২০২১ সালে সারা বিশ্বে শরণার্থীর সংখ্যা ছিল ৮ কোটির কিছু বেশি। ২০২২ সালে সারা বিশ্বে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন সংঘাত, বিশেষত ২৪ ফেব্রুয়ারি ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে শরণার্থীর সংখ্যা বাড়তে থাকে উদ্বেগজনকভাবে। সম্প্রতি জাতিসংঘ জানিয়েছে, সারা বিশ্বে বর্তমানে শরণার্থীর সংখ্যা ১০ কোটি ছাড়িয়েছে। আর এর সঙ্গে একই কারণে অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু (আইডিপি) যোগ করলে এ সংখ্যা বহুগুণ বাড়বে নিঃসন্দেহে। একমাত্র ইউক্রেন যুদ্ধের ফলেই প্রায় ৮০ লাখ মানুষ আইডিপি হয়েছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতেই আজ পালিত হচ্ছে বিশ্ব শরণার্থী দিবস। মূলত দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী ইউরোপের দেশে দেশে উদ্বাস্তুদের সুরক্ষার জন্য ১৯৫০ সালে জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর) প্রতিষ্ঠা হয়। প্রতিষ্ঠার ৫১ বছরে অর্থাৎ ২০০১ সাল থেকে জাতিসংঘের উদ্যোগে প্রতিবছর ২০ জুন বিশ্ব শরণার্থী দিবস হিসাবে উদযাপিত হচ্ছে। এ বছর দিনটির প্রতিপাদ্য হচ্ছে-‘It is non-negotiable: seeking safety is a human right. Wherever they come from’-‘শরণার্থী যারা ও যেখান থেকেই আসুক না কেন, সুরক্ষা পাওয়া তাদের অধিকার, এ বিষয়ে আলোচনার কোনো অবকাশ নেই’। যুদ্ধ, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ইত্যাকার অবস্থার শিকার এ ধরনের শরণার্থীদের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ ও সম্মান জানাতেই প্রতি বছর এ দিনটিকে উদযাপন করা হয়। ইউএনএইচসিআর শরণার্থীদের দেখভাল করা ও তাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া তদারক করে থাকে। এ দায়িত্ব পালনে নিরলস প্রচেষ্টার স্বীকৃতি হিসাবে ইউএনএইচসিআর দুবার (১৯৫৪, ১৯৮১) নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছে। ইউএনএইচসিআর ছাড়াও ইন্টার গভর্মেন্টাল সংস্থা আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) এক দেশ থেকে অন্য দেশে অভিবাসীদের স্বার্থ রক্ষায় নিয়োজিত।
সারা বিশ্বে ছড়িয়ে থাকা ১০ কোটি বা ততোধিক শরণার্থী নিজ দেশ থেকে ভিনদেশে ও ভিন্ন আর্থ-সামাজিক পরিবেশে বসবাস করছে। বিশ্বে বর্তমানে উল্লেখযোগ্য শরণার্থী সংকটের মধ্যে রয়েছে সিরিয়ান ৬৬ লাখ, আফগান ২৭ লাখ, দক্ষিণ সুদান ২২ লাখ, মিয়ানমার রোহিঙ্গা ১০ লাখ ও সোমালিয়া ৯ লাখ। এর মধ্যে অনেক শরণার্থী শিবিরই দীর্ঘদিন ধরে অনিশ্চয়তার পথে। বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকট ২০১৭ সালে ভয়াবহ রূপ নিলেও এ সংকট শুরু হয় ১৯৯১ সালের শেষ থেকে। তেমনিভাবে পাকিস্তান ও ইরানে অবস্থানকারী আফগান শরণার্থী সংকট নব্বই দশক থেকে। নয়-এগারো (২০০১)-এর যুক্তরাষ্ট্রের টুইন টাওয়ার হামলার পর তথাকথিত সন্ত্রাস দমনের জন্য শুরু হওয়া আফগান যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে (২০০১-২০০২) পাকিস্তানে আফগান শরণার্থীদের জন্য রেড ক্রসের হয়ে কাজ করার সময় জানতে