ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. রেজাউল করিমের উদ্দেশে হাইকোর্ট বলেছেন, আপনার অফিসে দুই ক্লার্কের ঝগড়া হয়েছে। আপনি কীভাবে এতে সম্পৃক্ত হয়ে গেলেন? আপনি তো দুজনের অভিভাবক, সমাধান না করে পক্ষ নিলেন। ফরিদপুরের বোয়ালমারীর মানুষ কি ঘটনাটি জানে না। পত্রপত্রিকায় এসেছে। তাদের কাছে ভুল বার্তা গেছে যে বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগের মধ্যে মারামারি হয়েছে। এতে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়েছে। সভ্য রাষ্ট্র যেভাবে পরিচালিত হয়, তাতে একটি কলঙ্ক লেগে গেল।
বিচারপতি জে বি এম হাসান ও বিচারপতি রাজিক–আল–জলিলের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ মঙ্গলবার (২১ জুন) এ কথা বলেন। নোটিশ জারি করতে যাওয়া আদালতের দুই কর্মচারীর সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে উচ্চ আদালতের আদেশ অনুসারে মঙ্গলবার সকালে আদালতে হাজির হন বোয়ালমারীর ইউএনও রেজাউল করিম ও তাঁর অফিসের নাজির উকিল মিয়া।
এর আগে গত ২৭ এপ্রিল বোয়ালমারী সিনিয়র সহকারী জজ আদালতের দেওয়ানি মামলার (৫৩/২০২২) নোটিশ জারি করতে জারিকারক মো. কামাল হোসেন ও মেহেদী হাসান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে যান। আদালতের কর্মচারীদের সঙ্গে অসৌজন্যমূলক আচরণ ও ভ্রাম্যমাণ আদালতে সাজা দেওয়ার হুমকির অভিযোগ ওঠে। এরপর ফরিদপুর আদালত থেকে লিখিতভাবে সুপ্রিম কোর্টের রেজিস্ট্রার জেনারেলকে ঘটনা জানিয়ে অবহিতকরণপত্র পাঠানো হয়। প্রধান বিচারপতি বিষয়টি শুনানি ও নিষ্পত্তির জন্য বিচারপতি জে বি এম হাসানের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চে পাঠান। শুনানি নিয়ে ৭ জুন হাইকোর্ট স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আদালত অবমাননার রুল দিয়ে নিজেদের ভূমিকা ব্যাখ্যা করতে বোয়ালমারীর ইউএনও ও তাঁর অফিসের নাজিরকে ২১ জুন আদালতে হাজির হতে নির্দেশ দেন।
এ অনুসারে সকালে বোয়ালমারীর ইউএনও মো. রেজাউল করিম ও তাঁর অফিসের নাজির উকিল মিয়া আদালতে হাজির হন। আদালতে ইউএনওর পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী শফিক আহমেদ ও মাহবুব শফিক। উকিল মিয়ার পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী মোজাম্মেল হক। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল তুষার কান্তি রায়।
নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা
শুনানিতে ইউএনও মো. রেজাউল করিম নিঃশর্ত ক্ষমা প্রার্থনা করেন। তাঁর আইনজীবী বলেন, একটি ভুল–বোঝাবুঝি হয়ে গেছে। বিচার বিভাগকে অবজ্ঞা করার কোনো উদ্দেশ্য তাঁর ছিল না।
ইউএনও মো. রেজাউল করিমের উদ্দেশে আদালত বলেন, জারিকারক সমন নিয়ে গেছে, তখন ঘটনা ঘটেছে, এটি তো ফ্যাক্ট। জারিকারক দাওয়াত দিতে যাননি। আদালত সবার ওপরে। আদালত সমন দিলে তা মানতে হবে। ইউএনও মানে কী? আইন আছে বলেই ইউএনও। আইন ও আদালতকে সম্মান না করলে আপনাকেও কেউ সম্মান করবে না। আপনি যদি আইন না মানেন, কেউ আপনাকে মানবে না।
আদালত বলেন, নাজিরের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিয়েছেন কি? তখন ইউএনও মো. রেজাউল করিম বলেন, কারণ দর্শাতে বলা হয়েছে।
ইউএনও মো. রেজাউল করিমের উদ্দেশে আদালত বলেন, ‘আপনি উপজেলা পর্যায়ে সর্বোচ্চ কর্মকর্তা। আপনি বিষয়টি হ্যান্ডেল করতে পারেননি। আদালত অবমাননার কারণে আপনাকে আসতে হয়েছে। ক্যারিয়ারে কী হলো? ক্যারিয়ারে স্পট পড়ে গেল। জীবনে একটি স্পট পড়ে গেল। একটি লাইন লিখে দিলে আপনার জীবন ধ্বংস হয়ে যাবে।’
এ সময় ইউএনও মো. রেজাউল করিম বলেন, আইন ও আদালতের প্রতি সব সময় শ্রদ্ধাশীল।
