাস করে না।
নাগরিক সংগঠন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) অষ্টম জাতীয় সম্মেলনের অতিথির বক্তব্যে আকবর আলি খান এসব কথা বলেন। রাজধানীর কাকরাইলে অবস্থিত ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্সে আজ শনিবার এ সম্মেলন হয়।
আকবর আলি খান বলেন, নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন করতে পারছে কি না, তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। পাশের দেশ ভারতে নির্বাচন নিয়ে এমন প্রশ্ন নেই। ভারতে যারা নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা হন, তারা প্রশাসনের কর্মকর্তা। বাংলাদেশে সিভিল সার্ভিস এখন এত দুর্বল করা হয়েছে, কোনো রাজনৈতিক দল ডিসিকে বিশ্বাস করে না।
আকবর আলি খান বলেন, ভারতে দুই-তিন মাস ধরে নির্বাচন চলে। ব্যালট বাক্স থাকে ডিসির কাছে। বাংলাদেশে কি এমন একজন ডিসি পাওয়া যাবে, যার কাছে এক রাতের জন্য ব্যালট বাক্স রাখতে রাজি হবে? তারা পক্ষপাতের বদনাম কিনে নিয়েছেন। তাদের সে সাহসও নেই।
আকবর আলি খান বলেন, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সুশীল সমাজের কাজ জনগণের দৃষ্টিকোণ থেকে বিশ্লেষণ তুলে ধরা। গণতন্ত্রের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত সুশীল সমাজ। সুশীল সমাজ গড়ে না উঠলে গণতন্ত্রের ভিত দুর্বল হয়। সরকার বলছে, সুজন শুধু সরকারের সমালোচনা করে; সুজন যদি সরকারের প্রশংসা করে, তাহলে সমালোচনা করবে কে? সমালোচনা যারা করে, তারা বন্ধু, শত্রু নয়।
দেশের বিভিন্ন খাতে সংস্কারে ১০ থেকে ১৫ বছর মেয়াদি উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মনে করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের এই উপদেষ্টা। তিনি বলেন, আইনের শাসন, সুশাসন ও মেধার মূল্যায়ন করতে হবে। আগামী ৫০ বছরেও এসব সংস্কার হবে না, যদি দাবিগুলো জনগণের পক্ষ থেকে না করা হয়। জনগণই পারে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে।
সুজনের জাতীয় সম্মেলনের উদ্বোধন করেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আরেক উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তিনি বলেন, যে কোনো শাসনব্যবস্থায় টেকসই দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রধান শর্ত শাসনকাঠামোর সর্বস্তরে কার্যকর জবাবদিহি নিশ্চিত করা। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে। ইদানীং কেউ বলেন, আগে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, পরে গণতন্ত্র, এটা কোনো কাজের কথা নয়।
দেশ শিক্ষার মানোন্নয়নের বদলে পিছিয়ে যাচ্ছে বলে মন্তব্য করেন ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ। তিনি বলেন, নৈতিক মূল্যবোধ, পারস্পরিক সহযোগিতার মতো সামাজিক পুঁজির ক্ষেত্রে উন্নতির বদলে পিছিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সমাজে স্থানীয় রাজনৈতিক ও ধনাঢ্য শ্রেণির উত্থান হয়েছে, কিন্তু তাদের মধ্যে অনুসরণীয় বৈশিষ্ট্য দেখা যায় না। যুবসমাজের সামনে কোনো আদর্শ ব্যক্তিত্ব নেই। অনিয়ম, দুর্নীতি, পেশিশক্তির উত্থানে সামাজিক পুঁজির অবক্ষয় ঘটেছে।
ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের পেছনে মূলত কাজ করেছে ব্যক্তি উদ্যোগ, সামাজিক উদ্যোগের ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। মানবাধিকার রক্ষা, বাল্যবিবাহ রোধ, পরিবেশ রক্ষা, নারী নির্যাতন রোধের ক্ষেত্রে সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা দরকার। শাসনব্যবস্থার জবাবদিহি নিশ্চিতে সুজনের মতো সংগঠন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার এ টি এম শামসুল হুদা বলেন, দেশে সুশীল সমাজ স্তিমিত হয়ে গেছে। সুশাসনের মতো গণতন্ত্রের বিভিন্ন মাপকাঠিতে দেশ দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে। ডিজিটালাইজেশনের কারণে ছোট ছোট দুর্নীতি কমেছে, কিন্তু বড় বড় দুর্নীতি বন্ধ হয়নি, বরং বড় দুর্নীতি আঁকড়ে ধরেছে। প্রতিবাদের প্রক্রিয়া শুধু রাজনৈতিক দলের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে এমন নয়, সাধারণ জনগণের অংশগ্রহণের প্রতিবাদ বেশি ফলপ্রসূ হয়।
জাতীয় সম্মেলনে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংস্কারে ২১ দফা জাতীয় সনদ তুলে ধরেন সুজন সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তাতে বলা হয়, অপরাজনীতি, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বিচারহীনতা এখন সর্বত্র। সীমাহীন দুর্নীতি বৈষম্যমূলক সমাজ সৃষ্টি করেছে। ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত, রাজনৈতিক ও নাগরিক অধিকার চরমভাবে সংকুচিত। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটাতে না পারলে সংকটময় ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে।
বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বর্তমান সংকট থেকে উত্তরণে স্বার্থসংশ্লিষ্টদের মধ্যে একটি সংলাপ আয়োজন এবং তা থেকে জাতীয় স্বার্থে ঐকমত্য সৃষ্টি সময়ের দাবি। ঐকমত্যের ভিত্তিতে জাতীয় সনদে স্বাক্ষর এবং বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিতে হবে। সনদ বাস্তবায়নের প্রথম পদক্ষেপ হবে স্বল্প মেয়াদের একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন, যাদের দায়িত্ব হবে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আয়োজন।
সুজনের সহসভাপতি হামিদা হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে সুজনের সহসম্পাদক জাকির হোসেন, কোষাধ্যক্ষ সৈয়দ আবু নাসের বখতিয়ার আহমেদ, নির্বাহী সদস্য বিচারপতি আবদুল মতিন, আলী ইমাম মজুমদার, অধ্যাপক তোফায়েল আহমেদ, অধ্যাপক রোবায়েত ফেরদৌস, অধ্যাপক মুহাম্মদ সিকান্দার খান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সুজনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়কারী দিলীপ কুমার সরকার।