পদ্মা, মেঘনা ও যমুনা এই তিন বিশাল জলধি বাংলা মায়ের লাল-সবুজ শাড়ির আঁচলের মতো জড়িয়ে আছে দেশমাতৃকার অঙ্গজুড়ে। সেই আঁচলে বাংলার মানুষের একটি অর্ঘ্য নিবেদনের মতো হয়ে বিকশিত হবে পদ্মা সেতু। আর এই অর্ঘ্যের সঙ্গে ইতিহাসের পাতায় আরো একটি বড় অর্জন নিয়ে বাংলার কোটি সন্তানের সঙ্গে গর্বভরে যুক্ত হবে যাঁর নাম, তিনি শেখ হাসিনা।
বহু চড়াই-উতরাই পেরিয়ে বহু সংগ্রামের শেষে আত্মপ্রকাশ করছে পদ্মা সেতু।
বাংলার মানুষকে নিয়তই প্রতিটি অর্জনের জন্য সংগ্রাম করে যেতে হয়েছে, হচ্ছে এবং হতে থাকবে আরো বহুদিন, যত দিন না এ মাটিতে নির্মূল হচ্ছে অশুভ শক্তির আস্ফাালন। গত এক যুগে বাংলার মানুষের বিজয়গাথার বহু মাইলফলক রচিত হয়েছে। দারিদ্র্যের চরম সীমানা থেকে বের হয়ে বাংলাদেশ আবির্ভূত হয়েছে এক গতিশীল অর্থনৈতিক ও সামাজিক শক্তিতে। এক যুগে বাংলাদেশের মানুষের মাথাপিছু আয় বেড়েছে চার গুণেরও বেশি, খাদ্যেশস্যে পরিপূর্ণ বাংলার ভাণ্ডার, বৈদেশিক বাণিজ্যের আয়, রেমিট্যান্সের ধারাবাহিক প্রবাহ, শতভাগ বিদ্যুতায়ন, যোগাযোগব্যবস্থা, ডিজিটাইজেশনসহ নানামুখী উন্নয়নে দেশ আজ নুতন পথের অভিযাত্রী। সামাজিক খাতে, বিশেষত নারীর ক্ষমতায়ন, শিক্ষা, শিশুমৃত্যু হার, গড় আয়ুষ্কাল, স্যানিটেশন—সব কিছুতেই বাংলাদেশ আজ দেখছে শুধুম অচিন্তনীয় সাফল্যের হাতছানি। এই সেদিনের সবচেয়ে দারিদ্র্যপীড়িত বাংলাদেশ আজ আত্মপ্রকাশ করেছে উন্নয়নের জাদুর প্রদীপ হাতে নিয়ে। বিশ্বের দরবারে এ দেশ ও জাতি আজ সমাসীন আত্মমর্যাদাশীল সম্মানের আসনে। বাংলার মানুষের বিজয়ের উষ্ণীষে পদ্মা সেতু যুক্ত হতে যাচ্ছে আরো একটি পালক হিসেবে।
২০১৫ সালে শুরু যে কাহিনির, শত ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে সে কাহিনির শুভ সমাপ্তি হবে আগামী ২৫ জুন তারিখে। নিজ অর্থায়নে এই প্রকল্পের শুভ সমাপ্তি টানা ছিল বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জন্য এবং সেই সঙ্গে সমগ্র জাতির জন্য এক বিশাল চ্যালেঞ্জ। অর্থায়নের পূর্বেই আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য দাতা সংস্থার অর্থায়ন বন্ধ করে দেওয়া ছিল একটি চরম অনৈতিক ও বেআইনি পদক্ষেপ। যেভাবে পদ্মা সেতুর কাজ বন্ধ করার জন্য দেশি-বিদেশিচক্র একযোগে ষড়যন্ত্র করে গেছে, মানুষের মনে সন্দেহের সৃষ্টি করেছে, অর্থায়ন বন্ধ করে দেশের সর্বনাশ করতে উদ্যোগী হয়েছে, উচ্চকিত হয়েছে ধারাবাহিকভাবে এবং বাংলার মানুষ যেভাবে ত্যাগ স্বীকার করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাধাকে সাফল্যের অস্ত্র বানিয়েছে তা রূপকথার কাহিনিকেও হার মানায়। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী রাষ্ট্রের বাধা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বীর বাঙালি যেমন করে স্বাধীনতার সূর্যকে ছিনিয়ে এনেছে, ঠিক তেমনি বঙ্গবন্ধুকন্যা বাংলার গৌরবকে ফিরিয়ে এনেছেন উন্নয়নের গতিধারাকে বেগবান করে, যার মধ্যে অন্যতম হলো স্বপ্নের পদ্মা সেতু।
পদ্মা সেতুর মাধ্যমে দেশজ উত্পাদনে ও আয়ে বছরে যুক্ত হবে আরো কয়েক বিলিয়ন ডলার করে। আরো অগণিত সেতু হবে এই দেশে, হবে আরো অগণিত মেগাপ্রকল্পের বাস্তবায়ন। প্রয়োজন শুধু যোগ্য নেতৃত্বের। একজন সুযোগ্য নেতা দেশকে, জনগণকে কতখানি সামনে নিয়ে যেতে পারে তার উদাহরণ বঙ্গবন্ধু, শেখ হাসিনা আর সেই সঙ্গে স্বাধীনতা, বিজয় ও শত শত উন্নয়ন প্রকল্প। এমন সাফল্যে বাংলার মানুষ যতখানি আনন্দে উদ্বেলিত, ঠিক ততখানি দুঃখে ভারাক্রান্ত দেশি-বিদেশি পরাজিত শক্তি। এই সেতু দিয়ে মার্কিন পতাকা, বিশ্বব্যাংকের পতাকা, পাকিস্তানি পতাকা উড়িয়ে মাথা নত করে যেতে হবে সেসব শক্তিকে। আর আমরা উড়িয়ে যাব বাংলাদেশের লাল সূর্য অঙ্কিত সবুজ পতাকা নিয়ে মাথা উঁচু করে। অন্তত এটুকু তফাত তো হবেই। আর এ দেশীয় যারা ষড়যন্ত্র করেছে তারা তা নৌকায়ও যেতে পারবে না, নৌকার প্রতি যে তাদের চরম অনীহা!