পারি, এসব শরণার্থী ছাড়াও নব্বই দশকে আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের সময় সূচনা হওয়া অসংখ্য শরণার্থী প্রতিবেশী পাকিস্তান, ইরান ও অন্যান্য দেশে অবস্থান করছে। আজ এত বছর পরও সে সংকট শেষ হয়নি, বরং শরণার্থীর সংখ্যা বেড়েছে। তেমনিভাবে বর্তমান শতকের সিরিয়া সংকট, আফ্রিকার দীর্ঘদিনের গৃহযুদ্ধ এবং সবশেষ ইউক্রেন যুদ্ধ সারা বিশ্বে শরণার্থী সংকটকে আর এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে। ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে প্রায় ৭০ লাখ মানুষ পার্শ্ববর্তী দেশে শরণার্থী হলেও তাদের অবস্থান একটু ভিন্ন, কারণ এসব শরণার্থী প্রচলিত অর্থে কোনো শরণার্থী শিবিরে অবস্থান করছে না, বরং তারা প্রতিবেশী বিভিন্ন ইউরোপীয় দেশে অনেকটা আয়েশেই দিনাতিপাত করছে। এমনকি তাদের চাকরি বা কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা করছে সেসব দেশ। তাদের জন্য যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ) এবং আরও অনেক দেশ ও সংস্থা সহায়তার হাত বাড়াচ্ছে। অনুরূপভাবে সিরিয়ান শরণার্থীদের একটা বড় অংশ (৩ লক্ষাধিক) তুর্কিয়ে (তুরস্ক) অবস্থান করছে এবং তাদের জন্যও সাহায্য-সহযোগিতার অন্ত নেই। নেই তাদের দেখভাল করার জন্য প্রয়োজনীয় তহবিল সংকট। যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশ রাষ্ট্রীয় পর্যায় ছাড়াও বিভিন্ন রেড ক্রস ও অন্যান্য সংস্থার প্রতিনিধির সঙ্গে মত বিনিময়কালে জেনেছি ইউক্রেন সংকটের জন্য যে তহবিল বরাদ্দ বা সংগ্রহ হয়েছে তা খরচ করাই এখন কঠিন কাজ! যুক্তরাজ্য আর যুক্তরাষ্ট্র তো এদের জন্য প্রায়ই বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার সাহায্য ঘোষণা করছে।
তবে যত অবহেলা বাংলাদেশে অবস্থানকারী ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গাকে কেন্দ্র করে। বাংলাদেশ সরকার যদিও এদেরকে শরণার্থী হিসাবে স্বীকৃতি না দিয়ে ‘বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমার নাগরিক’ বা এফডিএমএন হিসাবে অভিহিত করছে। যদিও ১৯৯১-৯২ সালে আসা রোহিঙ্গার অবশিষ্টরা, যারা বিভিন্ন কারণে প্রত্যাবাসিত হয়নি তারা দুটি রেজিস্টার্ড ক্যাম্পে শরণার্থী হিসাবেই রয়ে গেছে। ইউরোপীয় (ইউক্রেন) ও সিরিয়ান শরণার্থীদের জন্য তহবিলের সংকট না থাকলেও রোহিঙ্গাদের জন্য তহবিলের জোগান প্রতি বছরই সীমিত হচ্ছে। সম্প্রতি আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এমনটাই জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গার জন্য ২০২১ সালে ৯৪ কোটি ডলার লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে মাত্র ৬০ শতাংশ অর্জিত হয়েছে, যেখানে এই সংকটের প্রথম বছর ২০১৭-এ অর্জিত হয়েছিল ৭৩ শতাংশ। অনুমান করা যায় আফগান ও ইউক্রেন সংকট এই তহবিল ঘাটতির অন্যতম কারণ। গত ২১-২৬ মে ইউএনএইচসিআর প্রধান ফিলিপ্পো গ্রান্ডি তাই দাতা সংস্থার প্রতি ইউক্রেন পরিস্থিতির কারণে রোহিঙ্গাদের সহায়তা না কমানোর আহ্বান জানিয়েছেন। তবে তিনি এসব রোহিঙ্গার প্রত্যাবাসনের