এরপর ইউএনও অফিসের নাজির উকিল মিয়ার উদ্দেশে আদালত বলেন, আপনি মূল অপরাধী। আপনি সমনের নোটিশ গ্রহণ না করে গন্ডগোল করেছেন। সিনক্রিয়েট করেছেন।
শুনানির শেষ পর্যায়ে ইউএনওর উদ্দেশে আদালত বলেন, ভবিষ্যতে এ ধরনের ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে। তখন ইউএনও বলেন, ‘আদালতের আদেশ পালনে সচেষ্ট থাকব।’ আদালত বলেন, আপনার চেয়ার ও দায়িত্বের প্রতি নজর রাখবেন। মানুষ যত উচ্চ পদে যায়, তাকে তত বিনয়ী হতে হয়। আদালতকে সম্মান না করলে আপনিও সম্মান পাবেন না। আদালতকে সম্মান করা দায়িত্ব।
শুনানি নিয়ে আদালত ইউএনও রেজাউল করিম ও তাঁর অফিসের নাজির উকিল মিয়াকে ব্যক্তিগত হাজিরা থেকে অব্যাহতি দিয়ে আগামী রোববার আদেশের জন্য দিন ধার্য করেন।
অবহিতকরণ পত্রে যা রয়েছে
ফরিদপুরের আদালত থেকে পাঠানো অবহিতকরণপত্র থেকে জানা যায়, গত ২৭ এপ্রিল বোয়ালমারী সিনিয়র সহকারী জজ আদালতের দেওয়ানি মামলার (৫৩/২০২২) নোটিশ জারি করতে জারিকারক মো. কামাল হোসেন ও মেহেদী হাসান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে যান। সেদিন আড়াইটার দিকে নাজির উকিল মিয়ার কাছে নোটিশ গ্রহণের অনুরোধ জানালে তিনি ব্যস্ততা দেখিয়ে তাঁদের অপেক্ষায় রাখেন।
বিকেল চারটার দিকে তাঁরা আবারও নাজিরের কাছে গেলে তিনি উত্তেজিত হয়ে তাঁদের ওপরের তলায় গিয়ে বসতে বলেন। অন্য জায়গায় সমন জারির কাজ আছে জানালে উকিল মিয়া বলেন, তাতে তাঁর কি, জজকোর্টের নোটিশ না রাখলে তাঁর কী হবে? তিনি এর চেয়ে বড় কাজে ব্যস্ত আছেন। তিনি নোটিশ পাশের টেবিলে দিতে বললে পাশের টেবিলে দায়িত্বরত কর্মচারী নোটিশ বুঝে নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। জারিকারক বিষয়টি কোর্টকে অবহিত করবেন বললে উকিল মিয়া বলেন, ‘জজের ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। আমরা নির্বাহী বিভাগের লোক। নোটিশ না রাখলে আমাদের কিছুই হবে না।’
একপর্যায়ে নোটিশ বুঝে নেন উকিল মিয়া। ইতিমধ্যে ওই অফিসের একজন কর্মচারী বিষয়টি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে অবহিত করলে তিনি জারিকারক দুজনকে তাঁর কক্ষে ডেকে নিয়ে দরজা আটকে জেরা করতে থাকেন। তাঁদের বিরুদ্ধে তাঁর স্টাফদের সঙ্গে বাজে ব্যবহারের অভিযোগ তুলে ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে তাঁদের সাজা দেওয়ার হুমকি দেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রেজাউল করিম এ সময় তাঁদের মুঠোফোন কেড়ে নেন এবং মুচলেকা দিয়ে চলে যেতে বলেন। তাঁরা রোজা আছেন জানালে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাঁদের বলেন যে মুচলেকা ছাড়া তিনি তাঁদের ছাড়বেন না। তিনি তাঁদের পা ধরে মাফ চাইতে বাধ্য করেন এবং জোর করে তাঁর নির্দেশনামতে মুচলেকা লিখিয়ে ছেড়ে দেন।
অবহিতকরণপত্রে আরও বলা হয়, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয় থেকে মুক্ত হয়ে ওই দুজন জারিকারক বিষয়টি প্রথমে জেলা জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত নাজির মো. রফিকুল ইসলামকে জানান। নাজির বিষয়টি নেজারত শাখার ভারপ্রাপ্ত জজকে অবহিত করেন। নেজারত শাখার ভারপ্রাপ্ত জজ জারিকারকদের লিখিত অভিযোগ পরবর্তী সময়ে সংশ্লিষ্ট আদালতে পাঠান। গত ১৯ মে বোয়ালমারীর সিনিয়র সহকারী জজ (৫৩/২০২২ নম্বর) মামলার এক আদেশে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও তাঁর কার্যালয়ের নাজিরের বিরুদ্ধে কেন বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হবে না—তা আদেশ পাওয়ার ১০ দিনের মধ্যে উপস্থিত হয়ে লিখিত ব্যাখ্যা দিতে নির্দেশ দেন। পরবর্তী আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত হাইকোর্ট কারণ দর্শানোর এই নোটিশের কার্যক্রম না চালাতে বোয়ালমারীর সিনিয়র সহকারী জজকে ৭ জুন নির্দেশ দেন।