দেশ ও জাতি আক্ষরিক অর্থে কী পাবে এই মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে?
১. প্রতিবছর দেশের মোট অভ্যন্তরীণ উত্পাদন বৃদ্ধি পাবে শতকরা ১.৩ থেকে ২ ভাগ, আর রেল যোগাযোগ পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হলে এই বৃদ্ধির পরিমাণ আরো ১ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাবে। টাকার অঙ্কে প্রতিবছর বাংলাদেশের দেশজ আয়ে সংযুক্ত হবে প্রায় এক লাখ এগারো হাজার কোটি টাকা। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের প্রতিবেদন অনুযায়ী দেশজ আয় বৃদ্ধির হারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশে তার বর্তমান অবস্থান ২০ থেকে উন্নীত হয়ে তৃতীয় স্থানে পৌঁছে যাবে ২০২৬ সালের মধ্যে।
২. আনুপাতিক হারে মাথাপিছু গড় আয় বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা যায়। পদ্মা সেতুর অন্যান্য ইতিবাচক সামাজিক প্রভাবের ফলে এই সূচকে আয় বৃদ্ধি আরো বেশি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। আনুপাতিক মাথাপিছু গড় আয় বৃদ্ধি পেলে তা বছরে শতকরা তিন ভাগ হারে পদ্মা সেতু চালু হওয়ার বছরান্তে দুই হাজার ৮১৪ মার্কিন ডলার থেকে বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়াবে দুই হাজার ৮৯৮ মার্কিন ডলারে, যা টাকার অঙ্কে দাঁড়াবে প্রায় দুই লাখ ৭০ হাজার।
৩. দক্ষিণাঞ্চলের ২১টি জেলার সঙ্গে যোগাযোগব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন সংঘটিত হবে। যাতায়াতে সময় কমে যাবে ২০ থেকে ৫০ শতাংশ। অর্থাৎ যেসব স্থানে ঢাকা থেকে ভ্রমণে এখন আট ঘণ্টা সময় ব্যয় হয়, যাতায়াতের সেই সময় কমে দাঁড়াবে চার ঘণ্টায়। এ ছাড়া যোগাযোগব্যবস্থার অভূতপূর্ব উন্নয়নের ফলে সরাসরি সংযুক্ত স্থানগুলোতে কলকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, স্যানিটেশন, ক্ষমতায়ন আরো বেগবান হবে।
এই প্রাপ্তির পরিসংখ্যানের পরও আরেকটি শেষ কথা থেকে যায়, আর তা হলো এই প্রাপ্তি যেন হয় দেশের আপামর জনসাধারণের। জনগণ তখনই সব উন্নয়নের সুফলভোগী হবে যখন সেই সুফলকে পাওয়ার পথগুলো তাদের জন্য উন্মুক্ত হবে। আর সে পথের কাঁটা হয়ে আছে অপশাসন, আমলাতন্ত্র, সন্ত্রাসবাদ, অসম সম্পদ বণ্টনের প্রক্রিয়া। সমাজের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামাজিক ও বেআইনি শক্তিশালী চক্র সর্বকালে, সব সমাজব্যবস্থায় মানুষের অধিকারকে খর্ব করে গেছে ধারাবাহিকভাবে। ব্রিটিশ, পাকিস্তানি, বাংলাদেশি কোনো আমলেই এদের ঔদ্ধত্যের কোনো ব্যত্যয় ঘটেনি, শোষণপ্রক্রিয়াও থেমে থাকেনি। কেবল একজন নেতার পক্ষে এই শক্তির বিরুদ্ধে গিয়ে পূর্ণ বিজয় ছিনিয়ে আনা কোনোকালেই সম্ভব নয়। দুর্নীতির যে সংষ্কৃতি গড়ে উঠেছে শত বছরে, যা পুষ্পে-পত্রে পল্লবিত হয়ে গ্রাস করছে সমাজ, অর্থনীতি ও শাসনযন্ত্রকে, তাকে নির্মূল করার পথ চিনে নিতে হবে মানুষকে ও মানুষের নেতৃত্বকে। যখন সমূলে উত্পাটিত হবে দুর্নীতি ও বৈষম্যের মূল আখড়াগুলো, কেবল তখনই মানুষ পাবে তার পূর্ণ অধিকার, তখনই সর্বস্তরের মানুষ সক্ষম হবে তাদের শ্রম ও সম্পদলব্ধ অর্জনগুলোর সুফলগুলোকে যথাযথভাবে ভোগ করে যেতে।
লেখক : অধ্যাপক, কানাডিয়ান ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