বিষয়ে তেমন কোনো আশার বাণী শোনাতে পারেননি, কেবল গতানুগতিক আশ্বাসই দিয়ে গেলেন এই বলে যে, ‘প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় তারা বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের সঙ্গে কাজ করবে’। তিনি ভাসানচর সম্পর্কে বলেছেন-কক্সবাজার থেকে রোহিঙ্গাদের স্থানান্তর সাময়িক উদ্যোগ এবং একমাত্র প্রত্যাবাসনের মধ্যেই রয়েছে এ সংকটের স্থায়ী সমাধান, কারণ বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হওয়ায় বাস্তব কারণেই সেখানে সব সেবা পরিচালনা ও তদারকি কঠিন। তিনি কফি আনান কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের কথাও বলেছেন। উল্লেখ্য, আগস্ট ২০১৭ সালে রোহিঙ্গা সংকট চূড়ান্ত আকার ধারণ করারও এক বছর আগে সেপ্টেম্বর ২০১৬ মিয়ানমার সরকারের আহ্বানে জাতিসংঘের সাবেক (১৯৯৭-২০০৬) মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে নয় সদস্যবিশিষ্ট কমিশন (Advisory Commission on Rakhine State) গঠন করা হয়, যে কমিশনে ৬ জন মিয়ানমার ও ৩ জন আন্তর্জাতিক ব্যক্তিত্ব অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। আশ্চর্যের বিষয় হলো, কমিশনের কার্যক্রম চলাকালীনই মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গাদের উপর অত্যাচর-নিপীড়ন জোরদার করে যা ২৫ আগস্ট ২০১৭ আরও ভয়াবহ রূপ নেয়। কমিশন ২৩ আগস্ট ২০১৭ রিপোর্ট দাখিল করে যাতে রোহিঙ্গারা বিভিন্ন নাগরিক সেবার অধিকার থেকে বঞ্চিত, তাদের মুক্ত ও স্বাধীনভাবে চলাচল প্রতিবন্ধকতা, ১৯৮২ সালের জটিল নাগরিকত্ব আইন ইত্যাদি উল্লেখ করে আন্তঃগোষ্ঠী যোগাযোগ বৃদ্ধির মাধ্যমে তাদের শঙ্কাকে কমিয়ে আনা ও নাগরিকত্ব আইনের সংশোধনসহ অনেক সুপারিশ করা হয়। কিন্তু সেসব সুপারিশ বাস্তবায়ন তো দূরের কথা, রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার-নিপীড়ন আরও বাড়িয়ে দেয় যার ফলে ১০ লক্ষাধিক রোহিঙ্গা এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে কক্সবাজারে অবস্থিত ৩৩টি ক্যাম্পে অবস্থান করছে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ২০১৭ ও ২০১৯ সালে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের ৭২ ও ৭৪তম সাধারণ সভায় রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন বিষয়ে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে কিছু সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব উত্থাপন ছাড়াও বিভিন্ন সময়ে এ সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক মহলের সহযোগিতা চেয়েছেন। পরিতাপের বিষয় রোহিঙ্গা, সে যে নামেই স্বীকৃতি পাক না কেন অর্থাৎ শরণার্থী অথবা বাস্তুচ্যুত, সংকট এক অনিশ্চয়তার পথে। ভাবখানা এমন যে, এদের আশ্রয় দেওয়া ও তাদের সুরক্ষার দায় একমাত্র বাংলাদেশেরই। বাংলাদেশের জন্য রোহিঙ্গারা শুধুই বোঝা নয়, বরং নানা আর্থ-সামাজিক সমস্যার কারণ হচ্ছে। সাম্প্রতিককালে তো কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্প ও ভাসানচর থেকে রোহিঙ্গারা অহরহ পালিয়ে যাচ্ছে এবং প্রায়ই ধরা পড়ছে। এখন আর এ সংখ্যার হিসাব রাখাই কঠিন হয়ে পড়েছে। অথচ এদেরকে ফিরিয়ে নেওয়ার জন্য মিয়ানমার সরকার বা আন্তর্জাতিক মহলের কার্যকর উদ্যোগ নেই বললেই চলে। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন বিষয়ে দুই দেশের সচিব পর্যায়ের যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপের (জেডব্লিউজি) সভাও হয় না নিয়মিত। তিন বছর পর গত মঙ্গলবার জেডব্লিউজি ভার্চুয়াল সভা হয়েছে। জানা গেছে, বাংলাদেশ কর্তৃক দেওয়া আট লক্ষাধিক নামের মধ্যে তারা ৫৮ হাজার নাম যাচাই-বাছাই করে মাত্র ৩০ হাজার রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে রাজি হয়েছে, কিন্তু কবে তা বাস্তবায়ন হবে তা নিশ্চিত হওয়ার সময় এখনো হয়নি। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া আরও দ্রুত করা ও অবিলম্বে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরুর তাগিদ দেওয়া হয়েছে। আন্তর্জাতিক মহলের চাপ ছাড়া মিয়ানমার সরকার যে কার্যকর কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করবে না তা বলাই বাহুল্য।
শরণার্থী জীবনের উদ্বেগজনক অধ্যায় হচ্ছে-শিশু-কিশোরদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ, কেননা তারা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাবঞ্চিত। এরা না পাচ্ছে নিজ দেশের শিক্ষাসহ নাগরিক সুবিধা, না পাচ্ছে আশ্রয়দানকারী দেশ বা দেশগুলোর প্রচলিত নাগরিক সুবিধার অধিকার। অবশ্য ইউক্রেন অথবা ইউরোপীয় দেশের উদ্বাস্তুদের কথা আলাদা কারণ তাদের জন্য কোনো সুযোগ-সুবিধারই অন্ত নেই। কিন্তু বাংলাদেশে অবস্থানকারী রোহিঙ্গাদের (শরণার্থী বা বাস্তুচ্যুত) থাকা-খাওয়া ও অন্যান্য কিছু সুবিধা নিশ্চিত হলেও বাস্তব কারণে এরা ইউরোপীয় উদ্বাস্তুদের সমান সুবিধাভোগী নয়। একটি বহুল জনসংখ্যার দেশ হিসাবে বাংলাদেশের পক্ষে সে সুবিধা প্রদান করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। পেশাগত দায়িত্বের অংশ হিসাবে রোহিঙ্গাদের জন্য কাজ করতে গিয়ে আমার এ ধারণা আরও বদ্ধমূল হয়েছে। এদিকে দাতাগোষ্ঠীর সহায়তাও প্রতিনিয়ত সংকুচিত হচ্ছে যা যতই দিন গড়াবে ততই প্রকট হবে। তাই এ সংকটের একমাত্র সমাধান অবিলম্বে প্রত্যাবাসন। এ প্রসঙ্গে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (আরআরআরসি), কক্সবাজার শাহ্ রেজওয়ান হায়াত (অতিরিক্ত সচিব) বলেন, ‘সরকার মানবিক কারণে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিলেও বাংলাদেশের পক্ষে অনির্দিষ্টকাল তার ভার বহন করা সম্ভব নয়। তাই একমাত্র সমাধান হচ্ছে যত দ্রুত সম্ভব রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া শুরু করা। সরকার এ লক্ষ্যেই অব্যাহতভাবে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।’ দ্বিপাক্ষিক ও আন্তর্জাতিক চাপ অথবা কূটনৈতিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে যত দ্রুত এটি করা যায়, ততই বাংলাদেশের জন্য তা মঙ্গল বয়ে আনবে।
লেখক : বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির পরিচালক